মাতৃভাষা বাংলা ও ইসলাম

মাতৃভাষা বাংলা ও ইসলাম

ইমরান হাসান  

এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন (হচ্ছে): আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণসমূহের মধ্যকার তারতম্য। এতে জ্ঞানীগণের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে। এই কথাটি মহাগ্রন্থ আল কুরআনে লিপিবদ্ধ করে আল্লাহ রাবুল আলামিন আমাদের মাঝে মাতৃভাষাকে তাঁর এক নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন।সুরা রুম আয়াত নং ২২ 

ভাষা, আমাদের মাঝে জ্ঞানের বাহন, সেই সময়ে আরবি এর ন্যায় সমৃদ্ধ ভাষা ছিল হাতে গোনা, আমাদের মাঝে আরবি, অ্যারামিক এইসমস্ত ভাষাতেই ধর্মগ্রন্থ সমূহ অবতীর্ণ হয়েছে, কেননা এসমস্ত ভাষার গঠন শৈলী এবং মাধুর্য সেই সময়েই অনেক উন্নত ছিল। 

কুরআনে এই কথাটিও আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উল্লেখ করেছেন যে,

নিশ্চয়ই আমি এটিকে কোরআনরূপে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো। [সুরা : হুদ, আয়াত : ২ ]

তবে ভাষার বৈচিত্র্য এবং জ্ঞানের বাহন হিসেবে এর গুরুত্ব কতখানি , সেটি আমরা জানতে পারি ইসলামিক সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কাজ করলে পারে, ধারণা করা হয় যে “আমার ক্ষমাশীলতা আমার ক্রোধ কে অতিক্রম করেছে”, এই বাক্যটি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করার পরেই সৃষ্টিকার্য শুরু হয়। 

এর ফলে এটির ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে ভাষা এবং লেখনি তথা কালাম এবং ইলম কতখানি গুরুত্ব রাখে ইসলাম ধর্মে।

এই কারণে ভাষা এবং লেখনীর দ্বারা সৃষ্ট এই জগতে ভাষা সকল কিছুর ক্ষেত্রে সর্বউৎকৃষ্ট বাহন হিসেবে বিবেচিত হবে এটাই স্বাভাবিক। 

আমাদের মাঝে বাংলার যে বিকাশ সেটিও এই ইসলামের হাত ধরেই হয়েছিল, আমরা পাল আমলে যে বাংলার অবস্থান দেখেছিলাম, সহসা সেনযুগে এসে সেই বাংলার অবস্থান একেবারেই নড়বড়ে হয়ে যায়, এমনকি এটাও বলা হয়ে থাকে যে , কোন ব্যক্তি যদি বাংলা ভাষাতে কাব্য রচনা করে তবে তাকে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে, শাস্ত্র কথা শুরু সংস্কৃত ভাষাতে শোনা যাবে আর সংস্কৃত শুধুমাত্র উচ্চ বর্ণের মানুষজনেরাই শুনতে পারবে, যদি তারা(অন্ত্যজগণ) সংস্কৃত শিক্ষা অথবা শোনার পর্যন্ত চেষ্টা করে তাহলে তাদের কানে গলিত সিসা ঢেলে দেবার বিধান চালু করা হয়। এর মাঝে অদ্ভুত সাগর,দান সাগর, পবনদূতের কাব্য সবই রচিত হয় সংস্কৃত ভাষাতে। 

বাংলা কাব্যের একটি মাত্র পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন আমরা লাভ করতে সমর্থ হইনি। তবে আমরা অন্ধকারযুগের সাহিত্য নিদর্শন সেক শুভদয়ার মাঝে প্রথম দেখতে পারি অন্ত্যজদের মুসলিমদের বা শেখগণের আগমনের স্তুতি এবং তাদের হর্ষ।

সেক শুভদয়া মূলত রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র রচিত, তবে এটি তিনি সম্ভবত ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে রচনা করেন, যখন লক্ষণ সেনের রাজত্বকাল তুর্কি শক্তি দ্বারা নির্বাপিত হয়ে গেছে। এটি লক্ষণ সেন ও শেখ জালালউদ্দিন তাবরেজির অলৌকিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। এতে নানা ঘটনার মাধ্যমে মুসলমান দরবেশের চরিত্র ও আধ্যাত্নশক্তির পরিচ্য় দেওয়া হয়েছে।সেই সময়ে ইসলামের যে বিজয় সংগঠিত হয়েছিল, সেই বিজয় গাথাই যেন আমরা দেখতে পারি এই রচনার মধ্যে, আর ইসলাম ও ইসলামের মাহাত্ন্য প্রচারের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা কতটা গুরুত্ব রাখে সেটি আমরা সেক শুভোদয়ার ক্ষেত্রে দেখতে পাই। 

