ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-০৪]

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-০৪]

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-০৪]

পার্থসারথি

সৈকত স্নান শেষে তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করে। রুমের ভেতর কয়েক কদম ফেলতেই হঠাৎ চোখ পড়ে পারমিতা ও রুচিরার ওপর। সৈকত আর্শ্চয হয়ে মুহূর্ত সময় থমকে দাঁড়ায়। খালি গা-টুকু তোয়ালে দিয়ে ঢেকে নেয়। তারপর কাছে এগিয়ে এসে সৈকত বলে- কী ব্যাপার রুচিদি হঠাৎ এভাবে এলেন যে? কথাগুলো রুচিরাকে বললেও পারমিতার দিকেও এক পলক তাকায়।

রুচিরা কিছুই বলে না। মিটিমিটি হাসে। রুচিরার হাসি পারমিতার মাঝেও ছড়ায়। পারমিতা এই প্রথম কোন ছেলে হলে এল। বেশ আড়ষ্টভাব জড়িয়ে  আছে ওর মাঝে। সৈকত এক ফাঁকে ভেজা লুঙ্গিটা রোদে ছড়িয়ে দিল। তারপর একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে চেয়ার টেনে কাছাকাছি হয়ে বসল। সৈকত তাকিয়ে আছে রুচিরার দিকে কিছু একটা শুনবার প্রত্যাশায়। রুচিরা কিছুক্ষণ রহস্য করল। সৈকত তো তাকিয়েই আছে; আঁড়াচোখে তাকাতেই পারমিতার চোরা দৃষ্টি ধরা পড়লো। পারমিতা গুটিয়ে গেল লজ্জায়।

রুচিরার দু’চোখ ঘরময় ঘুরে ঘুরে এসে বলল, তোমরা ছেলেরা এত অগোছালো থাক কেন?- এই বলে- দেয়ালের কোণায় কোণায় জমে থাকা মাকড়সার ঝুল, আলনায় পড়ে থাকা এলোমেলোভাবে জামা কাপড়ের  ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে আসে বিছানায় ওপর। রুচিরা আবার বলে- এসব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রেখো। রুচিরা উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে পারমিতা বিছানাটা একটু গোছগাছ করে দাওতো।

রুচিরার কথায় পারমিতার চোখ-মুখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। পারমিতা বিছানায় হাত দিতেই সৈকত ‘না, না ’ বলে পারমিতাকে ফেরাতে যায়। রুচিরা হালকা ধমকের সুরে বলে সৈকত সরে দাঁড়াও। বিছানাটা একটু গুছিয়ে দিক।

রুচিরার কথামত সৈকত একটু সরে দাঁড়ায়। পারমিতা বিছানা গোছাতে থাকে।

রুচিরার শেষ কথাটায় অনিকের ঘুমের রেশটা কেটে যায়। অনিক ফিরে তাকায়। রুচিরার চোখ চোখ পড়ে। রুচিরাই প্রথমে কথা বলে সরি অনিক তোমার ঘুমে ডিস্টার্ব করলাম বলে।

অনিক ঘুম জুড়ানো চোখেই উঠে বসে এবং বলে- না, না কোন অসুবিধা হয়নি। এখনই উঠতাম। কখন এসেছেন? একদমই টের পাইনি। তারপর পারমিতার দিকে তাকিয়ে অনিক বলে কেমন আছেন?

পারমিতা বলে আমি ভালো আছি। আপনার তো আর দেখাই পেলাম না।

কথা কেড়ে নিয়ে সৈকত বলে ও সারাদিন লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

রুচিরা প্রসঙ্গ পাল্টে বলে অনিক আজ কি তোমার কোন কাজ আছে?

টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আছে একটা দিদি। – এই বলে অনিক বলে সৈকত আমি নিচ থেকে একটু আসছি। আবার বের হয়ে যাস না কিন্তু?

