অণুগল্পগল্পপ্রথম পাতাভালোবাসার গল্পসর্বশেষ

ভালোবাসা

 পার্থসারথি

 

কাক ডাকা ভোরেই বিছানা ছাড়লেন চিত্তরঞ্জন বাবু।এমনভাবে বিছানা থেকে নামলেন যেন স্ত্রী সুভদ্রাবালা দেবী টের পেয়ে বিরক্ত না হন। কিন্তু বিধি বাম ; দরজাটা খুলতে গিয়ে ঠাস করে বেশ জোরেই শব্দ হলো। সুভদ্রাবালা  দেবী এক ধমক বসালেন- এই বুইড়া, তোমাকে অনেকবার বলেছি, ভোর বেলা বাইরে যাবে না।

চিত্তরঞ্জন বাবু চুপচাপ ঘরের বাইরে পা বাড়ালেন। সোজা গিয়ে ফুল বাগানে ঢুকলেন। তারপর ডাঁটাসহ বেশ কিছু ফুল ছিঁড়ে হাতে নিলেন। গোলাপ ফুলই বেশি। সবগুলো ফুল একসঙ্গে করে একটা ফুলের তোড়া বানালেন। তোড়াটা দারুণ হয়েছে! খোশ মেজাজে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অতি সাবধানে ঘরের ভেতর ঢুকতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। স্ত্রী সুভদ্রাবালা দেবী ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন- কি হলো!

ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা প্রিয় ফুলগুলোর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন চিত্তরঞ্জন বাবু। কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে সুভদ্রাবালা দেবী আবারও বললেন-  তোমাকে বারবার বারণ করেছি, ভোরের ঘুমে আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। 

চিত্তরঞ্জন বাবু শান্ত কন্ঠে বললেন- একটু কাজ ছিল তাই।

সুভদ্রাবালা দেবী বিছানায় বসে থেকেই বলেন- তোমার এমন কাজের মুখে আমি একশ’ ঝাটা  মারি ! আপদ কোথাকার। 

চিত্তরঞ্জন বাবু প্রিয় স্ত্রীর মুখে এমন কুৎসিত কথা শুনে একেবারে হতবাক। সারা  মুখমণ্ডলে নিমেষেই বিষাদের কালো ছায়া লেপটে বসল। মনের নীল কষ্টকে আড়াল করে ছড়িয়ে পড়ে থাকা ফুলগলো কুড়িয়ে আবার হাতে তুলে নিলেন। তারপর নীরবে ঘরের বাইরে পা বাড়ালেন।হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরিয়ে নদীর পাড়ে এসে বসলেন। নির্জন স্থান।লোকালয়গুলো বেশ দূরে দূরে। ফুলগুলো এখনও হাতের মুঠোয় ধরা। চোখের সামনে শান্ত নরসু্ন্দা নদী ধীর লয়ে বয়ে চলেছে। পেছনে অবারিত সবুজের হাতছানি। সকালের মুগ্ধ হাওয়ায় সবকিছু মিলিয়ে মনোরম দৃশ্য। কিন্তু চিত্তবাবুর চিত্ত ভালো নেই। মাছরাঙা পাখির ব্যস্ততায় নিজেকে হারিয়ে চুপচাপ বসে আছেন।

*

চিত্তরঞ্জন বাবুর পড়ার ঘরে ঢুকেই সুভদ্রাবালা দেবী ভীষণ অবাক।লোকটা ঘরে নেই। কখনও এই রকম হয়েছে কি না মনে করতে পারছেন না। কারণ চিত্তরঞ্জন বাবুর সকাল সাতটার মধ্যে এক জোড়া টোস্ট আর এক কাপ লাল চা চাই-ই চাই। ট্রেটা টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর খুঁজলেন বাথরুমে, উঠানে, বাগানের সব কোণে ;  কিন্তু কোথাও নেই। শ্বাশুড়ীর চঞ্চলতা দেখে বউমা জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি কী খুঁজছেন মা?

