দু’কদম হেটে থেমে গেলাম । আকাশটা কালো মেঘে ঠেকে আছে । আমি একা হাটছি পথে । আজ আমার মণ খারাপ । ভীষণ বিষন্ন । সামনে একটা চায়ের দোকান খোলা পেলাম । দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ফুড় ফুড় করে টানতে টানতে হাটছি । ক্ষুধা লেগেছে । অস্বাস্থ্যকর কথা হলেও ব্যাচেলরদের পকেটে টাকা না থাকলেও ক্ষুধা নিবারণের সবথেকে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে সিগারেট টানা । আমার বড় দুলাভাই আমার মগজের এই কথা জানতে পারলে আকতকে উঠতেন । বড় দুলাভাই ডাক্তার । তার সাথে খেতে বসলে তিনি শুধু ডাক্তারি কথা বলেন । উপদেশ দেন । আমি খেতে খেতে উপদেশ শুনি । ভালো লাগে ,আবার মাঝেমধ্যে খারাপও লাগে । দুলাভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে বিষম খাই । বড় আপা এসে দুলাভাইকে ধমক দেন । সেই ধমকে বাধে বিপত্তি ! আপা – দুলাভাইয়ের মধ্যে তর্কাতর্কী শুরু হয় । এই তর্কি গিয়ে থামে বিভৎস শব্দপ্রেমে । তারপর আপার কান্না শুরু হয় ,তিনি আজবাজে শব্দে দুলাভাইকে গালিগালাজ করা শুরু করেন । দুলাভাই সেই গালিগালাজ শুনে নিজের গালিগালাজের ডিকশনারি খুলে বসেন । আমি প্লেটটা বেসিনে ফেলে রেখে পাশের রুমে গিয়ে বসি । এই থমথমে অবস্থা বেশিক্ষণ থাকলে দু একটা প্লেট-গ্লাস ভেঙে প্রলয়ের সৃষ্টি হয় ।
আজ বোধয় নিম্নচাপ । তেমন একটা শীত নেই । আকাশে মেঘ জড়ো হয়েছে । বৃষ্টি শুরু হয় কিনা কে জানে । আপার বাসা আর দু গলি পড়ে । পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বের করে দেখলাম পারায় তিনটা বাজে । এই সময়ে আপার বাসায় যাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারলাম না ।
২.
বেলা গড়ানো দুপুরে আপার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। বাসার সামনের গেটে তালা দেয়া। কিন্তু ভেতরের দরজা জানলা খোলা। আমি তালাটা হাত দিয়ে ধরলাম। সিগারেট টেনেছি বলে গা থেকে ভক ভক করে সিগারেটের গন্ধ আসছে। যদিও এ গন্ধ আমার কাছে তেমন কটু না। তালাটা ধরে বার দুয়েক নাড়া দিলাম। ভেতরে সাড়া শব্দ নেই। পেছন ফিরে মেইন গেটের দিকে দু পা বসড়াতেই ডাক এলো,” অ্যাই টুকু? ” আমি পেছন ফিরে তাকালাম। আমার হাসতে ইচ্ছে করছে না তাও আপার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিলাম। আপার মুখ গোমরা। বোঝা যায় বাসায় বেশ বড়সড় কিছু একটা হয়েছে। আপার চোখের কোনে জল। গালে চোখের জল শুকিয়ে দাগ পড়েছে। যেন কোন শুকনো নদী বয়ে গেছে আপার গালে।
আপা কেঁদে দিলো । ভেউ ভেউ করে কাঁদলো। আমি আপাকে বলতে চাইলাম- কেঁদো না। আশেপাশে মানুষজন কি ভাববে;এই কথা আমার অভ্যন্তরেই রয়ে গেলো। আপা কাঁদতে কাঁদতে বললেন- তোর বদ দুলাভাই আমাকে মেরেছে। দেখ হাতের কি অবস্থা করেছে! আমি চেয়ে দেখলাম- আপার হাতে কালো দাগ৷ আপা ফোপাঁতে ফোপাঁতে কাঁদলেন। তারপর দুলাভাইয়ের নাম নিয়ে তার চোদ্দগুষ্টি নিয়ে একে একে গালি শুরু করলেন। আমার মাথা ধরেছে। এতক্ষণ অস্বস্তি লাগেনি! পাশের বিল্ডিং থেকে মানুষজন তাকাচ্ছে দেখে অস্বস্তি লাগছে।
আপা বললেন,’তোর দুলাভাই আমাকে আটকে রেখে চলে গেছে। তুই তালা ভাঙ টুকু। আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যা। আমি এই পিশাচ এর সাথে সংসার করতে পারবো না। ‘আমি আরেক দিকে তাকিয়ে থাকলাম! আপা তার মন মতো বকে গেলেন। আমার দীর্ঘক্ষণ ধরে মাথা ব্যথা করছিলো দেখে, অস্ফুটস্বরে আপাকে বললাম,’আপা আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি যাই! ‘ আপা তার কথা থামিয়ে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। আমি কি করব বুঝতে পারলাম না। আপার দিকে তাকাতে পারছি না। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রুজল ঝরছে৷
৩.
