পার্থসারথি
পারমিতার বড়দিদি সুদেষ্ণা। স্বামীসহ ধানমন্ডি পনের নম্বর থাকেন। ভাড়া বাসা। স্বামী অভীক মজুমদার ব্যাংক কর্মকর্তা। দিদিদের নতুন সংসার।
দিদির পীড়াপীড়িতেই পারমিতাকে প্রায়ই বাসায় যেতে হয়। দুলাভাইটি বেশ ভালো মানুষ। বাসায় বেড়াতে গেলে বেশ খুশী হন। দিদি বলেছিলেন, নববর্ষের দিন দুপুর বেলায় বান্ধবীদের নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তুু পারমিতা গতকাল সন্ধা পর্যন্ত টিএসটিতেই বন্ধু বান্ধবীদের সাথে কাটিয়েছে। তারপর *রুচিদিকে নিয়ে বাসায় এলো।
গতরাতটা পারমিতার এক অচেনা আচ্ছন্ন জগতে কেটেছে। সৈকতকে দেখার পর থেকেই প্রতিটি মূহূর্ত কেটেছে ভাবনার অতলে ডুবে ডুবে। এমন তো তার কখনও হয়নি। দেখার পরই পারমিতার মনে হয়েছে সৈকত যেন ওর কাছে যুগ যুগ ধরে চেনা। মাঝখানে কিছুদিন অন্তরাল। আবার দেখা। অথচ সত্যিকার অর্থে সৈকতের চোখ জোড়ায় পারমিতা গতরাত সর্বক্ষণ ডুবেছিল এক অদৃশ্য টানে। পারমিতা ভেতরে ভেতরে ভীষণ ছটফট করছিল। কিন্তু *রুচিরাকে তা বুঝতে দেয় নি। যতই রাত বাড়ছিল ততই যেন সৈকতকে দেখার ইচ্ছেটা অবাধ্য হচ্ছিল। পারমিতার ভাবনার জগৎ জুড়ে এখন শুধু সৈকত।
পারমিতা ও রুচিরা যখন বাসার বাইরে পা বাড়াল তখন বেলা সকাল ৯টা কী সাড়ে ৯টা হবে। রিকশা নিয়ে সোজা ক্যাম্পাসে চলে এল। ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে পারমিতা বলল, রুচিদি আপনি সৈকতকে নিয়ে এসে এখানে অপেক্ষা করবেন। আমি ক্লাসটা সেরেই সোজা এখানে চলে আসব।
রুচিরা চলে আসে দর্শন বিভাগের সামনে তেমন কেউ নেই এখানে। রুচিরা মনে মনে ভাবল, দাঁড়ালে অন্ততপক্ষে একটা ঘন্টা দাঁড়াতে হবে। তাও আবার একা। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। রুটিন বোর্ডটার দিকে রুচিরা এগিয়ে যায়। রুটিন বোর্ড থেকে খুঁজে বের করে নেয় সৈকতের ক্লাসরুমের নম্বরটা। তারপর হেঁটে চলে ওই দিকে।
স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। কয়েকবার এপাশ ওপাশ হাঁটল রুচিরা কিন্তুু সৈকতকে চোখের সীমানায় আনতে পারে নি । তারপর সৈকতকে দেখা যায় এমন জায়গায় দাঁড়াল। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই সৈকতের চোখ রুচিরার ওপর পড়ল। রুচিরা সৈকতকে চোখে ইশারা করল বেরিয়ে আসতে।
মিনিট পাঁচেক পরই সৈকত ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসেই সৈকত বলল, কী ব্যাপার রুচিদি? হঠাৎ ক্লাস রুমেই ডাক পড়ল।
রুচিরা হাত ঘড়িটা দেখে নিল। তারপর বলল- চল এক জায়গায় যেতে হবে। কথাগুলো বলেই রুচিরা হাঁটতে শুরু করল।
সৈকত কোন কথা বলল না। রুচিরার পায়ের তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। সৈকতের ইচ্ছে হচ্ছিল পারমিতার কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তুু কথাটা বুকের ভেতরই বারবার ঘুরপাক খেল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনে এসে রুচিরা বলল- এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। ক্লাস শেষেই পারমিতা চলে আসবে।
পারমিতার কথাটা কানে পোঁছামাত্রই সৈকত যেন বিদ্যুৎষ্পৃষ্ট হল। তন্ময়তার ঘোর ভাবটা কাটিয়ে সৈকত বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। সৈকতের কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন একটু অচেনা মনে হল। আসলে পারমিতা ওর ভাবনার অলিতে-গলিতে বিচরণ করছিল। তাই স্বর ফুটে কথাটুকু সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেনি। আর রুচিরা ভাবল, হয়ত সৈকতের ক্লাসটা করার ইচ্ছে ছিল অথবা অন্যকিছু। তাই রুচিরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- সৈকত কিছু মনে করো না প্লিজ, তোমাকে ডেকে এনে অসুবিধায় ফেলিনি তো?