সৈকত বলে ঠিক আছে, একটু তাড়াতাড়ি আসিস।

রুচিরা বুঝতে পেরে বলল অনিক, এখন কিছুই খাব না। বসো, কিছু আনতে হবে না।

সৈকত বলে ঠিক আছে, অল্প কিছু নিয়ে আয়।

রুচিরা না, না  করছিল কিন্তু অনিক কোন কথাই শুনল না। দরজা পেরিয়ে আড়াল হয়ে গেল।

রুচিরা  সৈকতকে ডেকে বলে ঝটপট তৈরি হয়ে নাও।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে সৈকত তাকায় ।

রুচিরা বলে আগে তৈরি হয়ে নাও। এখন কিছুই বলছি না।

সৈকত আলনার আড়ালে চলে যায়। পারমিতা এতক্ষণ চুপচাপ বিছানা গোছাচ্ছিল। বিছানা গোছানো শেষ করে টেবিল হাত দিল। রুচিরা বিছানায় এক কোণে বসল। টেবিলের এলোমেলো বই-খাতা সব পারমিতা গুছিয়ে তারপর চেয়ারটা টেনে বসল।

অনিক একটি পিচ্চিসহ রুমে ঢুকল। পিচ্চির হাতে বিস্কুট, কলা এবং একটা ডেনিস কৌটায় চা। চানাচুরের প্যাকেটটা অনিক টেবিলে রেখে একটা বড় সাইজের বোতল এবং দুটো গ্লাস পিচ্চিটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল ভালো করে ধুয়ে তারপর পানি নিয়ে আসবি।

পিচ্চিটা এক দৌঁড়ে বাইরে চলে যায়। সৈকত প্যান্ট-শার্ট পরে সামনে  এগিয়ে আসে। অনিককে ডেকে কাছাকাছি নিয়ে বসে। যখন সৈকত চানাচুরের প্যাকেটটায় হাত দেয় তখন অনিক  ডেনিস কৌটা থেকে চা গ্লাসে ঢেলে রুচিরা ও পারমিতার দিকে এগিয়ে দেয়। পারমিতা বলে আপনারা আগে খান, আমরা পরে খাই।

রুচিরা হাসতে হাসতে বলে আরে আমরা হলাম গেস্ট । কি বল অনিক?

অনিক কথাটিতে বেশ মজা পেয়ে যায়। তারপর হাসিমুখেই স্পষ্ট অথচ প্রাণোজ্জল কণ্ঠে বলে  ঠিকই বলেছেন দিদি। আগে গেস্ট তারপর হোস্ট।

*

দরজার বাইরে পা বাড়িয়েই  সৈকত ঘড়িতে তাকায়। দশটা বাজে। অনিক দরজায় দাড়িঁয়ে থেকেই বলে- দিদি আবার আসবেন কিন্তু। রুচিরা ও পারমিতা একই সাথে বলে ওঠে- হ্যাঁ আসব।

কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরির পর ওরা একটা নাগাদ রিকশা নিয়ে সোজা নীরব হোটেলে চলে এল। নীরব হোটেলটা চাংখারপুল পেরিয়ে নাজিমউদ্দীন রোড়ে। পুরনো ঢাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই এখানে বেশি আসে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম খাবারের সমাহার এবং দামেও বেশ সস্তা। ঢাকা শহরে এত সস্তায় এমন রুচিশীল খাবার পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এত ভিড়।

ভিড় থাকা সত্ত্বেও এক কোণের টেবিলে ওরা জায়গা পেয়ে গেল। চেয়ারে বসতে বসতে রুচিরা বলে- কি কি অর্ডার দেব, তোমরা বল।

সৈকত উত্তরে বলে- আজকের পুরো দিনটাই আপনার হাতে ছেড়ে দিলাম।

রুচিরা সৈকতের কথাতে বেশ খুশি হয়ে বলে- আচ্ছা ঠিক আছে, তবে তোমাদের পছন্দের বিশেষ কিছু বাদ পড়ে গেলে অবশ্যই কিন্তু বলবে।

সৈকত হাসতে হাসতে বলে আপনার কাছে যদি লুকিয়ে রাখি তাহলে কি চলবে? তারপর সৈকত বয়কে ডেকে বলে- মামু, এদিকে আসেন।

বয় যেন ডাকের অপেক্ষায় ছিল। ডাক দেবার সাথে সাথেই চলে এল।

বয় কাছে আসতেই রুচিরা অর্ডার দেয়- সব রকমের ভর্তা এবং ভাজি, শুকনা মাছের ভর্তাও বাদ যায়নি।

মাংসের কথা বলতেই সৈকত মৃদু আপত্তি তুলে বলে আজ মাছ-মাংস বাদ শুধু শাকসবজি আর ভর্তা, কি বল পারমিতা?

দিদি অর্ডার দিচ্ছেন যেহেতু আজকে অন্তত মিশালীভাবেই চলুক।

ওকে, র্অডার পাস হয়ে গেল। – এই বলে সৈকত হাসে।

কাঁটায় কাঁটায় তিনটেয় ওরা হোটেলের বাইরে এলো। হোটেল গেটের পাশের দোকান থেকে তিনজনই মিষ্টি পান খেলো। তারপর রিকশা  নিয়ে জাতীয় জাদুঘরে চলে এল। রুচিরা এর আগেও একবার এসেছে। আবার দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে । সৈকত গত দু‘বছরে জাদুঘরে একবারও  উকি দেয়নি। জাদুঘর দেখেছে কিনা জিজ্ঞ্যস করতেই লজ্জায় লাল হয়।

পারমিতা বলে ‘আমিও যাই নি।

রুচিরা পারমিতাকে বলে ‘তুমি তো মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে । হয়ত ক্যাম্পাসের মোহেই এখনও আবিষ্ট হয়ে আছো। সৈকতের এতদিনে আসা উচিত ছিল। কত দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে জাদুঘর দেখতে। আর আমরা কাছে থেকেও খোঁজ নিই নি। এটা কিন্তু ঠিক না। আমাদরে সবসময় উচিত নিজেদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্কে জানা। তাছাড়া এগুলো আমাদরে একদম পাশ।

সাড়ে তিনটা নাগাদ ওরা জাদুঘরে ঢুকে সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। কোনটা কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, কে ব্যবহার করত, কে মালিক ছিল। কত সালের জিনিস । মোট কথা সব সূত্রই লেখা আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে দেখে নিল। সাড়ে ছয়টা নাগাদ ওরা বেরিয়ে এল জাদুঘর থেকে। তারপর রিকশা নিয়ে বেইলি রোড়, নাটকপাড়ায়।

রিকশা থেকে নেমেই সৈকত রুচিরাকে বলে রুচিদি, নাটক দেখে ফিরতে ফিরতে দশটাও বেজে যেতে পারে। আপনাদেরতো হলে ঢুকতে দেবে না।

রুচিরা উত্তরে বলে ‘অ্যাপ্লিকেশন করে পারমিশন নিয়েই এসেছি। কোন অসুবিধা হবে না।

সবকিছু তাহলে আগেই প্লান করে রেখেছিলেন?

রুচিরা মিষ্টি হেসে বলে- মোটামুটি।

নাটক শেষ হলো রাত সাড়ে নয়টায় । রুচিরা ও পারমিতাকে হলে পৌঁছে দিয়ে সৈকত হলের দিকে চলল। রিকশা চলছে বাতাসের উল্টোদিকে। ফুরফুরে বাতাস সৈকতের মনটাকে আরও সজীব করে তুলল। খোশমজোজের  আমেজের সৈকত  গানে সুর মেলাচ্ছে। আজ সত্যিই আনন্দের দিন। পারমিতাকে খুবই কাছে পেয়েছে এবং মনে হয়েছে পারমিতার খুবই কাছের জন। রিকশা কখন হল গেইট চলে এল সৈকত একদমই টের পায়নি। রিকশা থামতেই ভাবনায় যতি রেখা পড়ল।

রুমে ঢুকতেই অনিক, সুমন্ত ও আসিফ একসাথে বলে উঠল – কনগ্র্যাচুলেশন।- এই বলে সবাই হাত বাড়িয়ে এসে হাত মেলায় এবং বুকে মেলায় বুক। সৈকত চুপচাপ দাঁড়িয়ে । সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। অবাক দৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথমে আসিফ বলে ওঠে- অবাক হচ্ছো কেন বন্ধু? ডুবে ডুবে জল খেলে কী হবে? এখন ওপেন সিক্রেট। এত বড় সুখবরটা পেয়ে ভাবলাম বন্ধুটির সাথে দেখাটা করেই যাই। কি ঠিক করি নি?