মা মারা গেলেন হঠাৎ করেই। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। শ্রাবণ মাসে স্কুল মাঠে ফুটবল খেলছিলাম। সেদিন শেষ বিকেলে বৃষ্টিও নেমেছিলো। চারপাশে বাজ পড়ছিলো। বাজ পড়ার সাথে সাথে আমরা মাঠ থেকে উঠে গেলাম। রহমত চাচাকে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে আসতে দেখলাম। তিনি বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াচ্ছেন এবং তার লুঙ্গি সামলাচ্ছেন। আমি এগিয়ে গেলাম লাইব্রেরী রুমের দিকে। বাজ পড়লো বিকট শব্দে! রহমত চাচা আছাড় খেলেন। আমার ভেতরটা কেমন ধড়মড় করে উঠলো। রহমত চাচা মাটিতে পড়ে থেকেই আর্তনাদের গলায় বললেন,’ওরে টুকুরে। শিগগিরই বাড়িতে চল! আমি কিছুই বুঝতে উঠতে পারলাম না৷ যতদুর বুঝলাম, বাড়িতে বড়সড় বিপদ হয়েছে। আমি দৌড়াতে লাগলাম। নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে৷ বৃষ্টি থেমেছে,আকাশ গুড়ুমগুড়ুম করছে। দক্ষিণের আকাশে ছাই রঙের মেঘের দল উড়ে যাচ্ছে। মা মারা গেলেন বজ্রপাতে! সন্ধ্যে বেলায় তিনি আমাকে এবং তার হাসমুরগিকে খুঁজতে বের হয়েছিলেন। বজ্রপাত তার গায়ে পড়লো। তিনি আমাকে খুঁজে পেলেন না! চলে গেলেন দূরে কোথাও! অপারে!
৪.
আমি ঢাকায় মেসে থাকি। মেস জীবনই আমার ভালো লাগে। বাবা মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসেন। তবে তিনি আমার মেসে আসেন না। আপার বাসাতেও যান না।মাঝেমধ্যে যান, হুট করেই। তবে তিনি সেখানে কিছুই খান না। বাবার ভাষ্যমতে দুলাভাইয়ের সব টাকা হারাম।দুলাভাই গোপনে সুদের ব্যবসা করেন।বাবা মাঝেমধ্যে আফসোস করে বলেন,কেন যে হারামজাদার সাথে মেয়েটা বিয়ে দিলাম। বাবা থাকেন বোডিংয়ে। সদরঘাটের আশেপাশে। আমাকে সদর ঘাটে যেতে হয়, বাবার সাথে দেখা করতে।আমাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান।খেতে খেতে গল্প করেন৷ খাওয়া শেষ হলে আমাকে হাত খরচার টাকা দিয়ে যান৷ বাবা প্রতিমাসেই ঢাকায় আসেন।
তিনি আজ ঢাকায় এসেছেন। আপার বাসায় উঠেছেন। আমি ঘুম থেকে উঠতে দেরী করলাম। শরীরটা খারাপ লাগছে। ঠোট ফুলে উঠেছে। গ্রামের ভাষায় একে বলে, “জটঠোশা” রাতে জ্বর হলে এমন হয়।
আমি দুপুর নাগাদ আপার বাসায় গেলাম। গলির মোড়ে দুলাভাইয়ের সাথে দেখা হলো। দুলাভাই আমাকে দাড়া করে নানান ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন৷ তার প্রথম প্রশ্ন,”টুকু তুমি আজকাল সিগারেট টানো নাকি?”
“ব্যাড, ভেরি ব্যাড ” তুমি ইয়াং ছেলে তুমি সিগারেট কেন টানবে? তুমি আয় রোজগার করো না। তোমার বাবার টাকায় চলো..তোমার পিতামহশয় তিনিও এক বিরল কান্ড ঘটিয়ে বসেছেন। সেই বিরল কান্ড আসলেই বিরল। আপা আমার সামনে বসে হু হু করে কাঁদছেন। পরপর আপাকে কাঁদতে দেখে আমারও মনটা বিষিয়ে উঠেছে। আপা কাঁদছেন কারন, বাবা বিয়ে করেছেন৷ আপা বাবার নামে উল্টাপাল্টা বলতে শুরু করেছেন। আমার বাবার প্রতি কিঞ্চিত অভিমান হচ্ছে না৷ আপার ভাষ্যমতে, দুলাভাই আপাকে বলেছে…বাবা নাকি সদরঘাটের এক বেশ্যাকে বিয়ে করেছেন৷ বাবা নাকি বরিশাল থেকে এসে ওখানেই রাত্রীযাপন করতো। সেই বেশ্যা ছিলো শুধু বাবার জন্য বরাদ্দ।
আমি আপাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। দুলাভাই এত খবর কোত্থুকে জানে? সেও কি সেখানে যায়? গোটা শহরটাকে আজ অচেনা মনে হচ্ছে! গোটা শহর আমায় বলছে “তোর বাবার সাথে বেশ্যার বিয়ে হয়েছে” আমি শহরকে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি,’বেশ্যারাও মানুষ হয়’
৫.
এক মাস ধরে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছি। মেস ভাড়ার জন্য ম্যানেজার এসেছিলো। সে আমার অসুস্থতার কথা দেখে কোন টাকা নেয়নি বরং দু দু বার ফল-ফলাদি নিয়ে এসে আমায় দেখে গেছে। আমার অসুস্থতা দিন দিন বাড়লো৷ এক সন্ধ্যে রাতে অস্বাভাবিকভাবে জ্বর বেড়ে গেলো। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। বড় আপা এলেন৷
বাবা এলেন পরেরদিন সকালে। আমার ভয়বহ রকমের কোন রোগ হয়েছে বুঝতে পারছি৷ বাবার সাথে আরো একজন এলেন। তিনি আমার বাবার নতুন স্ত্রী.! আপার ভাষ্যমতে তিনি একজন..
তিনি এলেন কালো বোরকা পড়ে৷ তার চোখগুলো সুন্দর লাগছে। তিনি আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। নেকাব খুললেন তার চেহাড়া আমার মায়ের মতো। তার গা থেকে গন্ধ আসছে। মশলার গন্ধ..!
[ আপনার মতামত জানাতে পারেন, আপনার মতামত আমাদের কাছে অত্যান্ত মূল্যবান]
বাংলাবাজার, বরিশাল।