সৈকত বালকসুলভ অভিমানে বলল- দিদি, আপনি এতদিনে আমাকে এতটুকু চিনলেন?
রুচিরা দুহাতে সৈকতের একটা হাত টেনে ধরে বলল, প্লিজ লক্ষী ভাইটি রাগ করো না। আসলে আমি কথাটি ওভাবে বলিনি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর সৈকত রুচিরার দিকে তাকায়। রুচিরা সৈকতের হাত ছেড়ে দিয়ে পাশাপাশি হয়ে দেয়ালে কনুই চেপে দাঁড়ায়। সৈকত বলে- রুচিদি, যে কোন কাজে এই ছোট ভাইটিকে স্বরণ করবেন। দেখবেন বান্দা হাজির।
রুচিরা মিষ্টি হেসে বলে- ঠিক আছে, অবশ্যই ডাকব।
চলুন, চা খেয়ে আসি। হাতে এখনও অনেক সময় আছে।- প্রসঙ্গ ঘোরাবার প্রয়াসে সৈকত বলে।
রুচিরা বলে- পারমিতা আসুক। একসঙ্গেই খাওয়া যাবে, কি বলো?
হ্যাঁ, অবশ্যই। রুচিরার কথাটুকু সৈকতের খুবই ভালো লেগেছে। আর সত্যি বলতে কি, সৈকত মনে মনে এটাই চেয়েছিল।
তারপর পারমিতার জন্য অপেক্ষা । সময় পেরিয়ে পারমিতা এসে হাজির হয় যথাসময়ে। সৈকতের কাছাকাছি হতেই পারমিতা কিছুটা অপ্রস্তত হয়ে যায়। সৈকত পারমিতার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না।
অপ্রস্তুতের ছন্দপতন ঘটিয়ে পারমিতা বলে- আপনাদের অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম দিদি।
রুচিরা বলে সময়টা খারাপ কাটে না। সৈকতকে ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে এসেছি।
সৈকতের দিকে তাকিয়ে পারমিতা হাসে। পারমিতার হাসিতে সৈকতের ভেতর ভুবন কেঁপে ওঠে। প্রকাশ পায় হাসিতে। দিদি, চলুন চা খাওয়া যাক।- এই বলে সৈকত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
হ্যাঁ, চল।- রুচিরা বলে।
তারপর হাঁটতে শুরু করে। চলে আসে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়াতে। রুচিরা পার্সে হাত ঢুকাতে যায়। সৈকত বলে- আপনারা গিয়ে বসুন, আমি নিয়ে আসছি।
উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে সৈকত কাউন্টারের দিকে পা বাড়ায়। রুচিরা পেছন থেকে ডেকে বলে দেয়- শুধু চা হলেই চলবে।
সৈকত কোন জবাব দেয়নি। রুচিরা ও পারমিতা একটা টেবিল দখল করে পাশাপাশি বসে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা ট্রে হাতে সৈকত হাজির হয়। তিনটি সমোচা আর তিন কাপ চা। ট্রে-টা টেবিল রাখতে রাখতে সৈকত বলল- আমি পানি নিয়ে আসছি, একটু বসুন।
সৈকত এক দৌঁড়ে গেল আর এল। তারপর পানির দুটো গ্লাস টেবিল রাখল। ট্রে-টা পারমিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে সৈকত বলল নিন, শুরু করুন।
