ভিন্টেজ রেডিও

ভিন্টেজ রেডিও

আশিক মাহমুদ রিয়াদ

গলির মাথায় তিনতলা বাড়ি! আকাশ থেকে নেমে আসা মেঘের ফালি। শহরের রাস্তাগুলোতে অন্ধকার কান্না করতে পারে না। ভেজা রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের আলোয় সব ঝলমলে। তারুণ্যের ছটফটে কিসের একটা বেদনা বহ আভাসে রাতে ঘুমটুম হয় না। মাথাজুড়ে আকাশ ছোঁয়ার অলীক স্বপ্নে ধেয়ে বেড়ায়। গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে যায়, কখনো কখনো থাইগ্লাস খুলে দিলে জানলা জুড়ে সুখ দুঃখের কান্না ভেসে আসে। কখনো একটু স্নিগ্ধ বাতাস, সবার ঝমঝমে বর্ষায় বৃষ্টির ছিটে এসে গা ভিজিয়ে দেয়! এতেই আপাতত বড্ড তৃপ্ত সুখ।

রাত্রি তিনটে নাগাদ ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বাইরে নিশুতি খেলা করছে। ধারে কাছে আবাসিক এলাকা! চোখ বাড়ালেই বড় গাছের সারি চোখে পড়ে। তিনতলা বাড়িটায় আজ কোন আলো নেই! আজ কি ও বাড়িতে কেউ বাতি দিতে আসেনি? শিশুর কান্না ভেসে আসে! এ কান্না ক্ষুধার! কিছুক্ষণ বাদে কান্না থেমে যায়! মায়ের স্তনে চুমুক দিয়ে শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে। এই শহুরে আধুনিকতার ভীড়েও কোত্থুকে যেনো রেডিওর ভ্যাসভ্যাসে আওয়াজ ভেসে আসে কানে! আমি নির্ঘুম নির্মগ্ন রাত জেগে কাটাই! ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ি! বাতাসে মেঘের আস্তরনের মতো সে ধোয়া উড়ে গিয়ে মিলিয়ে যায় ক্ষাণিক বাদে। এসবের মধ্যেই চলে আলো আঁধারির খেলা!

দূর থেকে স্টিমারের ভেঁপুর আওয়াজ ভেসে আসে! চোখ জুড়ে নেমে আসে শেষ রাত্তিরের ঘুম! তারুণ্যে বোধয় এই এক জ্বালা! সহজে ঘুম আসে না, আসলেও বেঠিক সময়ে এসে চোখের পাতা একাকার করে দেয়। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মঈন! বাতাসে ভেসে আসে রেডিওর সেই ভ্যাসভ্যাসে আওয়াজ। নিচের টিনশেড বিল্ডিং থেকে হয়ত।

২.
সকালে ঘুম ভাঙে গির্জার ঢং ঢং আওয়াজে। তখন ভোর সকাল। যতদূর ঘুম হয়েছে তাতে সাড়ে তিনঘন্টা হবে। বিছানায় এপাশ ওপাশ ফিরে কোলবালিশ গায়ে জড়িয়ে আরও ঘন্টা চারেক ঘুমের বাকি। রেডিওর সেই ভ্যাসভ্যাসে আওয়াজটা সকালে নেই। পাখির কিচিরমিচির শব্দে শহুরে অরণ্যে প্রাণ খেলা করছে। মঈন ঘুমিয়ে আছে, বাতাসে চুল উড়ছে দক্ষিণ দিকের আকাশে কালো মেঘ জমা হয়েছে। আরেকটু বাদেই ঝড়ো বৃষ্টি নামার কথা! আকাশে কালো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে।

