ভোরসকাল। ঢং ঢং আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। দক্ষিণ দিকের জানলা খুলে দিতেই ধবধবে শাদা গির্জাটা চোখে পড়ে। আজ রোববার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার প্রথম কাজ টিভি খুলে সাতটার খবরের চ্যানেলটা ধরা। খবরের চ্যানেল ধরে রিমোটটা বিছানায় ফেলে দিয়ে বাথরুমে ঢোকে। তার আগে রিমোট হাতে নিয়ে টিভির সাউন্ডটা ক্ষাণিক বাড়িয়ে দেয়। ততক্ষণে নিউজ চ্যানেলের কর্কশ সাউন্ডটা ভেসে যায় পাশের ঘরে। স্ত্রী সোমা ঘুমের মধ্যেই বিরক্তি ভাব প্রদর্শন করে কানে বালিশ চেপে রেখে আবারও ঘুম দেয়। বাথরুম থেকে সকালের প্রত্যাহিক প্রাকৃতিক কাজ সারতে সারতে রওনক শুনতে পায় অস্পষ্ট শব্দে, কোথাও কোন স্কুল ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। সেই নিয়ে বাবা মায়ের আহাজারি। সংবাদ পাঠিকার গলায় বিষন্যতা।
আকাশে ধূসর রাঙা মেঘ। ফেব্রুয়ারীর শেষ শেষ বসন্তের পাতা ঝরা দিনে হাড়কাপানো ঠান্ডা। টোস্ট মেকার থেকে টোস্টের টুকরো দুটো হাত দিয়ে ধরতে গিয়ে কিছুটা গরম সেক খায় রওনক। এতে অবশ্য পুরুষ মানুষদের কিছু হয় না। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ডগায় জিভ লাগিয়ে হাতে লাগা মাখন খানিকটা চেটে নেয়। একা একা ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে ভাবে কত কিছু। হাতে রাখা স্মার্টফোনে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক খবরা খবর দেখে নেয় ক্ষাণিকটা। ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়ে গেলে আয়নার সামনে গিয়ে টাইটা টাইট করে বেধে, ব্লেজারটা গায়ে জড়িয়ে হাতে ব্রিফ কেস নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে অফিসের দিকে।
যাওয়ার আগে দেখে নেয় স্ত্রীর রুম.. ঘুমোচ্ছে..মাথায় বালিশ চাপা থাকার কারনে মুখটা দেখা সম্ভব হয় না। পাশেই ঘুমাচ্ছে ছ’বছরের মেয়ে..রেবা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে খানিক মুচকি হেসে আলতো করে দরজা লাগিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে। লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চারতলায় থাকা লিফট কল করে বাটন চেপে। লিফট আসার পরে ভেতরে থাকা লিফট ম্যান দাঁড়িয়ে সেলুট দেয় তাকে। এতে অবশ্য তার কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না।
২.
আজ আর গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করবে না। আজ কেন যেন গাড়ি চালাতে ইচ্ছে করছে না তার।
ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে এগোয় ফুলের দোকানের দিকে। তার আগে অবশ্য টং দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে নেয়। প্রতিদিন এই দোকান থেকে চা খেতে চাইলেও, গাড়িতে বসে থাকায় নেমে আর চা খাওয়া হয় না। গাড়িতে বসে প্রতিদিন খেয়াল করে সে, মাথায় আসে কত ভাবনা চিন্তা।
এ পৃথিবীতে কেউ সুখি না। সুখ ভীষণ বাষ্পীয়.. একটু হলেই উবে যায় মানুষের মাঝ থেকে। মানুষ সুখে থাকে, সুখে থাকলে ঘুরে ফিরে দুঃখ আসে, দুঃখ আসে বলেই তো মানুষের সুখ। রওনক হাটে ফুটপাত ধরে, কত মানুষ ফুটপাতে শুয়ে আছে৷ পাতলা একটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে, কেউ কেউ গায়ে জড়িয়েছে পলিথিন কেউ আবার একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। এরা কি বেলা করে ঘুমায়? কেউ কেউ ঘুমায় হয়ত। তবে সেই ঘুম বেশিক্ষণের জন্য সুখের হয় না, ঐ যে সুখ বড় আপেক্ষিক জিনিস৷ এদেরও সকাল হয়, ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় পড়ে থাকা থেতলানো সিগারেট মুখে নিয়ে পাশের টং দোকান থেকে জ্বালিয়ে হাটে আশেপাশের কোন নির্জন নিরিবিলি স্থানে। প্রাকৃতিক কাজ সারতে সারতে তারা হয়ত চিন্তা করে, যে যায়গা খালি হয়েছে সেটি কিভাবে আবার ভরা যায়। মানুষের জীবনের এই দোলাচল হায়ার ম্যাথের জটিল সমীকরণের থেকেও বেশি৷
ফুলের দোকান থেকে কয়েকগুচ্ছ ফুল আর একটা সিগারেটের প্যাকেট কিনে রওনক পা বাড়ায়৷ আর কিছুদূর হাটকেই এখানকার খ্রিস্টান গ্রেভিয়ার্ড। গ্রেভিয়ার্ডে ঢোকার আগে কতগুলো মলিন মুখের পথশিশুরা তাকে ঘিরে ধরে।’স্যার আমারে কয়ডা ট্যাকা দ্যান, রাত্তিরে ক্ষুধার জ্বালায় ঘুমাইতে পারি নাই৷’
ততক্ষণে নাস্তার জোগাড় হয়েছে অনেক জায়গায়।নিজের ভাগের অতিরিক্ত খাবার ফেলে দিয়েছে কেউ কেউ। ‘পৃথিবীটা বড় শান্তির হতে পারতো, যদি সবাই সবার দিকে একটু মুখ তুলে তাকাতো। সবাই যদি পাখির মতো মন নিয়ে বাঁচতো। তাহলে মানুষগুলো আর শকুনের মতো হতো না। ‘, একথা রওনককে বলেছিল একজন। সে অনেক দিন আগের কথা। পেন্ডুলাম ঘড়ির ঘন্টায় দুলতে থাকা কলেজ জীবনের কথা।
৩.
সেদিন বর্ষাস্নাত দিন। আকাশ থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ঝড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় সতেজ হয়েছে গাছপালা। ধারেকাছে একটা নদী আছে, সেখানে কাকভেজা হয়ে বৃষ্টিমাথায় নিয়ে হাজির হয় ওরা দুজন। বৃষ্টির দিনে নদী যাপন। রওনক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ধরিয়ে টানতে থাকে। রজত বলে,’শালা একাই টেনে যাচ্ছিস! এদিকে ছাড়৷ একটা বিড়ি দে’। রজত.. রওনকের কলেজ জীবনের রুমমেট।
প্রত্যেক সপ্তাহে ওদের কলেজের আশেপাশের জায়গাটা ঘুরে দেখতে ভীষণ ভালো লাগে৷ সে জন্য অবশ্য একটা দিন ধার্য করা থাকে। শনিবার বিকেলের কথা, ওরা প্লান করে আশেপাশের জায়গা গুলোতে সারাদিন ঘুরবে৷ দক্ষিণ দিকের অজগরের মতো সরু আঁকাবাকা পথে হাটবে ওরা দুজন৷ গা ছম ছমে পরিবেশের ভয়ংকর স্বাদ নেবে৷ পাহাড় চূড়ায় উঠে ভিজবে বৃষ্টির শীতল ফোটায়৷ রোববার সকালে রওনককে ডাকতে আসার কথা রজতের৷ খাওয়াদাওয়া শেষ করে শরীরটা বড্ড ছেড়ে দিয়েছিলো রওনকের৷
সে রাতে স্বপ্নে শৈশবে হারিয়ে গিয়েছিলো রওনক। স্বপ্নে দেখতে পেয়েছিলো মা বাবাকে৷ মা’বাবার সাথে ছোট বোনকেও দেখতে পেলো। ছোটবোনটা ভাইয়া ভাইয়া বলে এগিয়ে আসছিলো তার দিকে ….হঠাৎ করেই সবাই উধাও হয়ে গেলো। রওনকের চোখ খুলে গেলো দরজা ধাক্কানোর শব্দে। ঘুম কাতুরে শরীর নিয়ে কোন মতে ঢলতে ঢলতে দরজা খুলে দাঁড়াতেই পাশের রুমের নরেণ হন্তদন্ত হয়ে বললো,’শিগগিরি লাইব্রেরীর সামনে চল। রজত… রজত….পুরো শব্দটি মুখ থেকে বার করতে পারলো না সে।’ ডরমিটিটরের পেছনের দিকটায় লাইব্রেরী। সামনে বাগানে গাছের সমারোহ।
রওনক সেদিন সকালের দৃশ্য দেখতে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। রজতের নিথর দেহটা ঝুলছে শ্যাওড়া গাছে। সকালের এক ঝাপটা শীতল বাতাসে গা কাপুনি শীরদাড়ায় বাসা বেধেছিলো বহুদিন। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর শোকে সেদিন থেকে কেমন যেন মন মরা হয়ে গেলো ছেলেটা। এরপর জীবন চললো জীবনের নিয়মে, ভার্সিটির লেখাপড়া শেষে মোটা অংকের টাকা সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে জীবনতাড়নায় ব্যস্ত হলেও রজতের মৃত্যুর তারিখটা আজও মনে রেখেছে সে।
রজতের কবরের এপিটাফের ওপর একগুচ্ছ ফুল রাখতেই চোখে জল টলমল হয়ে গেলো রওনকের।
৪.
রওনক ঘরে ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। টেবিলের ওপর একটা চিরকুট এক জোড়া হাতের বালা দিয়ে চেপে রাখা।
সে চিঠিতে লেখা,
রওনক! তোমার সাথে বসবাস করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। তুমি মানসিক ডাক্তার দেখাও। তুমি কোন কিছুতেই সুখী নও। বাবা মায়ের কথায় নিজের প্রেমিককে ফেলে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে এ সম্পর্ক আর বেশিদূর এগোবে না বলেই ঠিক করেছি। তুমি চাইলে মেয়েটাকে তোমার কাছে রাখতে পারো। তোমার সে অধিকার আছে। তবে তোমার কাছে থাকলে আমার মেয়ে ভালো থাকবে না। আর আমি ডিভোর্সও চাই না। আমরা আজ থেকে দুইজন দুই মেরুর। উই আর সেপারেটেড।
রওনক চিরকুটটাকে হাতে নিয়ে এগোল বাথরুমের দিকে। বাথটাবে পানি ছেড়ে গায়ের জামা না ছেড়েই নিজেকে লুটিয়ে দিলো বাথটাবের উষ্ণ গরম জলে। তার এক হাতে রাখা চিরকুটটাকে সে কয়েকবার পড়লো। সেদিন সারাদিন মন খারাপের দিন শেষে একটি বিষণ্য সন্ধ্যা নেমে এলো শহরের বুকে, জ্বলে উঠলো স্ট্রিট লাইট।