শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
ষোলোর পল্লী আর বিপ্লবী সংঘ। শৈশবের দূর্গা পুজোর কথা বললে প্রথমেই ভেসে আসে আমাদের পাড়া ঘরের এই দুই পুজো প্যান্ডেলের নাম। এরা উভয়েই ছোটো ছোটো সীমাবদ্ধ পা ফেলে চলা আমার সে বাল্য, শৈশবের পুজোর আনন্দের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত। এদেরকে ঘিরেই শুরু হতো আমার শিশুবেলার পুজো পরিক্রমা।
আমাদের বাড়ির যতটা কাছে বিপ্লবী সংঘ, ঠিক ততখানি হাতের কাছে অবশ্য ষোলোর পল্লী নয়। বাড়ির সামনে রেল স্টেশন। স্টেশনের পারে একটা পুকুর। সেই পুকুরের ওধারে পৌরসভার খালি জমিতে ষোলোর পল্লীর পুজো হত…যে প্যান্ডেলের চেহারাটুকু আমাদের তিনতলার ছাদে উঠলে বেশ পরিষ্কার দেখা যেত। চিলেকোঠার ছাদে দূর থেকে দাঁড়িয়ে যখন দেখতাম ষোলো পল্লীর বাঁশ ফেলা শুরু হয়েছে…কি যে আনন্দ হতো তখন…শরতের আকাশে মাখামাখি সে আনন্দের রেশটুকু নিয়েই যেন দেবী প্রতিমা এসে দাঁড়াতেন আমার ছোট্ট খেলাঘরের চৌকাঠে। আস্তে আস্তে সে অবয়ব প্রকাশ পেত আমার রঙ তুলিতে। সে কোনো নিখুঁত শিল্পীর আঁকা প্রতিমা নয়। সে আমার একান্তের অনেকগুলো হিজিবিজি রঙের মধ্যে একটি। ধীরে ধীরে আরো কত রঙ পড়তো তাতে! আত্নীয় স্বজনের দেওয়া রঙচঙে জামার গন্ধে, ষোলোর পল্লীর পুজো প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে রেল স্টেশন ছাড়িয়ে কাশবনকে বাঁ হাতে রেখে ইস্কুল যাবার পথে বন্ধুমহল, পাঁচের পল্লী, স্বরলিপি ক্লাব, মহাজাতি সংঘের পুজো প্যান্ডেলের কাঠামোগুলো দূর থেকে অবলোকন করতে করতে, ইস্কুলে বন্ধুরা মিলে কে কটা জামা পেল তাই নিয়ে গল্প গাছায়, হেড মাস্টার মশাইয়ের বলে যাওয়া কথা..’ কাল সক্কলে তোমরা নতুন নতুন জামা পড়ে স্কুলে আসবে…কাল আর ইউনিফর্ম পড়তে হবে না..নাম ডেকে তোমাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে..’
আমার সে রঙতুলিতে এইভাবেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন দেবীপ্রতিমা। বাঁধনছাড়া আনন্দে ভাসতে ভাসতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো আমার সে শরতের আকাশ। সে আলো ঝলমল করে উঠতো ব্র্যাডলে ট্যাঙ্কের পুকুরের জলে, পুকুরের পাশের রূক্ষ্ণ শুকনো মরা জমিটা ভরে উঠতো আলোয় আলোয়…ঘূর্ণি, নাগরদোলা,ভাজাভুজি, ফুচকার স্টল, বন্দুকে বেলুন ফাটানোর দোকান..কত কি পসরা সাজিয়ে বসে যেত বিকিকিনির হাট…কত মানুষ কত দূর থেকে এসে মেলা বসাতো সেখানে…চারটে দিন লোকজনে ভরে উঠতো আমাদের বাড়ির বারান্দার গায়ে লাগানো রাস্তাঘাট, নেতাজি সুভাষ পথের চৌহদ্দি টুকু….এসবই সম্ভব হতো ষোলো পল্লীর পুজো প্যান্ডেলের দৌলতে…কাঁচরাপাড়া অঞ্চলের অন্যতম বড় পুজোর মধ্যে একটি ছিল ষোলোর পল্লী… সেদিনও ছিল, আজও তাই…পাশাপাশি বিপ্লবী সংঘের পুজো ছিল নেহাৎই পাড়াঘরের ছোটোখাটো বারান্দা প্যান্ডেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ…সেই ট্রাডিশন আজও রয়ে গেছে সমান্তরালে….স্মৃতি যেমন শেষ হবার নয়…বড় ছোট ভেদাভেদ ভুলে সে দুই পুজো প্যান্ডেলের আবেগও আমার কাছে শেষ হবার নয়। ষষ্ঠীর সকাল থেকে দুই মন্ডপে পালা করে আনাগোনা, নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে মায়ের সাথে হাত ধরে এসে বিপ্লবী সংঘে অঞ্জলি দেওয়া, ঝলমলে আলোয় ভরা ষোলোর পল্লীর মন্ডপ প্রাঙ্গন….উজ্জ্বলতা আর সাদামাটা…প্রতিমার এই দুই রূপকে কিছুতেই আলাদা করে ভাবতে পারতাম না। মনে একটাই আবেগ কাজ করতো। আনন্দ।
ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। হঠাৎ দেখি বাংলার স্যার যোগেন বাবু আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। আমায় দেখে ঈষৎ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,’ তোদের পুজা কোনটা রে?’
