শো শো শব্দ হচ্ছে। এ শব্দের উৎপত্তি বাতাস থেকে। জানলার গ্লাসে ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকে এ শব্দ তৈরী করছে। মনে হচ্ছে সমুদ্রের তীরে বসে আছি। এর পর পর বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির ফোটা কাঁচের জানালার গ্লাসের ওপর পরে একধরনের শব্দ সৃষ্টি হলো।পায়ের কাছে থাকা কাঁথাটি গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। ইচ্ছে করছে একটু চায়ের কাপে চুমুক দেই। ব্যাচেলর লাইফে এমন কত দিন কাটিয়েছি। বৃষ্টি নামলেই ব্যালকনিতে গিয়ে বসেছি সিগারেট হাতে। জীবন যেন একটা হাওয়াই মিঠাই। প্যাকেট থেকে বের করে রেখে দিলে বাতাসে উড়ে যায়। এসব ভাবতে কখন চোখ বুজেছি খেয়াল নেই। আজকাল এরকম চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। চিন্তা না ঠিক। ভাবনা বলা যায়। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই। ঘুম ভাঙলো ফজরের আজানে। মোয়াজ্জেনের আজান এখনো শেষ হয়নি। বাথরুমে গেলাম। অযু করে বের হওয়ার পথে আয়নার দিকে চোখ গেলো। দাঁড়িগুলো সাদা হয়ে গিয়েছে।মাথার চুল অর্ধেক নেই। কপালে একটা কালো দাগ। নামাজ পড়তে পড়তে এ দাঁগ হয়। দাগটার ওপর হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলাম কতক্ষণ। ভ্রম ভাঙলো দরজায় টোকার শব্দে। আজিজ সাহেব ডাকছেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাটের পাশ থেকে জায়নামাজ এবং টুপি মাথায় দিয়ে দরজা খুলে বের হলাম। বারান্দায় অনেক বৃদ্ধ একসাথে বের হলো।
সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে এই বৃদ্ধাশ্রমের সব বয়স্করা একসাথেই নামাজ পড়তে যাই।মসজিদে ঢোকার আগে মসজিদের সামনে একটি খাটিয়া দেখলাম। সেখানে একটি কাফনে মোড়ানো লাশ আছে। আজিজ সাহেবকে বললাম কে মারা গেলো? আজিজ সাহেব সঠিক উত্তর দিতে পারলেন না। মসজিদে ঢুকে ইমাম সাহেবের কাছে শুনলাম দোতালার পাঁচ নম্বর ইউনিটের রফিক সাহেব মারা গিয়েছেন। বুকটা ভারী হয়ে উঠলো অজানা কারনে। মসজিদে উপস্থিত থাকা বৃদ্ধরা সবাই ইন্না-লিল্লাহ পড়লেন। আমিও পড়লাম। ফজরের নামাজ শেষ করে সামনের খোলা মাঠে সবাই জানাজা নামাজের জন্য দাঁড়ালাম। রফিক সাহেবের আত্মীয় স্বজনরা কেউ আসতে পারেনি। তারা সবাই বিদেশে।রফিক সাহেব ছিলেন আর্মি অফিসার। দেশকে ভালোবেসেছেন বলে তিনি এই দেশ ছেড়ে জাননি। কিন্তু তিনি আজ এই দেশ, এই পৃথিবী ছেড়ে অনেকদূরে চলে গিয়েছেন।
২.
বৃদ্ধাশ্রমের কবরস্থানে রফিক সাহেবকে শায়িত করা হলো। তার কবরে মাটি দিয়ে ফিরলাম। অনেকেই কাঁদছে। সকালের খাওয়ার সময় অনেকের মুখেই গুঞ্জন শোনা গেলো রফিক সাহেবকে নিয়ে। অনেকেই তার গল্প বললো। খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেলাম। সিড়ি ভেঙে উঠতে পারি না বলে, লিফট ব্যবহার করলাম। সকালের খাবারের পরে কোন কাজ থাকে না। আবার কাজ করলে অনেক কাজ করা যায়। মসজিদের ইমাম সাহেব ইসলামী শিক্ষা দেন৷ কোরআন পড়তে শেখান। দুপুরের আগে গোসল সেড়ে আবারো মসজিদে যেতে হয় যোহরের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে দুপুরের খাওয়ার পরে খানিকটা গা এলিয়ে দিয়ে আসরের ওয়াক্তের নামাজ পড়ে কবরস্থান কিংবা৷ বাগানে একটু হাটাহাটি করি। মাগরিবের আজান শেষে কোরআন পড়ি। এশার নামাজ পড়ে সবাই এসে একসাথে বসে গল্পগুজব করি। সবাই তাদের জীবনের গল্প বলে। আমিও বলি। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ গল্প করতে পারে।একজন বৃদ্ধ মানুষ সবসময় চায় গল্প করার মতো মানুষ। তার সারা জীবনের গল্প শোনায়।
৩.