বৃষ্টিস্নাত সকালে রাস্তায় ছপছপ পা ফেলে হাটছে মঈন। বর্ষার দিনে রিক্সার দেখা পাওয়া মুশকিল।
বৃষ্টির জল রাস্তার দু’ধারে ছিটিয়ে দিয়ে একটার পর একটা গাড়ি বেড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে এই ঘনঘোর বর্ষায় দু’একটা হুইসেল বাজানো এম্বুলেন্সের দেখা পাওয়া যায়। কত নম্বর সিগন্যাল চলছে কে জানে! এই বৃষ্টিস্নাত দিনেও সরঞ্জাম নিয়ে রাস্তার পাশে বসেছে একজন ছাতি রিপেয়ারের লোক। বয়সে বৃদ্ধ, চোখে মোটা কাঁচের চশমায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির জলের ছিটে লেগে আছে৷ হাত-পা গুটিয়ে অল্প জায়গার মধ্যে বেশ আয়েশ করে বসেছে লোকটি। উদাসমুখে রাস্তার ওপাশে একটি ভিজে কুকুরের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে লোকটি। সত্যিই আয়েশ করা মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। লোকটি বসে আছে, এই বৃষ্টির দিনেও যদি বাতাসে কারো ছাতা নষ্ট হয়ে যায় সে ছাতা সাড়িয়ে দু’পয়সা পকেটে পুড়বে বলে। এতেই সংসার চলে! চালাতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে মঈনের সামনে থেকে বেড়িয়ে যায় একটি খালি রিক্সা..চেতন মনের সায়ে ,’অ্যাই রিক্সা’ বলে ডাক দিতেই ক্ষাণিক দূরে গিয়ে রিক্সা দাঁড়িয়ে যায়।’

৩.
অফিসে আজ কোন কিছুতেই মন বসছে না। এসব বৃষ্টিস্নাত দিনে বাঙালী পুরুষের অন্যতম প্রধান কাজ কাক হয়ে নাক ডেকে নিশ্চিন্তে ঘুম দেওয়া। দুই একবার হাই তুলে, কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়াতেই চুল ঝাড়তে ঝাড়তে অন্যরুম থেকে বের হয় শ্রেয়া!

চায়ের কাপে চুমুক দিতে চশমার ফাঁকে আড়ালে দু একবার নজর যায় শ্রেয়ার দিকে। মেয়েটা বড্ড ছিমছাম; শান্ত গোছের মেয়ে, অফিসে নতুন জয়েন করেছে। বসের রুমে আসা-যাওয়া বেশি। অফিসের কলিকদের সেই নিয়ে কত ঘোরপ্যাঁচ কথা! এসব ভালো লাগে না মঈনের। ভালো লাগার কথাও না!

আগামী মাসে ট্যুরে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার কথা ছিলো! কিন্তু সে রাষ্ট্র এমনি করে দেউলিয়া হয়ে যাবে! প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে বসবে এসব নিয়েও মাস চারেক আগে কোন রকম আলোচনা ছিলো না। অফিসের কলিগ আব্বাসের সাথে এ নিয়ে ক্ষাণিক তর্ক-বিতর্কের পরে আবার গিয়ে নিজের ডেস্কে বসে কম্পিউটারের স্ক্রিণের দিকে চোখ জানা কোন কারনে মনের মধ্যে ভেসে আসে রেডিওর সেই ভ্যাসভ্যাসে আওয়াজ। অফিসের কর্ম-ব্যস্ততায় এবার ক্ষাণিক হারিয়ে যায় মঈন রেডিওর টোনে কে যেন বলছে, মঈন সাহেব? মঈন সাহেব? শুনছেন আমাকে ? শ্রেয়ার গলা। মঈনের বিভ্রম ভাঙে।

৪.
দূর থেকে হাঁক দিয়ে রিক্সাওয়ালা বলে, আকাশের অবস্থা ভালা না। আইজক্যা জম বৃষ্টি নামবো। এইরে কয় ভাসাইন্যা বৃষ্টি। আরেক রিক্সাওয়ালা জবাব দিয়ে বলে, ‘অলইক্ষইন্ন্যা কথা কইস না! আইজক্যা বৃষ্টি হইলে ঝামেলা হইয়া যাইবো..মাইয়াডা অসুস্থ….মহাজনরে দেওয়ার মতো ভাড়াই অহনো উডে নাই”

মঈন ওদের কথোপকথনে ক্ষাণিকটা মুষড়ে যায়। তার ইচ্ছে করে খোঁজ নিতে..মেয়েটার জন্য ওষুধ কিনে দিতে। বেদনার মোচড় শেষে এক ফালি তাড়া এসে জাপটে ধরে মঈনকে। অফিসের বাস চলে আসে.. উঠে পড়ে মঈন। আকাশ কালো হয়..কালো মেঘের আস্তরণে অন্ধকার হয়ে আসে শহর। ক্ষাণিক মন বিষিয়ে ওঠে মঈনের….কখনো কখনো চাইলেও পরিস্থিতির ফাঁদে পড়ে কিছু করার থাকে৷ মঈন মেনে নেয় অবচেতন মনের অসহায় আত্মসমর্পণ.. চেতন-অচেতন যুদ্ধ চলে..ঝড় শুরু হয়..যেনো প্রলয়ের উল্লাস ভেসে বেড়ায় কালবোশেখের তান্ডবে।

সপ্তাহ দুয়েক পরের কথা…সকালে অফিসে যাবার জন্য মোড়ে দাঁড়িয়ে ক্ষাণিক কি একটা ভাবে মঈন। রাতের সেই রেডিওর ঝিরঝিরে আওয়াজ মাখা নজরুলের গজল কানে ভেসে আসে। এই সুর শব্দের সুত্রপাত উদঘাটন করতে পারে মঈন..মোড়ের ছাতিওয়ালা..কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। তার কোলে একটা ভিন্টেন রেডিও…. মঈন পা বাড়ায় সেদিকে। লোকটির চোখে পুরু কাঁচ..মঈন ডাকে, ‘চাচা ও চাচা’ লোকটি ক্ষাণিক বাদে নড়ে চড়ে ওঠে। এতক্ষণ দেখে বোঝার উপায় ছিলো না তার মধ্যে নিশ্বাস প্রশ্বাসের ওঠা নামা চলছে। সদ্য তন্দ্রা ভেঙে যাওয়া ক্ষাণিকটা বিভ্রান্ত হয়ে নিজের চশমা খুৃঁজতে থাকে।

-মঈন কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি খুঁজেন চাচা?
-লোকটি মঈনের দিকে তাকিয়ে বলে,’চশমাডা কই যে রাখলাম বাবা! আফনারে ভালো কইরা দেখতেছি না। কি জ্বালা! আপনে একটু দাড়ান.. আশেপাশেই হয়ত আছে। আপনার কি ছাতি সারাণ লাগবো?’
-মঈন বলে,’চশমা তো আপনার চোখেই আছে চাচা’
-নিজের চোখে হাত দিয়ে চশমাটা খুকে জামা দিয়ে মুছে আবার চোখে পড়ে বলে,’এইবার আপনারে দেখতাছি’
বৃদ্ধ লোকটির কর্মকান্ডে মঈন ক্ষাণিকটা অবাক হয়..মনের ভেতরে চলে এলোপাতাড়ি দর্শন-কাব্যের বোনাবুনি…মানুষের বিশ্বাসে জাদু আছে’
-আমি আপনার কাছে…ছাতা সারাতে আসিনি চাচা। আপনার রেডিওর শব্দ..প্রতিরাতে শুনি। আমি এ গলির মাথার বাড়িটার তিনতলায় থাকি।
-আপনার রেডিওটা পছন্দ হইছে?
-না..মানে আপনার রেডিওর শব্দে কেমন যেন মাদকতা আছে৷
-আপনে কি রেডিওটা নিবার চান?
-উশখুশ হয়ে মঈন বলে, না মানে!
রেডিওটা মঈনের দিকে বাঁড়িয়ে বৃদ্ধ লোকটি বলে..
আপনি রেডিওটা নিয়া যান..দুইদিন পরে ফেরত দিয়েন৷ তয় আপনে রেডিওটা ফেরত দেওয়ার দিন আমারে তিনশো তেত্রিশ টাকা দিয়া যাইতে হবে..তিন দিনের মাথায় রেডিওটা ফেরত দিলেই হইবো। তারা আগে কন আপনার ঘড়িতে ক’য়টা বাজে? মঈন হাতঘড়ির দিকে নিজের মাথা সমার্পন করে দেই বৃদ্ধ মানুষটিকে জানায়, “দুইটা বাইশ।”