আসিফের কথায় সবাই হাসতে হাসতে সৈকতকে ধরে মাথার ওপর তুলে ফেলল। কতক্ষণ পর সৈকতকে বিছানায় পুতুলের মত ফেলে দিল। তারপর সুমন্ত সবার উদ্দেশ্যে বলে আজ রাতটা শুধু আনন্দের, আনন্দের আর আনন্দের ।- এই বলে আসফি পকেট থেকে একটা পুটলা বের করে সৈকতকে দেখায়।

সৈকত উঠে বিছানায় বসতে বসতে বলে- শুকনাটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না।

আসিফ জোর গলায় বলে ‘আজ অন্তত ক্ষমা নেই।

আসিফের কণ্ঠে অন্যরাও কন্ঠ মেলায়।

অনিক নিচে গিয়ে মুড়ি আর চানাচুর নিয়ে আসে। তারপর সবাই ছাদের উপর ওঠে। জোছনার আলোয় চারদিকে আলোকিত আকাশে লক্ষ তারার ঝিকমিক। চারদিক আলোকিত। সৈকতের মনটা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় তারকালোকিত আকাশে। গাঁজা টেনে সবাই একটু  আধটু নেশাচূড় হয়। কিন্তু সৈকত নিজেকে সামলাতে পারল না। ছাদের উপর শুয়ে পড়ল। আর দৃষ্টি মেলে দিল নীল আকাশের অসীমে।

সময় গড়িয়ে যায়। প্রতিটিক্ষণ চলে ঋতু-বদলের হামাগুড়ি। পাল্টে যায় বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। জীবনে ঘটে যায় যোগ অথবা বিয়োগের  পালা। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে আজ সৈকত ও পারমিতা খুবই কাছাকাছি । একজন অন্যজনের ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন। পারমিতাবিহীন মূর্হূত সৈকত ভাবতে পারে না। আর পারমতিার ভাবনার বিস্তীর্ণ জাল শুধু সৈকতকে নিয়ে। ফাইনাল পরীক্ষা আর বেশিদিন বাকি নেই। এখন ওরা লেখাপড়া নিয়ে বেশ ব্যস্ত। প্রায় সারদিনই একসাথে লাইব্রেরিতে লেখাপড়া করে। কারণ ক্লাস সাসপেন্ড হয়ে গেছে। পরীক্ষা খুবই কাছাকাছি। ওদের লেখাপড়া চলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। তারপর ঘন্টাখানেকের জন্য বাইরে বেরিয়ে আসে। দুপুরে খাওয়াটা ডাকসু ক্যাফেতেই চলে। দু’জন একান্তে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে। আবার লাইব্রেরিতে ফিরে আসে। গৌধূলী বেলায় আবার বাইরে বেরিয়ে আসে। পরপর চলে কয়েক কাপ চা। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি আবার লাইব্রেরিতে খোশ মেজাজে ফিরে আসে এবং লেখাপড়া চলে লাইব্রেরি যতক্ষণ খোলা থাকে।

লাইব্রেরির দোতলার পূর্বদিকের রুমের এক কোণের টেবিলে ওরা বসেছে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা চলে । হয়তো দেখা গেল পারমিতার একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ফাঁকে অন্য কথা শুরু হয়ে যায়।

এখন শেষ বিকেল। একটু পরই ওরা বাইরে বেরিয়ে আসবে। পারমিতা যে প্রশ্নটা ধরেছিল সেটি মোটমুটি শেষ হয়ে গেছে। এখন একটা বই নেড়ে চেড়ে দেখছে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সৈকতের দিকে তাকাল। সৈকত গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। টেবিলে কনুই গেঁড়ে হাতের তালুতে মুখ গুজে পারমিতা দৃষ্টিহীন পলকে সৈকতের মনে প্রশ্ন জাগায়। ফিরে তাকায় সৈকত। পারমিতা পলকহীন । না হেসে পারল না সৈকত। শব্দহীন হাসির রেশ টেনেই সৈকত জিজ্ঞেস করে- কী ব্যাপার, লেখাপড়া রেখে আমাকে ওভাবে দেখার কী আছে?

আমার পড়া শেষ।

শেষ মানে?