সন্ধ্যে বেলায় আমার মেয়ে ফোন দিয়েছিলো। নাতী বেশ বড় হয়েছে৷ ওর নাম রেখেছে সুবাইয়া। বেশ ভালো নাম। নামটিও আমিই দিয়েছিলাম।
আমার মেয়ে কানাডাতে থাকে। ওখানেই সেটেল হয়েছে। আমাকে নেওয়ার জন্য কত তোড় জোর। আমি যেতে চাইনি। আমি মরলে এই দেশেই মরবো। এই দেশ, এই ভুখন্ডেই জন্মেছি এই ভুখন্ডেই মারা যাবো। এই আমার শেষ কথা। আমার নিজের বাড়ি আছে। সে বাড়িটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি এই বৃদ্ধাশ্রমে। নিসঃঙ্গতা আর একাকিত্ব কাঁটাতে। আমি ব্যাচেলর জীবন কাটাচ্ছি। বৃদ্ধবয়সে ব্যাচেলর জীবন কাটাতে মন্দ লাগছে না। এখানে এসেছি প্রায় এক বছর হতে চললো। কখনো খারাপ লাগেনি। মেয়ের সাথে প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলি। মেয়ে বলেছে আগামী মাসে এসে আমার সাথে দেখা করবে। কাজের নাকি অনেক চাপ যাচ্ছে।
৪.
আজ গল্প বলার ভাড় পরেছে আমার ঘাড়ে।সবাই চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তার আগেই গল্প শুরু করলাম। ছোটবেলাতে আমাদের কাঠের ঘর ছিলো। আমি ঘুমাতাম আমার ছোট চাচার সাথে।ছোট চাচা ভার্সিটিতে চলে যান। আমি একা একা ঘরে থাকি।আমার ঘরের দক্ষিণ দিকের জানলাটার একটি অংশ ছিলো ভাঙা।
জানলা থেকে তাকালেই কবর স্থান দেখা যায়। খুব রাত হলে ভয় পেতাম। গরমেও কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম। বাবার কাছে প্রত্যক্ষ ভাবে কথা বলার সাহস না পাওয়া মা কে বলতাম। বাবা গ্রাহ্য করলেন না।আমাদের বাড়িতে মোট আটখানা ঘর ছিলো। আমাদের বাড়িতে এক দাদা মারা গেলেন৷ তার কবর দেওয়া হলো। সেদিন ভরা পূর্নিমা। খাল-বিল পানিতে টইটুম্বুর। চাঁদের আলো ভাঙা জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরে এসে পড়েছে। ছোট চাচা তখন ভার্সিটিতে পড়েন।
গ্রামে রাত দশটা মানে অনেক রাত। আমি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছি। মনটা হাঁসফাস করছে। বুক জুড়ে অজানা ভয়। এই ভয়ে ভয়ে কখন তন্দ্রাচ্ছন হয়েছি কে জানে। ঘুম ভাঙলো ফিসফিসানিতে। আমি হকচকিয়ে উঠে – মা রে বাবা রে বলা ডাকাডাকি শুরু করলাম। সবাই ছুটে এলো! বাবা দামড়া বলে চলে গেলেন। আমার মাথায় পানি ঢালা হলো। মাথ উল্টো ছিলো বলে ভীড়ের মধ্যে একটি মুখ দেখতে পেলাম। ছোট চাচা হাসছে। বুঝলাম আসল কাহিনী কি। ছোট চাচা পরে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলেন। তিনি হাসলেন, আমিও হাসলাম। হাসির রোল পড়ে গেলো। ছোট চাচা বেশিদিন বাঁচলেন না। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে বাস এক্সিডেন্টে মারা গেলেন। তার দু বছর পরে মারা গেলেন বাবা। রুম জুড়ে নিস্তাব্ধতা বয়ে গেলো। কেউ চোখ বুজে আছে। কেউ হাসছে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া। রাতের খাবার শেষে রুম আসলাম। জানালার পাশে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। হাসনাহেনার গন্ধ আসছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম কবরস্থানের দিকে।
জীবন যেন হাওয়াই মিঠাই,অল্প সময়েই শেষ হয়ে যায়। এই তো জীবন!
.
.
২৯ জুলাই ২০২০