৫.
যাপিত জীবনের চালচিত্রে কত মানুষের সাথে পরিচয়। কত মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে ধুম্রজালের অস্থির সময়ে স্বস্তির ডাকে। মোড়ে ছাতিওয়ালার সাথে। ছাতিওয়ালার গালে সফেদ দাঁড়ি…চেহারায় শুভ্র শীতলতার ছাপ..একদিন ঘনঘোর বর্ষার কথা..ঝুম বৃষ্টিতে কান পাতলে মনে হয় কে একজন অঝোরে কাঁদছে। সেই কান্নার শব্দে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সব কিছু! বৃষ্টি থামে..বাতাসের ঝটকায় গাছপালার মর্মর শব্দে হাহাকার করে ওঠে চারপাশ। আকাশ ফেঁটে বিদ্যুৎ চমকায়..বজ্রপাতে কানের তালা লেগে যায়..শুরু হয় আরও একপশলা বৃষ্টির শব্দ! রাত পেড়িয়ে যায়..যেন কয়েকশ শতাব্দীর জমিয়ে রাখা কান্না কাঁদছে কেউ।

বৃষ্টিতে দম পড়ে! ভিন্টেজ রেডিওটা বাঁজছে..অদ্ভুত ঘোর লাগা মাদকতা আছে রেডিওটায় ভ্যাস ভ্যাসে শব্দে…রেডিওর চ্যানেল ঘুরিয়ে অন্য একটা চ্যানেলে যায়, ‘অদ্ভুত মায়াবী মাদকতায় বাজছে এক অচেনা গান’ মঈনের মনে প্রশ্নের দলা পাক খাচ্ছে।ঘড়িতে তখন দলা পাকাচ্ছে সময়, আকাশের বিদ্যুতের আলোকঝলকানীতে ঘড়িটা সময় জানায়, সময় এখন চারটা চুয়াল্লিশ।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
এক পৃথিবী

এক পৃথিবী

রিয়াদ হায়দার তোমার চোখের একটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে যখন ঝরে, আমার তখন বুকের মাঝে কেমন যেন কাঁপন ধরে ! যখন তোমার হাসির ছটায় রোদের কণা ...
মহানগর-২: সিস্টেমের গোঁড়ায় থাকা ভূতদের সামনে আনলেন নির্মাতা?

মহানগর-২: সিস্টেমের গোঁড়ায় থাকা ভূতদের সামনে আনলেন নির্মাতা?

আশিক মাহমুদ রিয়াদ সিজন-১ এ দর্শকের ব্যাপক জনপ্রিয়তার পরে এবার এলো মহানগর সিজন-২। এই সিজন নিয়ে দর্শকের আগ্রহ এতটাই বেশি ছিলো যে মহানগরের সিজন-২ এর ...
ঝড় তুলতে আসছে শাকিব খানের "তুফান"

ঝড় তুলতে আসছে শাকিব খানের “তুফান”

সিনেমানামা ডেস্ক বর্তমান সময়ে অন্যতম ক্ষুরধার পরিচালক রায়হান রাফির পরিচালনায় আসছে শাকিব খানের সিনেমা ‘তুফান’ এই সিনেমার কথশ্রুতিতে আছে, বাংলা সিনেমার অতীতের সব রেকর্ড ভাঙতে ...
অণুগল্প : শিউলি ফুল

অণুগল্প : শিউলি ফুল

লুনা রাহনুমা বৃন্তচ্যুত একটি শিউলি শরতের সকালে কুয়াশা মাখা ঘাসে লুটিয়ে পড়েছে। জগত সংসার থেকে আজ তার একরকম মুক্তি মিলেছে। সামাজিকতার দায় চুকেছে চিরতরে। যদিও ...
All Your Burning Technology Questions, Answered

All Your Burning Technology Questions, Answered

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
সিনেমা রিভিউ - আয়নাবাজি

সিনেমা রিভিউ – আয়নাবাজি

সিনেমা- আয়নাবাজি পরিচালক-অমিতাভ রেজা চৌধুরী প্রযোজক-জিয়াউদ্দিন আদিল,গাউসুল আলম শাওন।  চিত্রনাট্যকার-গাউসুল আলম শাওন,অনম বিশ্বাস  ।  শ্রেষ্ঠাংশে-চঞ্চল চৌধুরী,মাসুমা রহমান নাবিলা,পার্থ বড়ুয়া ।  সিনেমা পর্যালোচনা লিখেছেন- হুমায়রা বিনতে ...