আশিক মাহমুদ রিয়াদ
আপনার আশেপাশে চেয়ে দেখুন! সবাই চাবায়, খাচ্ছে, যা খুশি তাই। খাচ্ছে আর ভাবছে। কি অদ্ভুত! এই খাওয়া শহর। আনমনা কিংবা উদাসীন, অথবা বেখেয়ালী হয়ে বুটের ডালে জড়ানো চর্বির দলা আর সাদা ভাত মুখে নিয়ে চাবাচ্ছে মতিন। খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছে আর এদিক সেদিক দেখছে। তখন সকাল দশটা, বাসের হর্ণ আর রিক্সার টুংটাং আওয়াজ – টাওয়াজে গোটা শহরের মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। ঠিক সে সময়ই! ব্যাথায় কাঁকিয়ে উঠলো মতিন। যে চর্বিকে এতক্ষণ ভেবে চাবিয়ে আসছে, সেই চর্বি কখন যে ডান গাল থেকে বা গালে সরে গিয়েছে উদাসীন হয়ে খেয়ালই করেনি মতিন। ফলশ্রুতিতে তার দাঁত খচ করেই কামড়ে ধড়েছে নরম জিহ্ববাকে। সেকি যন্ত্রণা! জিহ্বাটা বুঝি গেলো এবার। তবেজিহ্বাএত সহজে যায় না! জিহ্ববার অপব্যবহার করলেই জিহ্ববার দফারফা হয়েছে। যেখানে সেখানে জিহ্বার ব্যবহার না করাই ভালো! কি বুঝলেন? প্রশ্নত্তর নিজের অন্তরালেই রাখুন এবেলায়!
অনাকাঙ্ক্ষিত জিহ্বা দূর্ঘটনায় মতিনের মাথা ধরে গেছে।জিহ্বা থেকে রক্ত বেরিয়েছে! রক্তের স্বাদ নোনতা। নিজের রক্ত নিজের খেতে কেমন লাগে? তবে যাই যা বলুন মশাই৷ রক্তেরও স্বাদ আছে। জিহ্ববার ক্ষত নিয়েই মতিন দৌড়ে ঝাপিয়ে বাসে উঠতে গেলো। কিন্তু মোটাসোটা এক ভদ্রলোকের কনুইয়ের বাড়ি খেয়ে তৎক্ষণাৎ রাস্তায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রায় পড়তে পড়তে যাবে সেসময়েই এক ব্যক্তি হাত ধরলো। ততক্ষণে দুটো বাসে পাল্লা দিয়ে সমান অবস্থানে আছে৷ এ ও নিজেদের চাঁপিয়ে দিচ্ছে। মতিন ফান্দে পড়ে জিহ্ববার সাথে মুখের থুতনি কেঁটে মুখে একগাল তাজা রক্ত নিয়ে বাসের দরজায় ঝুলছে। তাকে যে ভদ্রলোক ধরে আছে তার কোন কষ্ট হচ্ছে না। এ শহরে মতিনের মত রোগা পাতলা; চুল পড়ে যাওয়া সুখ টাকের অধিকারী অনেক মানুষেরই বিচরণ আছে। গাল ভাঙা মতিনের চোখের নিচে কালি! মোটামুটি সাইজের দাঁড়ি। মাঝেমধ্যে শহরের অলিগলির মধ্যে পোট্রের্ট সাইজের পোস্টার চোখে পড়ে – আপনি কি টাক সমস্যায় ভুগছেন? তার নিজেই বড় করে লেখা থাকে আপনি কি যৌন সমস্যা ভুগছেন? অল্পেই নিস্তেজ হয়ে যায়?। এসব চোখ এড়ায় না। কেউ কেউ আড় চোখে তাকিয়ে পোস্টার পড়ে৷ কেউ নিজের সমস্যার কারণে তাকায়, কেউ আবার ফ্যান্টাসির কারনে।
২.