পারমিতা হাত বাড়িয়ে একটা সমোচা তুলে নেয়। রুচিরা একটা সমোচা হাতে নিতে নিতে বলল- সৈকত, আপনি নয়, তুমি বল, ও তোমার পরের ইয়ারে।
হয়ে যাবে, কিছুক্ষণ আপনি আপনি চলুক, তারপর হয়ে যাবে। – কথা শেষ করে সৈকত হাসে।
রুচিরা বলে- আপনি বলার কোন প্রয়োজন নেই।
রুচিদি ঠিকই বলেছেন। আপনি আমার সিনিয়র অতএব এখন থেকেই আমাকে তুমি বলবেন। -পারমিতা খুব সুন্দরভাবে কথাগুলো গুছিয়ে বলে।
এটা-সেটা আলাপ-চারিতায় চা-পর্ব শেষ হয়। তারপর ক্যাফেটেরিয়া থেকে ওরা বের হয়ে আসে। এক রিকশায় তিনজন চেপে বসে। সৈকত বসল সিট ব্যাকের উঁচুটায়। আর ওরা দু’জন সিটে বসল। রিকশা আসাদ গেটের উদ্দেশে রওনা হল। সৈকত বারবার ভাবছে; পারমিতা এত নিকটে আসবে তা গতকালও ছিল স্বপ্ন। নিজস্ব ভুবনে সৈকত মশগুল। অবশ্য পারমিতাও এই মুহুর্তে সৈকতের সংস্পর্শে এসে নিজেকে সুখী জগতের একজন বাসিন্দাই ভাবছে।
আড়ংয়ের সামনে এসে রিকশা থামল। ভাড়া মিটিয়ে শেষে রুচিরা বলল- তোমরা নিচেই অপেক্ষা কর। আমি কাজটা সেরে আসি। কী বল পারমিতা?
মাথা কাত করে পারমিতা বলে- হ্যাঁ, ঠিক আছে।
রুচিরা সিঁড়িতে পা রাখে। অদৃশ্য হয়ে যায় ওদরে চোখে সীমানা থকে।
সৈকত পারমিতাকে বলে চলো, আমরা মার্কেটটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখি।
হ্যাঁ, মন্দ হয় না।
সৈকত ও পারমিতা এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। দু’জনার মাঝে কথাবার্তা খুবই কম হচ্ছে। সৈকতের ইচ্ছে হচ্ছে পারমিতার সাথে কথা বলার। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে তেমন কোনো ধারাবাহিকতা পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল। রুচিরা আসে নি এখনও। ওরা আবার হাঁটতে থাকে। দু’জন পাশাপাশি । এক সময় কোনো কথা খুঁজে পায় না সৈকত । আর পারমিতা তো সেই কখন থেকে চুপচাপ শুধু শুনেই যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোর সামনে এসে অপ্রয়োজনীয় অথচ মনোযোগী দৃষ্টি বুলাচ্ছে দু’জন। পেছন থেকে রুচিরা ডাকে। কাছাকাছি হতেই রুচিরা সহাস্যে বলে- আজ চাকরিটা কনফার্ম হল। সৈকত ও পারমিতা দু’জনই একসাথে বলে ওঠে কনগ্র্যাচুলেশানস্ ।
দু’জনের খুশীতে রুচিরার মনটা পুরোপুরি সুখী হয়। তারপর বলে- আজ সারাদিন তোমাদের নিয়েই ঘোরাঘুরি করবো। কি বলো, তোমাদের কারও আপত্তি নেই তো?
