জোবায়ের রাজু
এটি একটি অসাধারণ গল্প। স্বপনের গল্প। স্বপন ছাপোষা মানুষ। রামগতির ছেলে। ওই অঞ্চলের মানুষের নাকি আমাদের আমিশাপাড়াকে দ্বিতীয় আমেরিকা শহর মনে হয় ওদের দর্শনে। তাই বছরের বারোমাসই ওরা এখানে জীবিকা নির্বাহ করতে আসে৷ জীবিকা হিসেবে ওরা মাটি কাটার কাজকে সম্মান করতে শিখে গেছে এতদিনে।
ওদের পরিশ্রমে অর্জিত টাকাগুলোর বেশীরভাগ চুরি যায়। ওদের সহকর্মীরাই এমন অপকর্ম করে যে ওরা নিজেরাও তা বুঝতে পারে, কিন্তু প্রমাণের অভাবে আন্দোলিত হলেও প্রতিবাদ করতে পারেনা। তাই ওরা আমার আব্বার কাছেই ওদের শ্রমের পয়সাগুলো জমা রাখে। প্রায় এক যুগেরও বেশী সময় ধরে আব্বা ওদের টাকা-পয়সা ফাইলের মধ্যে যার যার নামে জমা রাখার উদারতা দেখিয়ে আসছেন!
তো স্বপনের কথাই তো বলছিলাম, না? বাচ্চা ছেলেটি এই বয়সে দরিদ্রতার কাছে হেরে গিয়ে মাটি কাটার জীবিকার জন্য আমাদের তল্লাটে এসেছে। রোজ মাটি কাটার টাকা সন্ধ্যায় এনে আমার কাছে জমা দেয়। খানিকক্ষণ গল্পও করে। আমাকে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। আমি নাখোশ করে দিলে কোল্ড ড্রিংস°এর প্রস্তাব দেয়। আমি সুকৌশলে ওর প্রস্তাব এড়িয়ে যাই। কারণ আমি জানি ও জীবনযোদ্ধা। আমাকে আপ্যায়নের পয়সাগুলো ওর ঘাম ঝরানো পরিশ্রম থেকে এসেছে। ওর এমন আন্তরিকতায় বুঝতে পারি এটা আমার প্রতি ওর সুপার ইনপ্যাচুয়েশন। আলহামদুলিল্লাহ।
কাল ঈদ। ঈদের ছুটিতে স্বপন আজ ওর বাড়ি রামগতিতে যাবে৷ জমানো টাকাগুলো নিতে এসে জানালো মায়ের জন্য একখানা শাড়ি কিনেছে। শপিং ব্যাগ খুলে মায়ের জন্য কেনা শাড়িটি দেখালোও আমাকে। আমি আপ্লুত হতে থাকি। এইটুকু বাচ্চা ছেলে, কঠিন পরিশ্রমের অর্থে মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছে। এ যে এক অন্যরকম সুন্দর গল্প। আমার ভেতরটা তোলপাড় করে দেওয়ার এক নৈঃশব্দের সুবিশাল গল্প৷ কিছু কিছু গল্পের উপক্রমনিকা কিভাবে যে চমকে দেয়, টের পাই না আমি।
স্বপন যখন ওর জমা রাখা টাকাগুলো নিয়ে চলে যায় রামগতির দিকে, আমি ওর হাতের লাল শপিং ব্যাগটির দিকে তাকিয়ে থাকি। ওই শপিং ব্যাগে শুধু একটি মায়ের শাড়ি-ই রামগতির দিকে যাচ্ছে না, মায়ের প্রতি এক অমূল্য ভালোবাসার অপূর্ব মহানুভবতাও যাচ্ছে।
আমার মন খারাপ হল ভীষণ। আম্মা যখন মারা যান, তখন আমার ছাত্রজীবনের তপস্যায় ব্রত থাকার রেস্ট্রিক্টেড মোমেন্টস্। আয়-রোজগারের বাস্তবিক জীবন ছিল না।
এখন আমি পরিশ্রমি৷ চাইলেই আম্মাকে যখন তখন কিনে দিতে পারি রাশি রাশি শাড়ি। কিন্তু আম্মা নেই৷
এই জীবনের কিছু কিছু অংকের ফলাফল কোনোভাবেই মেলানো যায় না। কেন যায় না…