আজ সকালটা আর পাঁচটা দিনের মতোই, তবুও মনোরমার সবকিছু বড় ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।আকাশ একই রকম নীল, প্রতিদিনের মতো দক্ষিণের আলসের ওপর সেই শালিকটা বসে আছে। প্রথম প্রথম এক শালিক দেখে অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠতো, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। ভেজা কাপড় টানা দড়িতে মেলে দিতে দিতে আজও বড় রাস্তা থেকে সেকেন্ড ট্রামের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেল, নীচের রাস্তায় দুধওয়ালার রোজকার ডাক ভেসে এলো। তবুও আজ মনোরমার মনটা বড়ই ফুরফুরে। এই দিনগুলোয় তার রাত থাকতেই ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু অন্ধকার না কাটলে উঠতে পারেনা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে জানলা দিয়ে আলোর একটু আভাস পেলেই তড়াক করে উঠে পড়ে। উঠে এক কাপ চা করে খায়, বাড়ির অন্য মানুষদের তখন মধ্য রাত্রি। চা খেয়ে, স্নান সেরে, ভিজে কাপড় ছাদে মেলে নীচে গিয়ে পুজোয় বসে। এ তার নিত্য দিনের রুটিন। পূজোয় একটু বেশিই সময় দেয়, সকালে ফুলের দোকানের ছেলেটি ফুলের প্যাকেটটা বাইরের দরজায় ঝুলিয়ে দিয়ে যায়। সেই ফুল, আরোও উপচার দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে পূজো করতে আধা ঘন্টা- চল্লিশ মিনিট তো লাগেই। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে আবার একবার চা বসালে তবে বাবুবিবিরা একে একে উঠবেন।
ফুরফুরে মন নিয়ে পঁয়ষট্টির মনোরমা প্রায় উড়তে উড়তে ছাদ থেকে নেমে এলো। রান্নাঘরে চায়ের কেটলি বসিয়ে গলায় গুনগুন করে গানও এলো। এইদিন গুলোয় এরকমই হয়। বাবলু আসবে নটার সময়। কালকেই ওকে বলে রেখেছে,ও যেন টাকা নিয়ে রাখে –দশটায় কাউন্টার খুললেই চারটে ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট কেটে নিয়ে আসবে।
ছোটবেলা থেকে বড় আদরে মানুষ হয়েছে মনোরমা। চার ছেলের কোলে একমাত্র মেয়ে। বাবামায়ের চোখের মণি ছিল, দাদাদেরও বড় আদরের বোন। বিয়ে হওয়ার পর কলকাতা ছেড়ে, বাবা- মাকে ছেড়ে কত দূর দেশে কাটাতে হয়েছে। স্বামী ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের উঁচুপদের অফিসার, ব্যস্ত কাজকর্মের মধ্যে কতটুকুই বা সময় দিতে পারতেন মনোরমাকে। আক্ষেপ ছিল, কিন্তু অভিযোগ কখনোই করেনি। তারপর পরপর তিন ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে করতে কখন অজান্তেই যৌবনের দিনগুলো কেটে গেছে। শখ বলতে ছিল গল্পের বই পড়া আর এক আধটা বাংলা সিনেমা দেখা। তা সেই বিদেশ বিভুঁইয়ে বাংলা ছবি আসতোই বা কটা! স্বামীর অবসরের পর কলকাতায় ফেরা। শ্বশুরবাড়ি ঘর করা বলতে তারপর। শ্বশুরমশাইরা অনেককটা ভাই ছিলেন, এজমালির সংসার, যদিও রান্নাঘর আলাদা আলাদা। প্রথম প্রথম এই ‘বারো ঘর এক উঠোন’ জীবনে মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হতো, তারপর আস্তে আস্তে সয়ে গেছে। এখানে আসার পর বড়ছেলের বিয়ে হয়েছে, এখন নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার। মেয়ের বিয়ের দেখাশোনা চলছে, লেখাপড়া