দু’জনই একসাথে বলে না।
রিকশা নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে আসে। দুপুরের খাবার পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিনেই খায়। তারপর সবুজ ঘাসের বুকে পেতে বসে চলে গল্পের পশরা। এখানেই সৈকত ও পারমিতা একজন অন্যজনের কাছে পরিচিত হয় নতুনভাবে । গল্পের ভেতরেই পারমিতা খুঁজে পায় মনের মানুষের আংশিক চেনা আঙিনা। আকাশ যেমন সবুজ প্রান্তকে ছুঁয়ে থাকে তেমনই দূরত্বে থেকেও সৈকত ছুঁয়েছে পারমিতার মনের বাগানকে । সন্ধ্যা নাগাদ ওরা টিএসসির দিকে পা বাড়ায়।
সৈকতের মনটা বিশেষ ভালো নেই। সৈকত, পারমিতার প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই ভেবেছিল সে যেমন পারমিতাকে নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে তেমনিই পারমিতাও । এই যে এখন, মনটা মেঘলা আকাশের মত তবু এখনও পারমিতার ভাবনায় সৈকত নিমগ্ন। পারমিতাকে নিয়ে ভাবতে পারার শুরুটা পেলেই সৈকত রাজা হয়ে যায়।
আচমকা পরিচয় । প্রথম দেখাতেই সৈকত সমুদ্রের গহীন ঢেউয়ে তলিয়ে যায়। একসময় নিজেকে আবিস্কার করে পারমিতা নামী মেয়েটির কৃষ্ণ-কালো গভীর চোখে। পারমিতাকে দেখার ইচ্ছেটা সময়-অসময় মানে না। প্রতিটি মুহূর্তকে সুসময় মনে করে সৈকত। অথচ সেই যে তিনজন সারাদিন একসাথে কাটিয়েছিল, তারপর পারমিতার আর পাত্তা নেই। পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেল। সৈকতের মনটা কেমন যেন চঞ্চলা হরিনীর মতো উদভ্রান্ত হয়ে আছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পারমিতার খোঁজে ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়েছে। এদিক-সেদিক অনেক খোঁজাখুঁজি। সবই অবশ্য মনে মনে। মনের মধ্যে এক অসহ্য যন্ত্রণার আগ্নেয়গিরি।
এদিকে আবার রুচিরাকেও খুঁজে নাগাল পাচ্ছে না সৈকত। বিমর্ষচিত্তে সৈকত লাইব্রেরি বারান্দায় বসে আছে। হাতে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ছে। দৃষ্টি নিঃসীম আনমনা। থেকে থেকে সিগারেটে দিচ্ছে লম্বা টান। আবার মনে মনে হেঁটে চলে যাওয়া লোকজনের ভীড়ে পারমিতাকে খুুঁজছে সৈকতের দুটি অস্থির চোখ। আশেপাশে সুখের অনুরণনকে বাতাসে ছড়াচ্ছে অজস্র সুখের নিঃশ্বাস। অথচ কোনকিছুই সৈকতকে স্পর্শ করছে না। চোখের জলসায় শুধু পারমিতার অবাধ বিচরণ। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে সৈকতকে দেখতে পেল রুচিরা। কাউন্টার থেকে ব্যাগটা তুলে নিল। এগিয়ে গিয়ে সৈকতের পাশে বসল কোন কথা না বলে। সৈকত টের পায় নি; গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। রুচিরা ইচ্ছে করেই অস্তিত্বকে জানান দিল গলা-খাকাড়ি দিয়ে। সৈকতের ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে। তারপর ভাবলেশহীন জিজ্ঞাসা- কখন এলেন।
অনেকক্ষণ! অথচ তুমি একটুও টের পাওনি। এত গভীর হয়ে কী ভাবছো?- বলতে বলতে রুচিরা সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না, এমনি। নির্দিষ্ট তেমন কিছুই না।- সৈকতের কণ্ঠে পাশ কাটানোর প্রয়াস।
রুচিরা বুঝতে পেরে কথার মোড় অন্যদিকে নিয়ে যায়, বলে- তারপর, এই ক’দিন তোমার যে দেখা পেলাম না?
সৈকত একটু আগ্রহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে- আমারওতো একই প্রশ্ন!
রুচিরার জবাব- যদিও আমি কিছুটা ব্যস্ত ছিলাম তবুও তোমাকে মনে মনে অনেক খুঁজেছি।
হলে গেলেই পারতেন।- সৈকত বশে অভিমান ভরা কন্ঠে বলল।
হলে যেতে আলসেমি ধরে যায়। তাছাড়া ব্যতিক্রম চত্বরে এসে খোঁজ নিয়েছিলাম। যাক তারপর বল তোমার খবর কি?
এই চলে যাচ্ছে।- এই বলে সৈকত প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
রুচিরা বলে আমার তো মনে হচ্ছে তুমি বেশ চিন্তিত আছ।
কথাগুলো শুনে সৈকত ভাবল হয়তো রুচিদি সৈকতের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে। তাই খুবই চঞ্চলচিত্তে সৈকত জানতে চাইলো- পারমিতারও ক’দিন ধরে দেখা পাচ্ছি না।
গত পরশু আমার সাথে দেখা হয়ে ছিল। গতকাল নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এটুকু বলে রুচিরা চুপচাপ বসে থাকে। সৈকত তাকিয়ে আছে রুচিরার দিকে। রুচিরা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার সৈকতের দিকে তাকাল। তারপর বলল গতকাল চাকরিতে জয়েন করে এলাম।
সাথে সাথে সৈকত দু’হাত জোড় করে দুঃখিত কণ্ঠে বলল ভুল হয়ে গেছে রুচিদি। আই অ্যাম অ্যাক্সট্রিমলি সরি!
না, না আমি তেমন কিছু মনে করিনি। রুচিরা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। তারপর কিছুটা আবেগঘন কণ্ঠে বলল তবে মনে মনে তোমাকে আশা করেছিলাম।
পড়ার পাশাপাশি চাকরি চালিয়ে যেতে পারবেন তো? এই বলে সৈকত উত্তরের প্রত্যাশায় তাকিয়ে রইল।
ওহো! বলতেই ভুলে গিয়েছি, পার্টটাম চাকরি! বিকেলে যেতে হবে। অতএব কোন সমস্যা হবে না।
তাহলে খুব ভালো হবে।
খুব ভালো হবে, কথাটা রুচিরার ভেতর কেঁপে উঠল। কিন্তু বাস্তবে তা একটুও প্রকাশ করল না। স্বাভাবিকভাবেই বলল চল, পারমিতাকে একটু খুঁজে আসি।
দু’জন ওঠে। ব্যতিক্রম চত্বর পেরিয়ে ওরা আর্টস বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে চলল। কিছুদূর এগোতেই পারমিতার রুমমেটের সাথে দেখা হয়ে গেল। রুমমেটের কাছে জানতে পেল; গতকাল বিকেলে দিদির বাসায় চলে গেছে পারমিতা। কারণ হঠাৎ করে শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল।
সৈকত রুচিরাকে জিজ্ঞেস করে রুচিদি, আপনার কাছে পারমিতার ফোন নম্বর আছে?
আছে।এই বলে পার্স থেকে ছোট নোটবুকটা বের করে খুঁজে বের করে সৈকতকে পারমিতার ফোন নম্বর দেয়।
তাহলে ফোন করে একবার খোঁজ নেয়া যায়, কি বলেন?