শেষ মানে শেষ। যে প্রশ্নটা ধরেছিলাম পড়া হয়ে গেছে।

তাই বলে চুপচাপ বসে থাকবে? অন্য একটা প্রশ্ন ধরো।

এখন আর ভালো লাগছে না। চায়ের নেশা চেপে বসেছে।

আর দশ মিনিট, তাহলেই উঠতে পারবো।

লক্ষীটি একটু চুপচাপ বস।

আমি কি দুষ্টুমি করছি নাকি?

তুমি শুধু দুষ্টমিই করছ না, আমার মনটা নিয়ে লোফালুফি করছ। এমন করলে কি আর সুস্থির থাকা যায়।

পারমিতা এক গাল হেসে বলে আমি তোমার মন নিয়ে খেলবো না তো আরেকজনের মন নিয়ে খেলবো ?

সৈকত একটু দুষ্টমি ভরা কণ্ঠে বলে- তুমি কি আর কারও মন নিয়ে খেলতে চাও?

পারমিতা হাত জোড় করে চোখ টেনে বলে মাফ চাই এক মন নিয়ে খেলা করেই পেরেশান। মনের পরিধি যে এত ব্যাপক এবং গভীরতা কখনও কল্পনা করিনি।

চোখে চোখ রেখে সীমাহীন দৃষ্টিতে সৈকত তাকিয়ে থাকে।

পারমিতা বলে থাক,ওভাবে তাকিও না, তাহলে মরে যাব। এত গভীরে গিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। তুমি তোমার পড়া শেষ কর। আমি চুপচাপ বসছি। এই বলে পারমিতা সুবোধ বালিকা হয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

কিন্তু সৈকতের দৃষ্টি সীমা থেকে নিজেকে সরাতে পারছে না। এক পলক অন্যদিকে তাকায় তো এক মায়াময় গভীর টানে আবার ফিরে আসে। দু’জনার দৃষ্টি এক হয়। পলকহীন দৃষ্টি সৈকতের। দৃষ্টির গভীর টানে পারমিতা মোহাচ্ছন্ন হয়ে যায়। হাঁটিহাঁটি পা পা করে সৈকতের হৃদয়ের গভীর অন্ধকূপে পৌঁছে যায় পারমিতা। অন্ধকারের অলি-গলি হেঁটে বেড়াতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। পারমিতা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে সৈকত, তোমার দৃষ্টির গভীরতা কমিয়ে নাও। আমি একটুও স্থির থাকতে পারছি না।

সৈকত চুপচাপ। পারমিতা সৈকতের হাত চেপে ধরে বলে- তোমার দৃষ্টিজাল থেকে বের হওয়ার মত শক্তি আমার নেই। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কথা বলতে গিয়ে পারমিতার ঠোঁট জোড়া অসম্ভব রকম কেঁপে ওঠছে।

পারমিতার হাতে হাত রেখে সৈকত এক গাল হাসে। একটা র্দীঘ নিঃশ্বাসে পারমিতা শান্ত হয়। তারপর চোখ ঠেড়ে সৈকত বলল- কী কেমন হলো?

পারমিতার জবাবের অপেক্ষা না করে বইপত্র গুছিয়ে সৈকত উঠে দাঁড়ায় এবং বলে- চল, নিচ থেকে ঘুরে আসি।

শব্দহীন পারমিতা সৈকতের সাথে নিচে নেমে আসে। দু’জন এসে বসে হাকিম চত্বরে । চা শেষে সৈকত যখন সিগারেট ধরায় তখন পারমিতা বলে তুমি বস, আমি এক্ষুণি আসছি।

কোথায় যাচ্ছো?