জানা মেয়ে, ভালো সম্বন্ধ এলেই বিয়ে হয়ে যাবে। তা কলকাতা আসার তিন বছরের মধ্যেই তিনদিনের জ্বরে ভুগে স্বামী চলে গেলেন। তখন যদিও ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, তবু কষ্ট বুকে চেপে সামনে দাঁড়িয়ে সংসারটাকে তো তাকেই টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে। আস্তে আস্তে ছেলেমেয়েদের নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়ে গেল আর এতজনের মধ্যে থেকেও মনোরমা বড় একলা হয়ে গেল। সেইসময় আবার বইপড়ার অভ্যাসে ফিরে গেল আর নতুন নেশা ধরলো বাংলা সিনেমার। এতদিনকার উপোসী মন একেবারে রঙিন ডানায় ভর করে উড়তে লাগলো। আর তাদের এই পাড়াটাকে সিনেমাপাড়াই বলা চলে, আশপাশে নাহোক পাঁচ-ছটা নামকরা সিনেমা হল আছে।
খেয়েদেয়ে, সেজেগুজে চার জায়ে মিলে যখন হলে পৌঁছলো তখনও সিনেমা শুরু হতে আধঘন্টা দেরি। সেজজায়ের পানের খুব নেশা; স্কুলের দিদিমণি থাকাকালীন খুব বেশি খেতে পারতোনা, অবসর নেবার পর নেশা বেড়েছে। প্রতিবারের মতোই মিষ্টি পানে ঠোঁট রাঙিয়ে হলের বাইরের দেওয়ালে টাঙানো ট্রেলার ছবি দেখতে চললো। এটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা, হলে ঢুকে চরিত্রগুলিকে চাক্ষুষ করার আগে কিছু খন্ডচিত্র দেখে ছবি দেখার উত্তেজনাকে আরেকটু বাড়িয়ে তোলা। ওই জায়গায় বেশ কিছু লোক জমেছে, ওখানে যেতে গিয়েই বয়স্ক মানুষটাকে প্রথম লক্ষ করলো মনোরমা। ধবধবে ধুতি- পাঞ্জাবী, সোনার বোতাম, হাতে একটা খবরের কাগজ। সৌম্যকান্তি, চুল একটু পড়তির দিকে, তবে অধিকাংশই সাদা। খুব উদ্বিগ্ন চোখে বড়রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন। পাশ দিয়ে যাবার সময় মনোরোমার সাথে চোখাচোখি হলো। কয়েক মুহূর্ত দুজোড়া চোখ যেন অনন্তকালের জন্যে থেমে গেলো। কি এক ভীষণ আর্তিতে পরস্পরের চোখের গভীরে কিছু খুঁজতে লাগলো। কিন্তু ওই কয়েক মুহূর্তের জন্য, বাকিদের ডাকাডাকিতে কিছুটা লজ্জা পেয়েই ত্বরিত পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো মাথার ওপর সাজানো স্থিরচিত্র গুলির সামনে। ওপর থেকে গভীর চোখে উত্তমকুমার তাকিয়ে আছে, সেই গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! মাথার মধ্যে শত ভোল্টের বিদ্যুতের ঝলকানি, মুখটা বড় চেনা- কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছেনা। বহুদূর থেকে যেন ওই দৃষ্টি অক্ষাংশে-দ্রাঘিমাংশে ভাসতে ভাসতে এসে ধরা দিতে চাইছে, কিন্তু স্মৃতি কিছুটা পিছু হঠেই কঠিন ধোঁয়াশার বলয়ে আটকে যাচ্ছে। সঙ্গিনীদের তাড়নায় হলে ঢোকার মুখে লুকিয়ে পিছন ফিরে দেখলো ভদ্রলোক একইভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন; তবে এবার তাঁর দৃষ্টি বড় রাস্তার দিকে নয়, বরঞ্চ অবাক বিস্ময়ের দৃষ্টিতে উনি প্রেক্ষাগৃহের প্রবেশ দ্বারের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