রুচিরা অল্পক্ষণ যেন ভাবল। তারপর বলল চল, সরাসরি চলে যাই। পারমিতার দিদির সাথেও দেখাটা করে আসি।
সৈকত এতটুকু আশা করে নি। তাই বাসায় যাবার প্রস্তাবটা শোনামাত্রই উৎফুল্লচিত্তে বলল হ্যাঁ, চলুন। সরাসরি গিয়ে দেখে এলেই ভালো হয়।
তাহলে চল, এখনই যাওয়া যাক।
সামনের দোকানটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে সৈকত আগুন ধরাল। কাছে আসতেই রুচিরা বলল সৈকত, তুমি কিন্তু সিগারেটের মাত্রা ক্রমশ বাড়িয়ে যাচ্ছ। এটা কোন ভাল লক্ষণ নয়।
দু’কানে হাত ছুঁয়ে সৈকত বলল ‘সরি রুচিদি, কমাতে চেষ্টা করবো।’ কথা বলার সাথে সাথে সারা মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ল দুষ্টুমি ভরা হাসি।
সৈকতের হাসিতে রুচিরার হালকা শাসন মিলিয়ে গেল। তারপর আবার বলল ‘ঠিক আছে, এখন একটা রিকশা নাও।
সৈকত এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক করল। চেপে বসল দু’জন। রিকশা চলতে শুরু করল। নিউ মার্কেট ওভার ব্রিজের কাছে রিকশা থামিয়ে সৈকত নেমে গেল। কিছু ফল কিনে নিয়ে ফিরে এল। রিকশা আবার এগিয়ে চলল। রিকশা যতই এগোচ্ছ সৈকত ততই অজানা আমেজের এক বিমুগ্ধ শিহরণে আলোড়িত হচ্ছে। বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা ডুবে ডুবে সৈকত এগিয়ে চলছে। পথে সৈকত এবং রুচিরা খুব কমই কথা বলেছে।
*
কলিংবেল টিপতেই পারমিতার দিদি এসে দরজা খুললেন। নমস্কারটুকু নিয়েই দিদি সরে দাঁড়ালেন। রুচিরা ও সৈকত ড্রয়িং রুমে এসে বসল। দিদি সৈকতের দিকে একপলক তাকিয়েই রুচিরার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রুচিরা বুঝতে পেরে সৈকতকে দিদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
সৈকত দাঁড়িয়ে দিদিকে নমস্কার জানাল। নমস্কার নিয়ে দিদি বললেন- তোমরা বসো। আমি আসছি।
রুচিরা বলল একটু আগেই খবর পেলাম পারমিতা অসুস্থ।
এখন একটু ভালো আছে।- এই বলে দিদি ভেতর ঘরে পা বাড়াল। পেছন গেল রুচিরা। যাবার আগে রুচিরা সৈকতকে বলল- তুমি বস। আমি একটু দেখে আসছি।
মিনিট দুয়েক পরেই ফিরে এসে রুচিরা সৈকতকে ভেতর ঘরে নিয়ে গেল।
পারমিতা ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে। রুচিরা এগিয়ে গিয়ে পারমিতার কোলের কাছে বিছানায় বসল। সৈকত ঘরে ঢুকেই লজ্জায় একটু যেন গুটিয়ে গেল। সম্মোহিতের মত ধীরপদে এগিয়ে গেল। দিদি কাজের মেয়েটাকে ডেকে বলল এই ঘরে একটা চেয়ার দিয়ে যায়।
সৈকত পারমিতার কাছকাছি হয়ে জিজ্ঞ্যস করল-এখন কেমন আছ, পারমিতা?