রুমে যাব।

মাথা নেড়ে সৈকত হ্যাঁ-সূচক জবাব দেয়। পারমিতা হেঁটে চলে হলের দিকে। সৈকত সিগারেটে দেয় লম্বা টান। তারপর পারমিতার জন্য অপেক্ষা। পারমিতা ফিরে এল দশ মিনিটের মধ্যেই। পারমিতার হাসিমাখা মুখ যেন একরাশ কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে আছে। কাছাকাছি হতেই সৈকতের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় মোচড় কেটে ওঠে। তারপর অধীর আগ্রহে সৈকত জিজ্ঞেস  করে-  পারমিতা, তোমার কী হয়েছে, তোমাকে  এমন দেখাচ্ছে কেন?-  বলে পারমিতাকে নিয়ে হেঁটে চলে লাইব্রেরির দিকে। পারমিতা একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয় সৈকতকে। চিরকুটে চোখ মেলে ধরল সৈকত- পারমিতা , তোমার খোঁজে এসেছিলাম। না পেয়ে লিখে যাচ্ছি। সংবাদ পাওয়া মাত্রই বাসায় চলে আসবে। অতি জরুরি । অবশ্যই আসবে।- দাদাবাবু , তাং : ১৩.০৭. ১৯৯৮।

চিরকুটটি পারমিতার হাতে দিতে দিতে সৈকত বলে কোন দুশ্চিন্তা করো না। বাসায় তাড়াতাড়ি যাও। পারমিতা নীরব। সৈকত আর কথা বাড়ায় না। বইপত্র জমা দিয়ে, কাউন্টার থেকে ব্যাগটা তুলে সৈকত ও পারমিতা রিকশায় চেপে বসে। সৈকত বাসায় যায় নি। পারমিতাকে নামিয়ে দিয়ে ওই রিকশাতেই ফিরে আসে।

*

প্রভাময়ী দেবী। পারমিতার মা। সংবাদ পেয়েই তিনি গত সন্ধায় এসেছেন। ছেলে পাপ্পুকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন। পারমিতার দাদাবাবু অভীক মজুমদারের বাড়ি থেকে কেউ আসে নি। কারণ ওদের আর কেউ এখন বাংলাদেশে থাকে না। গত বছর সবাই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে।

প্রভাময়ী দেবী ঘরের এমাথা-ওমাথা পায়চারি করছেন। আর মাঝে মাঝে মনের অজান্তেই টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছেন। সেই দুপুর থেকে মেয়েটার ব্যথা ওঠেছে । নরমাল ডেলিভারি হল না। শেষ বিকেলে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সুদেষ্ণা মা-বাবার প্রথম  সন্তান। তাই প্রভাময়ী দেবী খুবই আকুলচিত্তে অপেক্ষা করছেন সুসংবাদ পেতে। তিনি বেশ চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। কারণ ব্যথাটা  বেশিই হয়েছিল। জামাই বুঝাল- মা, চিন্তা করবেন না। নরমাল ডেলিভারি না হলে সিজার করাবো। আজকাল আধুনিক চিকিৎসা । কোনরকম অসুবিধা হবে না। আপনি বাসায় থাকুন। পাপ্পু আর আমি যাচ্ছি।

যাওয়ার আগে প্রভাময়ী দেবী ছেলে পাপ্পুকে বারবার বলে দিয়েছেন- আমার মেয়েটার অবস্থা জানিয়ে কতক্ষণ পরপরই ফোন করবি।

সেই যে বিকেল বেলা ওরা গেল এই পর্যন্ত কোন সংবাদ জানায় নি। কাজের মেয়েটা কতক্ষণ পরপরই এসে বলছে- জেঠীমা, চিন্তা কইরেন না। কুনু অসুবিধা অইব না। আমার মনে হয় হেরা খুব ব্যস্ত আচে। হের লাইগ্যা ফুন করতে পারতেছে না। আফনে চেয়ারে বইন শইলডা ঠান্ডা অইব।

কাজের মেয়েটা আপন মনে কথা বলেই যাচ্ছে। আর প্রভাময়ী দেবী নিজের  আপন ভুবনে ডুবে আছেন গভীর চিন্তায়। চিন্তাক্লিষ্ট মনে শুধুই পায়চারি করছেন। কলিং বেলটা বেজে ওঠতেই কাজের মেয়েটা রীতিমত দৌড়ে যায়। প্রভাময়ী দেবীও পায়চারি থামিয়ে এগিয়ে যান। পারমিতা ঘরে পা ফেলতেই প্রভাময়ী দেবীর উৎকণ্ঠচিত্তে জিজ্ঞাসা করনে- এতক্ষণে এলি মা?

পারমিতা কিছুটা ভড়কে যায়। কারণ মা এসেছেন সে খরব পায় নি পারমিতা। মাকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা বলে আমি একটু আগেই খবর পেলাম। খবর পেয়েই সরাসরি চলে এলাম। মা, দিদি ওরা কোথায় ? কাউকে দেখছি না কেন?