হোঁচট খাবার মতো থেমে গেলাম যেন। দুটো পুজোই যে আমার কাছে একই আনন্দ আর বেদনার সুরে বাঁধা। তবু কি জানি কেন, সেদিন আচমকা আবিষ্কার করলাম আমি, বিপ্লবী সংঘের মা দূর্গার মুখখানা ঠিক যেন আমার মায়ের মুখের আদলে গড়া। চোখ বুজে একমনে মা যেমন করে অঞ্জলি দেন ঠিক তেমন করেই মায়ের হাত থেকে প্রণাম মন্ত্রের ফুল টুকু নেওয়ার জন্য দেবী যেন একদৃষ্টে ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে থাকেন। আবার বিসর্জনের দিন বরণের সময় মা যখন পরম যত্নে পানপাতা দিয়ে মুছিয়ে দেন প্রতিমার মুখখানা, দেবীর সে কোমল করুন মুখচ্ছবির মাঝে যেন আমার মায়েরই হৃদয় নিঃসৃত স্পর্শটুকু মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। যা হয়তো অনুভব করেছি সময় সময়, কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ করা হয়নি, সেই শব্দগুলো সেদিন যেন অগোচরে কে বলিয়ে দিল আমার মুখ থেকে…’ ঐ যে স্যার, সোজা রাস্তা ধরে বাঁদিকে গেলে একটা নিমগাছকে ঘিরে প্যান্ডেল করা হয়েছে…ঢাকের বাদ্যি বাজছে…ওটাই আমাদের পুজো..বিপ্লবী সংঘ..’
আমার মায়ের সে দেবী প্রতিমার মুখখানা কোথায় যেন আজও আমায় টেনে রেখে দিয়েছে। সময় পালটেছে, কত বিবর্তন এসেছে দূর্গা প্রতিমায়, থিম পুজোর রমরমার আড়ালে মুখ ঢেকেছে কত সাবেকি বনেদিবাড়ির দূর্গা পুজো…যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ কাঁচরাপাড়ার বিজয় নন্দীর বাড়ির ডাকেস্সাজের সে দূ্র্গা প্রতিমা…আয়োজন কিংবা বহর কমতে কমতে একসময় আধো অন্ধকারাচ্ছন্ন নীচের তলার নাটমন্দিরে টিমটিম করে জ্বলতো মন্ডপের আলোটুকু…বহুকাল হয়ে গেল বিজয় নন্দীর সে বাড়ি আজ আর নেই… নেই সে একশো বছর ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে হয়ে আসা সাবেকি পুজো…সে বাড়ি আজ ফ্ল্যাট বাড়িতে পরিণত…শৈশবের চোখ দিয়ে দেখা ছেঁড়াখোড়া পুজোর স্মৃতিগুলোকে মাটির গহ্বর থেকে তুলে এনে ইঁটপাথরের মতো জড়ো করে যেটুকু পারছি রোমন্থন করার চেষ্টা করছি মাত্র। কাঁচরাপাড়ার এককালের সেরা পুজো বলতে লোকে একবাক্যে স্বীকার করতো আর.পি. হাই স্কুলের দূর্গা পুজোর কথা। দেবী প্রতিমা থেকে শুরু করে প্যান্ডেল, সাজসজ্জা, আলোর রোশনাই… সবকিছুর বিচারে তাবত কলকাতার যেকোন লব্ধপ্রতিষ্ঠ পুজো প্যান্ডেলকে হার মানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে আর পি হাই স্কুলের পুজো। কৃষ্ণ নগরের প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী মুক্তি পালের হাতে গড়া আর পি স্কুলের দূর্গা প্রতিমা যেবার রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আমার জন্মভূমির নাম উজ্জ্বল করলো, সেবার ওরা বেলুড় মঠকে সামনে রেখে প্যান্ডেলের রূপদান করেছিল। তার আগের বছর বাকিংহাম প্যালেস। আমার ঢাকুরিয়ার এক দাদা আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রতিমা দর্শন করে, তারপর পুজোর সময় দেখা হলেই সে বাবাকে বলতো ‘ তোমাদের ঐ আর পি স্কুলের পুজো প্যান্ডেল দেখে আসার পর আমি এখন আর কলকাতার ঠাকুর বিশেষ দেখতে বেরোই না..বলতে গেলে দেখাই ছেড়ে দিয়েছি…বিশ্বাস করবে কি করবে না জানি না..এখনো চোখে লেগে আছে ঐ গ্রীক ভাস্কর্যের আদলে তৈরি অনুপম সে দেবী প্রতিমা.. ‘
তখন কি আর জানতাম, সেটাই হবে আর পি স্কুলের শেষ দূর্গা পুজো! পুজো কমিটির বিভাজন, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের অসহযোগিতা,অর্থ সমস্যা… নানান কারনে একেবারে বন্ধই হয়ে গেল স্পটলাইটের সবটুকু আলো কেড়ে নেওয়া সে দূর্গা পুজো। কতই বা বয়স তখন আমার। জীবন সম্পর্কে কতটুকুই বা চোখ খুলেছে!
বাকিংহাম প্যালেস, বেলুড় মঠের ছাঁচে গড়া প্যান্ডেল, মুক্তি পালের ঠাকুর, প্রবল ভীড়ে হারিয়ে যাবার ভয়, পাশে দাঁড়ানো বাবার শক্ত করে ধরে থাকা আমার কচি দুহাতের মুঠো, পরিবার পরিজনের সাথে হাতে হাত ধরে, বেল বট্স এর খাঁজে ক্যাপ পিস্তল ভরে, রঙচঙে জামায় মিশে থাকা পুজোর গন্ধ টুকু বুকে জড়িয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোনো, হেমন্তের সন্ধ্যার মতো ঝুপ করে নেমে আসা বিসর্জনের সুর, মা কাকিমা জ্যাঠাইমা মিলে খাওয়া দাওয়া সেরে দুপুর বেলা গোল হয়ে উঠানে বসে মাছ সন্দেশ ছাপা সন্দেশ নারকোল নাড়ু জিভে গজা তৈরির সেসব দিন, বাড়িতে কত এসোজন বসোজনের আনাগোনা, মা জেঠিমার সাথে মিলে পাশের প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে বিজয়া দশমীর নেমন্তন্ন রক্ষা ….সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে আসতো ক্রমশ…নিস্তব্ধ নিরালা বিপ্লবী সংঘের মন্ডপের উঠান চত্বরে ইতিউতি ছড়ানো সুতো ছেঁড়া ফুল, মালার অবশিষ্টাংশ, বাজি, পটকার পোড়া অংশ, বোঁদে, মিষ্টির টুকরো, সিঁদুর খেলার সিঁদুর….নিশ্চুপ সে পৃথিবীর মাঝে মায়ের বেদীতে সাঁঝবাতি হয়ে জ্বলতে থাকা প্রদীপের টুকরো শিখা…একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতে দেখতে জল এসে যেত চোখে …হঠাৎই বড় মন কেমন করে উঠতো মায়ের জন্য….মা বলতেন..’ কাঁদছিস কেন খোকা…একটা বছর…আবার ঘুরে আসবে..আমাদের ছোটোবেলাতেও ঠিক এমনটাই লাগতো…’
ততই শক্ত করে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরতাম মাকে।
জানি, সময়গুলো আর ফিরবে না। ফিরতে পারে না। শুধু পৃথিবীর বুকে আলো হয়ে বেঁচে থাকে কিছু ছবি। সে জায়গাটুকু শুধু আমারই। আমার একান্ত নিরালার জানলা।
বয়স আরো খানিক বাড়লে আরো কত ভিন্ন রঙের ছবি এসে ভীড় করে এলো স্মৃতির পাতায়। ভালো লাগার বৃত্তটা বড় হলো ক্রমান্বয়ে। জীবন শেখালো পুজো মানেই শারদীয়া পত্রিকা…নতুন শব্দের বিন্যাস…কাহিনীর নতুন নতুন জাল বিস্তার…পুজোর আনকোরা গন্ধে ভরা নতুন প্রচ্ছদ আর অলংকরন… যার আশায় মুখিয়ে থাকা প্রায় গোটা বছর…শব্দের ভেলায় ভর করেই শরতের আকাশ যেন একরাশ প্রজাপতির মতো গান হয়ে ফুটলো জীবনে….” আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে কি জানি পরান কি যে চায়…”
শিখলাম, পুজো মানেই শারদীয়ার গান….রবীন্দ্র, আধুনিক, ছায়াছবির মিলিত কিরণ….হেমন্ত, মান্না,আশা,লতা,কিশোর, নতুন যুগের কত নবতম শিল্পীর নতুন নতুন রেকর্ডিং…পুজো মানেই পাড়ার মাইকে বারেবারে ফিরে ফিরে আসা স্বর্ণযুগের স্বর্ণকন্ঠ… …..’ মৌ বনে আজ মৌ জমেছে বৌ কথা কও ডাকে…মৌমাছিরা আর কি দূরে থাকে…’
বাবা বলতেন,’ সেসব দিন কোথায় চলে গেছে… স্পল্ডিং মাঠ থেকে ফুটবল খেলে ফিরছি…লক্ষী সিনেমা হলে তখন গানটা চলছে…সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত “বন্ধু” ছায়াছবি…সেকি আজকের কথা…সাতান্ন সাল…ভাবলে মনে হয় একশো বছর আগে ফেলে এসেছি… অথচ আজও ছবির মতো…’
সেই টানটুকু থাকে বলেই বোধহয় ফিরে ফিরে আসে আরো কত কি….আসে অনেকদিনের পুরোনো সখ্যতা,পুরোনো বন্ধুত্ব, পুরোনো সেই আড্ডা, হারিয়ে যাওয়া হাসি, কান্নার রেশটুকু…
ফিরে শুধু আসে না সময়…. পুরোনো হয়ে যাওয়া শারদীয়ার মলাট প্রচ্ছদ, ধূলো জমা ফিতে জড়িয়ে যাওয়া এইচ এম ভি র ক্যাসেট, একান্নবর্তী পরিবারের পুজোর স্মৃতি…..
ঝলমলে রকমারি আলোর মাঝে হাঁটতে হাঁটতে সহসা থমকে দাঁড়াই ক্ষয়ে যাওয়া প্লাস্টার, স্যাঁতসেঁতে, ড্যাম্প ধরা বাড়িটার সিংহদুয়ারের কাছে এসে। ভেতরে অল্প আলো। অল্প কিছু মানুষ। জৌলুশহীণ নাটমন্দিরে ঢাকের বাদ্যি বাজছে। ধূনি জ্বালিয়ে, ঘন্টাধ্বনি দিতে দিতে একমনে আরতি করছেন পুরোহিত। পারিবারিক ছায়ায় ঢাকা ডাকেস্সাজের মাতৃপ্রতিমা। বিজয় নন্দীর বাড়ির দূর্গা পুজো আজ ইতিহাস। অতুল পালের বাড়ির পুজো তো বেঁচে রয়েছে। এ ই বা কম কি!
আর পি স্কুলের সে গ্রীক ভাস্কর্যের ইতিহাস…না হয় রয়েই গেল বিস্মৃতির অতলে….নিভৃত প্রদীপের শিখার আড়ালে আজও আঁক কাটে ‘ বিপ্লবী সংঘ ‘ নামটুকু….নিমগাছকে ঘিরে থাকা এক টুকরো বারান্দা প্যান্ডেল….বছর বছর এভাবেই ফিরে আসে মা আমার…আমার শৈশবের মাতৃদেবতা…সে সময়টুকু আজও যে আমাকে ছাড়তে পারে নি।।