মতিন ঢাকার কোন এক প্রাইভেট কোম্পানির কেরানি। এই বিশেষ কোম্পানিটির কথা শুনলে মতিনের মুখ খিটখিটে হয়ে আসে। এই অভ্যাস মতিনের একার না। নিজের কোন কিছু শুনলেই ভীষণ খিটখিটে হয়ে যাই আমরা। আপাতত এই গুরগম্ভীর কথায় না যাই। মতিনের কথায় ফিরি! রেললাইন পেরিয়ে মতিনের গন্তব্য বস্তির পাশের সরু গলির ভেতর দিয়ে কিছুদূর হেটে কয়েকটি একলাগোয়া টিনের ঘরের বাম পাশের ঘরের ডানপাশের গলির সাতটি ঘরের যেকোন একটি ঘর।
বস্তি পেরিয়ে এপাশের সীমানার নাম জানতে অনেকেরই মন কুটকুট করতে পারে। মতিন মাঝেমধ্যেই এখানে আসে। মাথার চুলের স্পর্শে কোন নারীর ছোঁয়া নেয়। এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর ছ্বড়ে তার। পৃথিবীর সবথেকে করুণ জায়গা মনে হয় জুনুপরীর খাটকে। তিক্ত এক গন্ধ ভেসে বেড়ায় নাকে। মতিন এখান থেকে সোজা বেড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায়।সিগারেট টানতে টানতে গা ছাড়া শরীর নিয়ে হাটতে হাটতে বাসার উদ্দ্যেশে পা বাড়ায়। বাসায় ঢোকার আগে মুদি দোকান থেকে
এক কেজি চিনে নেয়। বাসার তালা খুলে সর্বপ্রথম সে অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে বাথরুমে ঢুকে বালতিতে চিনি মিশিয়ে তারপর বালতির সব চিনির পানি গায়ে ঢালে। এরপর তার কাজ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকা ।সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে। প্রায় ঘন্টাখানেক বসে থাকার পরে তার চিনিভেজা শরীর বাতাসে শুকিয়ে যায়। পিপড়ার দল এসে ভিড় করে। কুটকুট করে কামড়ায়, সারা গায়ে হাটে। দৌড় বেড়ায়, একে অপরের সাথে চুমু খায়, বিভিন্ন ব্যপারে কথাবার্তা হয়। খাদ্য বন্টন, রাজনৈতিক অরাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, বহির্বিশ্বের কথা বার্তা হয়। এসব কিছু কান পেতে শোনে মতিন। এতটুকু ব্যপার অদ্ভুত লাগলো বোধয়? তাহলে আরেকটা অদ্ভুত কথা শুনুন! ঢাকার শহরে পিপড়ার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এরকম একটা অদ্ভুত খবর কে রাখে?
মতিন মিয়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, পিপড়াগুলো তার শরীরে এসে তার সব পাপ শোষণ করে নেয়। এই পাপ শোষণ করার পেছনে একটা উল্লেখযোগ্য কারন আছে। মতিন জানে, পিপড়াগুলো তার শরীরে এসে বাসা বাঁধে কামনার জন্য কিংবা ক্ষুধা নিবারণের জন্য। মতিনও পতিতালয়ে যায় ক্ষুধার জন্য, যাকে পরিস্কার শুদ্ধভাষায় বলে যৌনকামনা।
৩.
পিপড়াকামনা শেষ হলে মতিন গোসল করে। প্রথমে কেরাসিন তেল দিয়ে গা ধোয়! এরপর গায়ে পানি ঢালে। অধিকগন্ধযুক্ত সাবান, লোবান দিয়ে গোসল সেরে চোখে গায়ে কপ্যুর দিয়ে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানাতে। বিছানাতে শুয়ে সে গভীর চিন্তাভাবনায় মগ্ন হয়। মতিনের একটা অলিখিত ইচ্ছা আছে। নিজের ছোটখাট সুপ্ত বাসনা, আকাঙ্খা সে নিজেই পূরণ করতে পারে। ছোটখাটো একটা চাকরী করে, ইচ্ছে হলে যায় কখনো কখনো ইচ্ছে করেই যায় না। মাসে চারবার সে একটি ভিন্ন যায়গায় যায়। কোথাও যেতে ইচ্ছে করলে পায়ে হেটে রওনা করে। হাটার মধ্যে এক ঘোরে পৌছায়, এই ঘোর কাটে কোন নতুন যায়গায় গিয়ে। সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
গত সপ্তাহে হাটতে হাটতে সে এক শ্মশানে গিয়েছিলো। শশানে গিয়ে দেখলো একটি শবদেহ পুড়ছে। সেখানে ক্রদণরত মানুষের সাথে সেও হুঁ হুঁ করে কাঁদে কাদার মধ্যে অদ্ভুত একধরণের শান্তি পায় মতিন। সে কখনো হাসে না। এই কথাটি কিঞ্চিত মিথ্যে মনে হতে পারে, মতিন হাসে। যাকে বলে মৃদু হাসি কিংবা কিঞ্চিত হাসি।
৪.