তোর দিদিকে নিয়ে ওরা হাসপাতালে গিয়েছে।

হাসপাতালে? দিদির কী হয়েছে মা? আমি কিছুই জানতে পেলাম না।- পারমিতার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমে গেছে। পারমিতা জানত যে ওর দিদি গর্ভবতী। তবে ডেলিভারির ডেটটা  তো আরও সপ্তাহখানেক পর। তাই এ কথাটা মাথায় একদমই আসে নি। মার কথাটা শোনার পর বেশ হালকা লাগছে নিজেকে। তারপর মাকে আরও জড়িয়ে ধরে বলে- মা, তোমার নাতি হবে না নাকি নাতনী ?

মেয়ের কথায় প্রভাময়ী দেবী যেন একটু আনন্দিত হলেন। ভেতরের হাহাকার যেন অনেকটা হালকা হয়ে গেছে।প্রভাময়ী দেবীর মুখমন্ডলে উজ্জ্বল ছায়া আচমকা খেলে গেল। তারপর সোহাগী কণ্ঠে বলেন- কোনটিতেই আমার মন খারাপ হবে না। যা হবে তাতেই আমি সুখী।

পারমিতা খুশিতে আটখানা হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে থেকেই বলে মা এর জন্যেই আমি তোমাকে খু-উ-ব ভালোবাসি।

প্রভাময়ী দেবীর উজ্জ্বল  মুখখানা মূহূর্তেই আবার চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে গেল। মেয়েটার যে কী হলো কিছু জানতে পেলাম না। বারবার বলে দিলাম ফোন করিস । না, আর একদম ভালো লাগছে না। কথা বলতে বলতেই  কণ্ঠস্বরটা কেমন ভারী হয়ে এল প্রভাময়ী দেবীর।

কোন হাসপাতালে গিয়েছে, বলেেছ কিছু ?- পারমিতা মাকে জিজ্ঞেস  করে।

না-রে মা! আমাকে ওরা কিছুই বলে যায় নি।- এই বলে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন প্রভাময়ী দেবী। পারমিতা  কাছাকাছি হয়ে বসল। প্রভাময়ী দেবী পারমিতাকে কাছে টেনে নিলেন। তারপর প্রায় কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন- মেয়েটা আমার কী যে কষ্টটা করল সারাদিন। এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানতে পারছি না।

পারমিতা সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে মাকে বলে- মা, কোন দুশ্চিন্তা করো না। ডেলিভারি কেস আজকাল কোন ব্যাপারই না।

প্রভাময়ী দেবী সন্দেহপ্ররণ দৃষ্টি নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন ঠিক বলছিস তো মা?

মাকে গলায় জড়িয়ে ধরে পারমিতা বলে- হ্যাঁ মা, তোমার সাথে আমি কখনও মিথ্যা বলি?

মেয়ের কথায় প্রভাময়ী দেবী অনেকটা শান্ত হলেন। পারমিতার ভেতর ঘরের দিকে পা বাড়াল।কাজের মেয়েটা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের কথাই শুনছিল। পারমিতাকে আসতে দেখেই  সরে গেল। পারমিতা এগিয়ে গিয়ে বলে ‘রান্না-বান্না সব করে রেখেছিস তো?

না দিদি, এখনও কিছুই রান্না করি নি।

বসে থাকলে চলবে? খাবার রেড়ি করে রাখ।- এই বলে পারমিতা মায়রে কাছাকাছি এসে বলে মা দাদাবাবু তো একটু পরেই আসবে। কিন্তু কিছুই তো রান্না করা হয় নি। পারমিতা ভাবে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলে কিছুক্ষণের জন্য মনটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকবে।

মা তোমার হাতের রান্না দাদাবাবুর খুব পছন্দের। ওঠ মা, দাদাবাবু পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরবে। মাকে রীতিমত টেনেই তুলল। মা রান্নাঘরের দিকে গেলেন। পিছু পিছু কাজের মেয়েটাও। পারমিতা ক’দিন পরপরই বাসায় চলে আসে । কিছুদিন থাকে, তারপর আবার হলে চলে যায়। তাই কিছু জামা কাপড় এবং বইপত্র বাসাতে সবসময়ই থাকে।

জামা কাপড় পাল্টিয়ে পারমিতা বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়, এমন সময় টেলিফোনটা বেজে ওঠে। পারমিতা রীতিমত দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন রিসিভার তুলল। প্রভাময়ী দেবীও ছুটে এলেন। পারমিতা কথা বলছে। প্রভাময়ী দেবী মনোযোগ দিয়ে মেয়ের কথাবার্তা শুনছেন। কিন্তু ওপার থেকে কি বলছে তা তো তিনি শুনতে পারছেন না। তাই চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা জড়িয়েই আছে।

টেলিফোনটা রেখেই পারমিতা মাকে বলে- মা কোন চিন্তা করো না। ভাল একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছে। ওরা অনেকক্ষন চেষ্টা করেছে। নরমালি হবে না। অপারেশন করবে। একটু পরই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। প্রভাময়ী দেবীর পায়চারি আবার বেড়ে গেল। কয়েক চক্কর মায়ের পিছু পিছু পারমিতাও হাঁটল। তারপর খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বলে- মা, অপারেশন শেষ হলেই পাপ্পু ফোন করে চলে আসবে।

প্রায় দেড় ঘন্টা পর ফোন বেজে ওঠল। পারমিতা দৌড়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলল। ওপার থেকে পাপ্পুর কণ্ঠে উচ্চারণ- দিদি, ভাগনী হয়েছে। দেখতে খুবই সুন্দর। বাচ্চা বেশ সুস্থই আছে। দিদিও  সুস্থ আছে। আমি এক্ষুণি আসছি। রাখলাম।

টেলিফোন রেখেই পারমিতা প্রভাময়ী দেবীকে জড়িয়ে ধরে খুশীর খবরটি জানাল। প্রভাময়ী দেবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত হয়ে বসলেন।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
স্বাক্ষর

স্বাক্ষর

জোবায়ের রাজু সাত সকালে মায়ের বাড়ি কাঁপানো চিৎকার শুনে আমাদের চোখ থেকে ঘুম নিমিষেই পালিয়ে গেল। কোন অঘটন ঘটেছে কিনা, সেটা পর্যবেক্ষণ করতে আমি আর ...
বাংলার রূপ

বাংলার রূপ

 ইমরান হোসাইন   এই বাংলায় হয়েছিল যে দেখা কথা ছিল হবে আবার দেখা , এই বাংলা রয়ে যাবে চিরকাল তুমি রবে না একা । আবছা ...
পাহাড়িয়া 

পাহাড়িয়া 

বিরহের কবিতা – নিবেদিতা চট্টোপাধ্যায়    খেলা শেষ করে বসে আছি, পাহাড়ের ছায়ায় তোমার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে  লেকের জলে পড়ে আছে রোদের নেকলেস.. জানালায় ...
হৈমন্তিকা

হৈমন্তিকা

অশোক কুমার পাইক হেমন্তেরই পরশ আজি লাগলো বুঝি গায়ে প্রকৃতিটা জাগলো হেসে রঙিন রাঙা পায়ে, শিউলি ফুলের গন্ধে ভরে ধরার ধুলার পরে ঘাসের মাথায় শিশির ...
আগমনী প্রেমকথা

আগমনী প্রেমকথা

মহীতোষ গায়েন আশ্বিনের মাঠে মাঠে আগমনী বার্তা পৌঁছায়… শারদ হাওয়া এসে কানে কানে বলে – শান্তি, শ্বেতশুভ্র কাশের ছোঁয়ায় শিহরিত তনুমনপ্রাণ, সরীসৃপের মত এঁকেবেঁকে ভালোবাসা ...
মুখোমুখি - নাইমুল ইসলাম ইভু

মুখোমুখি – নাইমুল ইসলাম ইভু

নাইমুল ইসলাম ইভু পাশাপাশি বসে থাকা… অথচ ; কোন কথা নেই আমাদের নিরবতা বিরাজ করছে দু’জনায়, আগের মতো আঙুল ছোঁয়া হয় না- কাঁধে মাথা রেখে ...