সুভদ্রাবালা দেবী চুপচাপ। কিন্তু চোখ জোড়া এখনও কিছু যেন খুঁজছেন। 

আবার জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি কী খুঁজছেন মা?

উনাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!

বাবার কথা বলছেন?

হ্যাঁ মা।

বাবা তো এই সময় ঘরেই থাকেন।

তাই তো, কিন্তু নেই!

কথা শেষ হতে না হতেই ছেলে রজিত এসে হাজির হলেন। তারপর মায়ের কাছে জানতে চান- মা সত্যি করে বলো তো, তুমি বাবাকে কিছু বলেছো?

মা সুভদ্রাবালা দেবী মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।

রজিত বাবু একটু রাগত কন্ঠেই বললেন- মা, তোমাকে কতবার বলেছি, বাবাকে অনর্থক বকাবকি করো না।

সুভদ্রাবালা দেবী শিশুর মতোই কেঁদেই ফেললেন- তোর বাবাকে খুঁজে নিয়ে আয়! আর কোন দিন কিছু বলবো না।  

শ্বাশুড়ী মায়ের কান্না দেখে বউমা বেশ লজ্জা পেলেন। শাড়ির আঁচলে হাসিমাখা মুখ ঢাকলেন।

মায়ের কান্না দেখে রজিত বাবুরও হাসি পাচ্ছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নেন। তারপর মাকে আদর করতে করতে বলেন- তুমি শান্ত হও মা। আমি যাচ্ছি, বাবাকে খুঁজে নিয়ে আসছি।

রজিত বাবু বাবাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেলেন। নাতি-নাতনীরা ঠাকুরমার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছে। আর ভালোবাসার মানুষের জন্য ঠাকুরমার কান্নার মুহূর্তটাকে বেশ উপভোগ করছে। আড়াল থেকে বউমাও বেশ উপভোগ করছেন। আবার মাঝে-মধ্যে দুঃশ্চিন্তা এসে ভর করছে। কারণ রজিত বাবুও কোন খবর নিয়ে আসছেন না। এদিকে দুপুর প্রায় গড়িয়ে এল।

*

টেলিফোনটা বেজে ওঠতেই দৌঁড়ে এসে বউমা রিসিভারটা তুলে বললেন- হ্যালো।

কিছু না জিজ্ঞ্যেস করেই অপরপ্রান্ত থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল- শুভ সুবর্ণ জয়ন্তী সুভদ্রা, তোমাদের ৫০তম বিবাহ বার্ষিকীতে প্রাণঢালা অভিনন্দন!

এই প্রান্ত থেকে নিরুত্তর।

অপরপ্রান্ত থেকে আবার কন্ঠস্বর ভেসে এল- সুভদ্রা, তোমাদের ৫০তম বিবাহ বার্ষিকীতে প্রাণঢালা অভিনন্দন! 

কোন উত্তর নেই। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। 

আমাকে চিনতে পারছো না ? আমি রসময়।

একটু লাইনে থাকুন প্লিজ। আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি।

সুভদ্রাবালা দেবী একটু অবাক হয়েই রিসিভারটা হাতে নিয়ে বললেন- হ্যালো।

সুভদ্রা বলছো? 

হ্যাঁ বলছি।

আমি রসময় বলছি।

সুভদ্রাবালা দেবী খানিক চুপসে যান। নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর বলেন- রসময় কেমন আছো তুমি ?

শুভ সুবর্ণ জয়ন্তী সুভদ্রা, তোমাদের ৫০তম বিবাহ বার্ষিকীতে প্রাণঢালা অভিনন্দন!

ধন্যবাদ। মনে রেখেছো তাহলে ?

আমি কি কোনদিন ভুলেছি তোমাকে ?

সুভদ্রাবালা দেবী লজ্জায় কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হন,কিন্তু বলেন- তোমার বউ-বাচ্চা সবাই ভালো তো?

হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। সুভদ্রা যে জন্য তোমাকে ফোন করেছি ; আমরা সব বন্ধুরা তোমাদের এখানে আসছি। আমরা খুব কাছাকাছি আছি। এখন রাখলাম। সুভদ্রাবালা দেবীকে কোনরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন রসময় বাবু।

*

নষ্টালজিয়ায় ভোগেন সুভদ্রাবালা দেবী। রসময় বাবু সুভদ্রাবালা দেবীকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসতেন। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিককার কথা। রসময় সুভদ্রা বলতে পাগল প্রায়। রসময় বাবুর ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন ছিলেন এই সুভদ্রাবালা দেবী। রসময় বাবুকে তিনি যে পছন্দ করতেন না, তা’ কিন্তু নয়। তবে সেই পছন্দটুকু শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ তার হৃদয় জুড়ে গেঁথে ছিল চিত্তরঞ্জনের মনকাড়া চাহনির হৃদড় জুড়ানো ছন্দময় মুহূ্র্ত। যার ছোঁয়া পায় ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে শেরপুরের গজনীতে যখন যান। নিজের প্রচণ্ড রকমের পছন্দ জীবনানন্দ দাশের কবিতা । চিত্তরঞ্জন অনর্গল আবৃতি করে প্রিয় কবির কবিতা। মাঝে মাঝে একাকি আনমনেও চলে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিচরণ। কল্পনায় ভাসতে ভাসতে হৃদয়-মন আচমকা পুলকিত হয়। ঐ দিন পাহাড়ের ঢালে বসে চিত্তরঞ্জন যখন বললেন- তোমাকে ভালোবাসি। সেদিন ফিরিয়ে দিতে পারেন নি।

রসময় উন্মাদের মতো ছুটে বেড়ান সুভদ্রাবালার ভালোবাসার আশায়। একদিন পথ রুখেই দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সুভদ্রাবালা দেবী আর চিত্তরঞ্জন বাবুর বাড়িয়ে দেয়া অমায়িক বন্ধুত্বের হাতে কোন আঁচড় কাটতে পারেন নি। সেই থেকে ওদের মাঝে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। 

*

বাবাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন রজিত। সম্ভাব্য সবখানেই খুঁজেছেন। চিন্তাক্লিষ্ট মনে উঠানে পায়চারি করছেন। একজন প্রতিবেশী এসে জানিয়ে গেছেন চিত্তরঞ্জন বাবুর খোঁজ।

কথা শেষ না হতেই বাড়ির ভেতর হুড়মুড়িয়ে আট-দশজন পুরুষ-মহিলা আর গুটিকতক বাচ্চা ছেলে-মেয়ে প্রবেশ করলো। কোলাহলের শব্দ পেয়ে সুভদ্রবালা দেবী বেরিয়ে এলেন। 

সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। রসময় বাবু বেশ আনন্দের সাথেই বললেন- তাহলে চিত্তরঞ্জন অভিমান করে যেখানে বসে আছে সেখানেই আমরা বিয়ে বার্ষিকীটা পালন করবো। যেই কথা সেই কাজ। সদলবলে ছুটলেন রসময় বাবু। শুধু রজিত বাবু ও তার স্ত্রী রয়ে গেলেন। শত হলেও বাবাকে লজ্জায় ফেলতে চান না রজিত বাবু।

চলতি পথে এক ফাঁকে রসময় বাবু সুভদ্রাবালা দেবীকে ফিসফিসিয়ে বললেন- সুভদ্রা তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী! চিত্ত তোমাকে এখনও ঠিক আগের মতোই ভালোবাসে।

মুচকি হেসে সুভদ্রাবালা দেবী বলেন- হিংসে করে বলছো না তো আবার?

একটা হাত বুকে রেখে আর চোখের পুরো রাজ্য জুড়ে দু্ষ্টুমি ভরা হাসি মাখিয়ে রসময় বাবু বলেন- হিংসে করার দুঃসাহস কি আমার আছে ?  মন থেকেই বলছি এবং ভালোবেসে।

 

রায়েরবাজার, ঢাকা।

 

 

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]