ভালো আছো, মধ্যবিত্ত!

ভালো আছো, মধ্যবিত্ত!

গৌতম সরকার

এ এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে পথ চলা, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে যাতনা সহ্য করছে কিন্তু মধ্যবিত্তদের ভোগান্তি একটা অন্যমাত্রায় পৌঁছে গেছে। কোভিড-সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি ধনীদের ভোগব্যয় কমাতে না পারলেও সঞ্চয়ে বড়সড় থাবা বসিয়েছে। গরীবদের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তরফে খাদ্য-নিরাপত্তা প্রকল্প, দুয়ারে সরকার, লক্ষী ভান্ডার, কন্যাশ্রী, ঋণ মকুব ইত্যাদি প্রকল্প আছে, কিন্তু মধ্যবিত্তের হাতে হ্যারিকেন ছাড়া আর কিছুই নেই, কেরোসিনের দামবৃদ্ধির কারণে সেই হ্যারিকেন জ্বালানোর ক্ষমতাও তারা হারাতে বসেছে। ২০০৪ সালে বিজেপি দেশের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে টার্গেট করে তাদের ইলেকশন ইস্তাহারে অনেক কিছু প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়েছিল, তাদের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত ভোটার ভোটদানে অংশগ্রহণই করেনি। তারপর থেকে বিজেপি তাদের টার্গেট বদলে গরিব ভোটারে মনোনিবেশ করেছে কারণ তাদের বোধোদয় হয়েছে গরীব ভোটারেরা অনেক বেশি অনুগত ও বিশ্বস্ত হয়। অন্যদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের নিজস্ব বোধ ও চিন্তা-চেতনা থাকে, যা যেমন খুশি স্তোকবাক্যে প্রভাবিত হয়না।

কোভিড অতিমারী থেকে মানবজাতি পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার আগেই মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় জেরবার আমজনতা। এদেশে মূল্যবৃদ্ধি যদিও নতুন কথা নয়, বছরভর এর ছ্যাঁকা আমজনতাকে সহ্য করতে হয়। তবে কোভিড পরবর্তী ক্রমপ্রসারমান অর্থনীতি এবং যুদ্ধ, এই দুইয়ের যুগ্মফলায় মুদ্রাস্ফীতি এমন একটা বাড়াবাড়ি মাত্রায় পৌঁছেছে যার ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার দাখিল। গত ২১মার্চ থেকে লাগাতার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, আর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলেই শাক-সব্জি থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, রান্নার গ্যাস, সর্ষের তেল, দুধ, ডিম, ওষুধ সবকিছুর দাম বাড়বে এটাই দস্তুর। ফলে মধ্যবিত্তের এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা।
কোভিড মহামারিতে বহু মানুষের চাকরি গেছে, আরও বেশি মানুষের মাসমাহিনা কমে গেছে। দক্ষিণ কলকাতার শপিং মলে কাজ করা এক ব্যক্তি বলছিলেন, তিনি এবং তাঁর মতো অনেকেই এখন আগের চেয়ে অনেক কম দিন কাজ পাচ্ছেন, ওভারটাইম পাওয়া তো দুরস্ত। ফলস্বরূপ তাঁদের আয় অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। একদিকে কম আয় আর অন্যদিকে জিনিসের দাম বৃদ্ধি, এর মধ্যে বেঁচে থাকাটা একটা ঝকমারীর পর্যায়ে পৌঁছেছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সংসদে মুদ্রাস্ফীতির পুরো দায়টাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অপরিশোধিত তেলের দামবৃদ্ধির ঘাড়ে চাপিয়ে হাত তুলে দিয়েছেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, আমরা পেট্রোল পাম্পে ডিজেল বা পেট্রোল বাবদ যে পয়সাটা দিই তার মধ্যে ৫৫-৬০ শতাংশই হল কর। সেই করের টাকা কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে যায়। তাই সরকারের দায় তো কিছুই থেকেই যায়, সেটি সীতারামন অস্বীকার করেন কি করে! গতবছর আমজনতাকে পেট্রোল-ডিজেলের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির যন্ত্রনা থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে মোদিজী পেট্রোলে লিটার প্রতি ৫ টাকা এবং ডিজেলে লিটার প্রতি ১০ টাকা কর ছাড়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও বহুবার তেলের দাম বেড়েছে, তখন সরকার নিরুত্তর।

মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব মধ্যবিত্তের হেঁশেলে এসে পড়ল যখন রান্নার গ্যাসের দাম বাড়তে বাড়তে সিলিন্ডার পিছু হাজার টাকা অতিক্রম করলো। নিঃশব্দে এই বৃদ্ধি ঘটে চলেছে, আর চুপিসারে সরকার গ্যাস ভর্তুকির পরিমান কমিয়ে যাচ্ছে। একটু সময় নিয়ে ব্যাঙ্কের পুরোনো পাসবইটা চেক করে দেখুন ২০২০ সালে যখন একটা গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ছিল ৫৮২.৫০ টাকা তখন কত টাকা ভর্তুকি পেতেন আর এখন কত পাচ্ছেন।
এমত পরিস্থিতিতে গরিব মানুষগুলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আঁচ টের পেলেও তাদের ভরসা হল সরকারি সাহায্য যেটা এই আপৎকাল পেরোতে সাহায্য করবে, ধনী মানুষেরাও হয় ভোগব্যয় কমাবে নয়ত সঞ্চয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবে, কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন হল, মধ্যবিত্ত মানুষগুলো কি করবে? তাদের পাশে না আছে সরকার, না আছে ভাঙানোর মত সঞ্চয়! এখানেই অলক্ষ্যে একটা রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে৷ একটি সমীক্ষায় দেশের ৪৯ শতাংশ মানুষ জানাচ্ছেন তাদের জীবনযাত্রার মানের হ্রাস ঘটেছে। এদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, যারা অধিকাংশই স্থির আয় গোষ্ঠীর, যাদের আর্থিক আয় হয় একই আছে নয়তো কমেছে এবং জিনিসপত্রের লাগাতার দাম বৃদ্ধির কারণে প্রকৃত যায় কমে গেছে।
২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের গড় যায় বেড়েছে বার্ষিক ৪৭,২৬০ টাকা থেকে ৫২,০৭৩ টাকা। জিনিসের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হিসেবটা ধরলে প্রকৃত আয় বা ক্রয়ক্ষমতা অনেকটাই কমেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত জনতার পক্ষ থেকে আয়কর কমানো বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুবিধাদানের যে দাবি উঠে আসছে, সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে জিতে বিজেপি সরকার মধ্যবিত্ত জনগণের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। ভোট ব্যাংক ধরে রাখতে একদিকে গরিব দরদী প্রকল্পের সন্ধান করে চলেছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের তুষ্ট করতে কর্পোরেট করে বিভিন্ন ধরণের ছাড় দিচ্ছে। আর মধ্যবিত্তরা ঘোর মুদ্রাস্ফীতি নামক বানের জলে ভেসে যাক, তাতে সরকারের কিছু এসে যায় না৷
মধ্যবিত্তের জীবনে আবার ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দেখা দিল যখন এবছরের ১২ মার্চ ‘এমপ্লয়ি প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যিসোসিয়েশন’ সুদের হার ৮.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮.১ শতাংশ করল, যেটা গত চারদশকের সর্বনিম্ন। একটা সময় (১৯৮৫-৮৬ থেকে ২০০০-২০০১) প্রভিডেন্ড ফান্ড গ্রাহকরা ১০ শতাংশের উপর সুদ পেত, সেটা কমতে কমতে ৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ডে সুদ কমার অর্থ হল মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর অবসরের পর বেঁচে থাকার রসদে টান পড়া। কে দেখবে এদের? কে বাঁচাবে তাদের? অগত্যা চিরকালের মত এদেশে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্ছা হয়েই মধ্যবিত্তদের কালাতিপাত করতে হবে।

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
জানালার ওপাশে- মুহাম্মদ শামীম

জানালার ওপাশে- মুহাম্মদ শামীম

  মুহাম্মদ শামীম    সবকিছু কেন জানালার ওপাশে থাকে কিছুটা অন্তত এদিক ওদিক থাক; প্রেম ভালোবাসা না হয় বাদ দিলাম ফুল, চাঁদ, বাহারি আসমান, মেঘের ...
লাশ

লাশ

ফাহিম পবন যে গুলিতে শব্দ নেই… গানপাউডার এর কোন গন্ধ নেই, বারুদ হীনতায় যে বুলেট শুন্য, সেই একটা গুলি চললেই কেবল দুইটা লাশ। এ লাশ ...
দুটি কবিতা - গোলাম কবির

দুটি কবিতা – গোলাম কবির

|গোলাম কবির   ১. কবিতা লেখার ধুম  আজ বলে দিলাম মেঘলা আকাশকে – তোমার চেয়ে আমার মন  কী কম খারাপ? আমার আকাশ হতে একে একে ...
ছোটগল্প -  ত্রিকালের চাকা

ছোটগল্প – ত্রিকালের চাকা

পার্থসারথি স্যার, আসসালামু আলাইকুম। কন্ঠটা বেশ পরিচিত মনে হলো। পেছন ফিরে তাকাতেই রিক্সাওয়ালা রফিক মিষ্টি হেসে জিজ্ঞ্যেস করলো- কেমন আছেন স্যার?- মুখে মাস্ক পরে থাকায় ...
কবিতা : অপলাপ

কবিতা : অপলাপ

ড.গৌতম সরকার ভেবেছিলাম আশ্বিনের ঝরা মেঘে বৃষ্টি হবে, হীরক কুচির ঘোর আলপনায় আমার দুয়ার,  উঠোন, কলতলা, তুলসীমঞ্চে লক্ষ্মী জেগে উঠবে, কোত্থেকে হিংসুটে একচিলতে হাওয়া  ভুঁইফোড় ...
বিস্মৃতির আড়ালে

বিস্মৃতির আড়ালে

 সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়) তিলোত্তমা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে লেভেল ক্রসিংয়ের খুঁটি ধরে। গাড়ি চলে যেতেও ওর মধ্যে এগোনোর কোন লক্ষণ দেখা গেল না। ওর মনের মধ্যে ...