সারা হল আলোয় ঝলমল করছে। নারী-পুরুষ, বাচ্ছা-বুড়োর হাঁসি-ঠাট্টা, হাঁকডাকে সিনেমাহল সরগরম। এখানে ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে যায় মনোরমার। নিজের সিটে বসে সামনে টাঙানো সাদা পর্দাটাকে এখন কিরকম বেকুব-বোবা মনে হয়। কিন্তু একটু পরেই ওই সাদা ফ্যাটফেটে পর্দা জুড়েই জীবন মুহুর্মুহু রং বদলানোর খেলা খেলবে। সিনেমা শুরু হলো, শুরু থেকেই গল্পের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে গেল মনোরমা।মধ্যাহ্ন বিরতিতে বাদামভাজা- ঝালমুড়ি খাওয়া হলো সবাই মিলে। সবাই সিনেমার গল্পে মশগুল, পরের পর্বে নায়ক-নায়িকার মিলন সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। মনোরমার মনে হলো, সবসময় মিলনই হতে হবে কেন! সব প্রেম-ভালোবাসারই কি মিলনে পরিসমাপ্তি ঘটে! দ্বিতীয় পর্বে ঘটনা আরো জমে উঠলো, অনেক বাধা বিপত্তি,ভয়-আশঙ্কা শেষে বহু কষ্ট, যন্ত্রনা, অত্যাচার, অপমান সহ্য করে যে মুহূর্তে নায়িকা নায়কের বক্ষলগ্না হলেন, সারা প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে চড়া সাদা আলো জ্বলে উঠলো।
সাহিত্য ভালোবাসার কারণে অন্যদের কি হয় জানেনা, মনোরমা নিজে একেবারে গল্পের ভিতরে ঢুকে একটা চরিত্র বনে যায়। সে তখন অন্যান্য চরিত্রদের সাথে হাঁটে, খায়, গান করে, কথা বলে। তাই ছবি শেষ হওয়ার পর অন্যরা যখন কোন গয়নার দোকানে নতুন ধরনের কনকচুড় দেখতে যাবে বা ফেরার পথে কোন মিষ্টির দোকান থেকে কচুরি আর ল্যাঙচা কিনে ফিরবে সেই আলোচনায় মেতে ওঠে, মনোরমা তখনো গল্পের মধ্যেই আটকে থাকে। কোনো কোনোদিন পরেরদিন সকাল পর্যন্ত এই ঘোর চলতে থাকে। এ নিয়ে বাড়িতে নাতি-নাতনিরা ঠাট্টাতামাশা করে আর ছেলে-বৌমারা মুখ টিপে হাঁসে। আজও সবাইয়ের সাথে বেরিয়ে সেই ঘোরের মধ্যেই ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিলো। এমন সময় ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন এসে তার পথ আটকালো, মুখ তুলে তাকিয়ে ভয়ে-আতঙ্কে সারা শরীর হিম হয়ে গেল। চোখের সামনে যা দেখছে তা বাস্তব বলে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এ কি করে সম্ভব! কয়েকঘন্টা আগে যে দুর্ভেদ্য কুয়াশাজাল ভেদ করে স্মৃতির সরণি বেয়ে চলতে গিয়ে বারবার পিছলে পড়ছিলো, ধূসর চালসে চোখে আসি আসি করেও কতকগুলো আঁকাবাঁকা রেখাচিত্র কিছুতেই ধরা না দেবার মজার খেলায় মেতেছিলো, কয়েকঘন্টার মধ্যেই সেই আঁকাবাঁকা রেখাগুলি টানটান হয়ে ঠিকঠাক জায়গায় বসে একটা উনিশ-কুড়ি বছরের সুদর্শন যুবকের মুখ শিল্পীর নিঁখুত তুলির টানে ফুটিয়ে তুলেছে। আর সদ্য গোঁফগজানো সেই স্বপ্নপুরুষ গভীর চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে একটি শব্দ বেরিয়ে এলো—তিমির!!! ছেলেটি হাঁসিহাঁসি মুখে পাশে দাঁড়ানো একজনের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মনোরমা ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন—মুখে হাঁসি, সাদা ধুতি- পাঞ্জাবিতে সজ্জিত এক সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক, হাতে খবরের কাগজ, আঙুলে সোনার আংটি , চুল পড়তির দিকে, তবে অধিকাংশই সাদা৷ দৃষ্টিতে এখন কোনো উদ্বেগ নেই।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর , ইকনোমিক্স
যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা