নিলুফা জামান
সেদিন আমি অন্তর আর পিনাকী…
তিন বন্ধু ঘুরতে বের হয়েছি, গাড়ী ছুটছে সোঁ সোঁ করে উল্কা বেগে। মনে হচ্ছে বহু দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে ছুটে চলছি, কত দূর এসেছি কত শহর কত গ্রাম পিছনে ফেলে চলে এসেছি বুঝতে পারছিনা। এখন মনে হচ্ছে কোন এক অচেনা জনপদের ভিতর দিয়ে পার হচ্ছি।
বেলা দ্বিপ্রহর। অন্তর চেঁচামেচি করে গাড়ী থামাতে বললো, পেটুক মানুষ…খাবারের হোটেল দেখেই তার খিদে পেয়ে গেছে বোয়াল মাছ দিয়ে ভাত খাবে বলতে বলতে নেমে গেলো হোটেলের দিকে। ড্রাইভার লিটন চায়ের দোকান খুজতে চলে গেলো চা খাবে বলে। আমি আর পিনাকী গাড়ী থেকে নেমে আশপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলাম কী সুন্দর জায়গাটা! গাছ গাছালিতে ছেয়ে আছে, সবুজ আর শ্যামলে মিলে ছায়া শীতল নিরিবিলি পরিবেশ, আমার খুব ভাল লাগছিল ঘুরে ঘুরে দেখতে। আমাদের দুজনকে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখে স্থানীয় একজন লোক কাছে এসে জানতে চাইলেন, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন ? পিনাকী বললো আমরা তিন বন্ধু শহর থেকে ঘুরতে এসেছি। একজনের খিদে পেয়েছে তাই হোটেলে ঢুকেছে খেতে। লোকটি কৌতুহলি দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে থাকলো। আমি জিঙ্গাসা করলাম ভাই সাহেব, এই জায়গাটার নাম কি? জায়গাটা খুব সুন্দর।
লোকটি গম্ভীর কন্ঠে বললেন ‘অশ্বিণী মাধব হাট’। আমি বললাম তবে কি আমরা সিমান্ত পার হয়ে চলে এসেছি ? লোকটি অবাক হয়ে উল্টা প্রশ্ন করলেন কিসের সিমান্ত মহাজন? ১৮৫৮ সালের পর থেকে এখানে কোন সিমান্ত নাই -এখানে সব একাকার। লোকটি আবারও বললো ঐ যে পাশের বাজারের নাম রহিম ব্যাপারীর হাট, তারপর আছে খৃস্ট আনন্দের বাজার, আর এই যে চালা ঘরটা দেখছেন ওটি পরেছে বুদ্ধনং হান্ডি দেউরী।
আমি লোকটির কথার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, এ কোন এলাকায় এসে পরলাম রে বাবা! চার দিকের চার রকম নাম -হিন্দু,মুসলিম, বুদ্ধ, খ্রিস্টান। জায়গার নাম কি অদ্ভুত।
আমার কেন যেন ভয় ভয় লাগলো, আমি পিনাকীকে বললাম অন্তরকে ফোন কর, আর কত খাবে? হঠাৎ আমার মনে হতে লাগলো এখানকার আকাশ বাতাস সমগ্র প্রকৃতি কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে, বেলা দ্বিপ্রহর, অথচ মনে হচ্ছে এখনই সৃর্য ডুবে যাবে, গাছপালা ভূমি বরাবর লুটিয়ে পরবে, এক্ষুণি বুঝি ভূমিকম্প হবে। আমি পিনাকীর হাত শক্ত করে ধরে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলাম, বললাম অন্তর কে তারাতারি আসতে বল, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে হবে আমার খুব অস্বস্থি লাগছে। ড্রাইভার লিটন কে ডেকে আনালাম। আমি আর পিনাকী গাড়ীতে উঠে বসলাম। বসেই আমি অনুভব করলাম আমার ভীষন ঠান্ডা লাগছে।শরীর ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে চোখের পাপড়ি গুলোতে বরফ জমে ভারি হয়ে আছে কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিনা। পিনাকী অন্তর কে ফোন করছে বারবার সে আসছে বললো। সে এলো কি না দেখার জন্য অনেক চেষ্টা ও কষ্ট করে চোখ খুলতে পেরে দেখি ডিম লাইটের নীল আবছা আলোতে আমার রুমের খাটের উপর শুয়ে আছি, বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, রুমের ভিতর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুড়ছে, ফ্যানের বাতাসের ঠান্ডায় আমি কুঁকড়ে শুয়ে আছি।
পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা কাঁথাটা গায়ের উপর টেনে দিতে দিতে ভাবলাম, এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলাম? শুয়ে শুয়ে ভাবলাম স্বপ্নে যখন আমরা অশ্বিণী মাধব হাটে পৌছালাম তখন জায়গাটা কি সুন্দর ছিল অমন সুন্দর জায়গা আগে কখনো দেখিনি… তবে হঠাৎ করে প্রকৃতি টা এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো কেন? তখনো আমরা পৃথিবীর মানুষরা জানিনা আর মাত্র কয়দিন পর করোনা ভাইরাস নামক দৈত্যের হামলায় পরবো। প্রকৃতি আমাদের উপর নিষ্টুর প্রতিশোধ নিবে।
আজ পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে সেই অশ্বিনী মাধব হাটে। ভৌগলিক সিমারেখা পার হয়ে সীমানা হীন সেই অদ্ভুত রাজ্য পাটে। করোনা পাবেনা নাগাল আমাদের।