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সে কিছুক্ষণ ধ্যানে বসে। খুব ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে অফিসের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। হেটে হেটে যায়! সকালে হাটতে তার ভালো লাগে। সকালে অনেকেই হাটে!
কেউ কেউ গাছের আড়ালে সকালের প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে, হাগে কিংবা মলত্যাগ করে। মতিনের এই জৈবিক কাজটি ভীষণ বিদঘুটে লাগে। তার মাঝেমধ্যে মাথায় বড়সড় ধরণের গভীর অদ্ভুতুড়ে প্রশ্নের জটবাধে। এই কাজটি যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো তাহলে কী হতো? মানুষের খাবার পরে সেই বর্জ্য গুলো কোথায় যেতো? সে সেখানেই চিন্তা থামিয়ে দিতে চায়। তবে তার মাথায় বিদঘুটে সেই প্রশ্নের দলপাকানো ছন্দ ঘুরতে থাকে। পৃথিবী এক অদ্ভুত খেলা!
কোন এক সকালে মতিনের জন্ম হয়েছিলো রাস্তার পাশে। কোন এক ভবঘুরে পাগল তাকে আশ্রয় দিয়েছিলো খেলনার পুতুল হিসেবে। সেই মতিন প্রকৃতির ছায়ায় ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। একেরপর এক আশ্রয় এসে মতিনের ভাগ্যে জুটলো।
পৃথিবীকে যদি লেখাপড়ার হিসেব দিয়ে বিচার করা হয় তাহলে মতিনের লেখাপড়ার শুরু হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছিন্নমূল শিশুদের বর্নপরিচয় শেখার উদ্যোগ থেকে। সেখান থেকে মতিনের এই লেখাপড়ার মতো আজগুবি বিষয় ভালো লাগে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে একটি সন্ধ্যাকালীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে মতিন। লেখাপড়া ঐ যদ্দুর। এরপর যতই সে মানুষের জীবনকে পড়েছে ঠিক তাই হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। কখনো ভালো মানুষ অথবা কখনো খারাপ মানুষ। বেশ কিছুদিন কেটেছে তার মসজিদের বারান্দায়। কখনো কখনো আশ্রয় পেয়েছে আশ্রমে। আবার কখনো থেকেছে মিশনারী হোস্টেলে। মতিনের কাছে ব্যস্ততার এই শহরে একটি গভীর প্রশ্নের জট বাধা দিনে একটি প্রশ্নই বার বার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, জীবন মানে কি? সেই প্রশ্নের উত্তর সে পায়নি। তার কাছে জীবন মানে একটি নতুন গাছ, তার কাছে জীবন মানে বর্ষার প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা। তার কাছে জীবন মানে কখনো কখনো যৌনতা। এসব কিছু থেকে বের হয়ে তার কাছে জীবন মানে ক্ষুধা। ক্ষুধার থেকে যন্ত্রণা বুঝি এই বিশ্বে আর কিছুই নেই।
প্রশ্নের উকিবুকিতে মতিন কখনো কখনো মুষড়ে পড়ে। মতিন তার অবাঙ প্রশ্ন গুলো লিখে রাখে নোটপ্যাডে। সেই নোটপ্যাডে একটি অধ্যায় আছে, যদি বলা হয় শান্তি কি? সুখি মানে নিজের শরীরের ঘ্রাণ, গোসল করার পরে নিজের লাল গামছা দিয়ে গামোছা৷ এর থেকে বড় সুখ আর পৃথিবীতে নাই। মতিনের মাঝেমধ্যে নিজেকে ভীষণ বড়মাপের দার্শনিক মনে হয়।
সেই সকালের কথা মনে আছে? মতিন যে সকালে জিহ্ববায় কামড় দিয়ে রক্ত বের করে নিজের রক্তের স্বাদ নিয়ে ছিলো? সেদিনের পর থেক নিজের শরীরের একটু রক্ত নিজে পান করে মতিন। এভাবেই মতিন নিজেকে নিজে খেয়ে ফেলে। নিজেকে নিজে খাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত এক সুখ সে পায়। এই সুখের কথা কাউকে না জানিয়ে মতিন নিজেকে সমর্পণ করে নিজের লাল গামছার অন্তরালে!