আড়ষ্টকণ্ঠে পারমিতা বলল এখন অনেকটা ভাল।
রুচিরার ভালোবাসার হাতটুকু পারমিতার কপাল থেকে ফিরে এল। তারপর গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল চিন্তা করো না, ভাই। ঠিক হয়ে যাবে।
পারমিতা জবাবে কোন কথা বলে না। শুধু শব্দহীন হাসি হাসল। সৈকত পারমিতার চোখে চোখ রাখল। পলকহীন মুহূর্ত। নির্বাক সময়ের কিছুক্ষণ যাত্রা। পারমিতার চোখ যেন সৈকতকে কাছে ডাকছে। সৈকত একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়। তারপর কাছাকাছি এগিয়ে আসে। তারপর পারমিতার কপালে একটা হাত রাখল। হাতটা ভেতরে ভেতরে অসম্ভব রকম কাঁপছে। তাপ দেখে হাত সরিয়ে নিয়ে এসে বলে- ঔষধ ঠিকমত খাচ্ছো তো ?
মাথা কাত করে হ্যাঁ বলে পারমিতা । অবশ্য ‘হ্যাঁ-এর বেশির ভাগ জবাবই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে চোখের এক জ্যোতির্ময় কারুকার্যে । রেখে যাওয়া চেয়ারটা টেনে সৈকত বসে। এই ফাঁকে দিদি অন্য ঘরে গেলেন, বলে গেলেন, তোমরা গল্প কর।
পারমিতা জড়ানো কণ্ঠে বলে রুচিদি আপনি নিশ্চয়ই চাকরিতে জয়েন করেছেন?
হ্যাঁ ভাই, গতকাল জয়েন করলাম।- হাসতে হাসতে রুচিরা জবাব দেয়।
প্রথমদিনের অনুভূতিটা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর, তাই না রুচিদি?- এই বলে পারমিতা রুচিরার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।
সত্যি খুবই ভালো একটা দিন গেল গতকাল। কথার মধ্যে রুচিরার সবটুকু সুখ ছড়িয়ে পড়ল।
রুচিদি আপনি বেতন পেলেই আমাদের চাইনিজ খাওয়াবেন কিন্তু।- সৈকত রুচিরাকে বলে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তোমরা ছাড়া ক্যাম্পাসে আমার আর কে আছে? রুচিরা বেশ উৎফুল্লচিত্তেই বলে কথাগুলো।
নাস্তার ট্রে হাতে কাজের মেয়েটা এলো। পেছন পেছন এলো দিদি। ওদের সাথে দিদিকেও দু’এক টুকরা আপেল এবং মিষ্টিও খেতে হল। রুচিরা নিজ হাতে তুলে পারমিতাকে খাইয়ে দিল।
চা-পর্ব শেষ করে রুচিরা ঘড়ির দিকে তাকাল। একটা বেজে কুড়ি মিনিট। কিন্তু কিছু বলার আগেই দিদি বললেন ভাই ঘড়ি দেখে কোন লাভ হবে না। দুপুরে তোমরা খেয়ে যাবে। রুচিরার সাথে সাথে সৈকতও ‘না-না’ করছিল।
দিদি হালকা আদুরে ধমক দিয়ে বললেন তোমরা কোন কথা বলো না।
রুচিরা বলে দিদি, আমাকে অফিসে যেতে হবে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল এমনভাব নিয়ে দিদি বললেন সরি, আই অ্যাম রিয়্যালি সরি। তোমার চাকরির কথা পারমিতা বলেছিল। অথচ তোমাকে একবারও জিজ্ঞেস করলাম না। একটুক্ষন থেমে দিদি আবার বললেন ভালো, খুব ভালো। মেয়েরা আজকাল অনেক সাহসী হচ্ছে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। তোমার অফিস ক’টায়?
বিকেল চারটা হতে সন্ধ্যা আটটা নাগাদ।
তাহলে তো খুবই ভালো হল। দুপুরে এখানে খাবে। বিশ্রাম নেবে। তারপর অফিস যাবে এখান থেকেই।
রুচিরা আমতা আমতা করছিল।
দিদি রুচিরাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তোমাকে আমি এত সাধতে পারবো না। বসে বসে গল্প কর, আমি আসছি আর কোনরকম জবাবের জন্য অপেক্ষা করলেন না দিদি।