এর মাঝে রয়েছে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শনের একমাত্র প্রেম সঙ্গীত তবে সেক শুভদয়ার ভাষাকে অশুদ্ধ বাংলা বলে ধরে নেওয়া যায়, এই কারণে ধারণা করা যায় যে বিশুদ্ধ বাংলার ধারক বৌদ্ধগণ তখন সাহিত্যচর্চা থেকে অনুপস্থিত ছিল। 

এখান থেকে আমরা একটি প্রেম সঙ্গীতে দরবেশের নিকট এক স্ত্রীর আকুতি দেখতে পাই 

হঙ জুবতী পতিএ হীন।

গঙ্গা সিনায়িবাক জাইএ দিন॥

দৈব নিয়োজিত হৈল আকাজ।

বায়ু ন ভাঙ্গএ ছোট গাছ॥

ছাড়ি দেহ কাজ্জ মুঞি জাঙ ঘর।

সাগর মৈদ্ধে লোহাক গড়॥

হাত জোড় করিঞা মাঙ্গো দান।

বারেক মহাত্মা রাখ সম্মান॥

বড় সে বিপাক আছে উপাএ॥

সাজিয়া গেইলে বাঘে ন খাএ॥

পুন পুন পাএ পড়িআ মাঙ্গো দান।

মৈদ্ধে বহে সুরেশ্বরী গাঙ্গ॥

শ্রীখাণ্ড চন্দন অঙ্গে শীতল।

রাত্রি হৈলে বহএ আনল॥

পীন পয়োধর বাঢ়ে আগ।

প্রাণ ন জায় গেল বহিঞা ভার॥

নয়ান বহিঞা পড়ে নীর নিতি।

জীএ ন প্রাণী পালাএ ন ভীতি॥

আশে পাশে স্বাস করে উপহাস।

বিনা বায়ুতেঁ ভাঙ্গে তালের গাছ॥

ভাঙ্গিল তাল লুম্বিল রেখা।

চলি যাহ সখি পলাইল শঙ্কা॥

 

আমরা দেখতে পাই যে কেমন করে শেখের নিকট আহবান করেছে একজন নারী, যে তার বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করে যেন শেখ, বা ইসলামিক বুজুর্গ। 

আমরা আরও দেখতে পাই শুন্যপুরাণ কে, আমির হামজা সহ সারি, আর জারি গানকে, যে জারি গানের মাধ্যমে আমরা ইসলামের প্রচার দেখেছি ভাটির দেশে, যে জারি গান আর মর্সিয়াতে আমরা দেখতে পেয়েছি হাসান আর হুসেইন এর কারবালাকে। আমরা আরও দেখতে পারি যে ইসলাম অনুযায়ী সকল দেশের মাতৃভাষাকে সমান গুরুত্ব দেবার প্রবণতাকে এবং সেটি আবুল মুজাফফর উপাধি ধারণকারী হিন্দুস্তান এবং বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ সবথেকে বেশী করেছেন, এরই কারণে পতিত রামাই পন্ডিত তার শুন্যপুরাণে উল্লেখ করেছেন, যে কেমন করে একের পর এক রাজ্য ইসলাম কর্তৃক বিজিত হল এবং সেই বিজয় যেন তার আপন বিজয়, কেননা তার রচিত কাব্যে আমরা দেখতে পাই নিম্নরূপ সুর 

এই কবির পুত্রকে এই অভিশাপ প্রদান করা হয়েছিল যে তিনি হবেন ডোমের পুরোহিত। 

এই কারণেই হয়ত তিনি রচনা করেছিলেন রুস্মা নামক এক অদ্ভুত কাব্য যাতে তিনি সেই সময়ের সনাতন ভাষাতেও ইসলামের জয়ধ্বনি করেছেন। 

 

জাজপুর বাদি, সোল শা ঘর বেদি,

বেদি লয় কন্ন এ লগুন।

দক্ষিণ্যা মাগিতে জায়, জার ঘরে নাহি পায়

শাপ দিয়া পোড়ায় ভুবন ॥

মালদহে লাগে কর, ন চিনে আপন পর

জালের নহিক দিশপাশ।

বলিষ্ঠ হইয়া বড়, দশ বিশ হৈয়্যা জড়,

সদ্ধর্মীরে করে বিনাশ ॥

বেদে করি উচ্চরণ, বের‌্যা অগ্নি ঘনে ঘন,

দেখিয়া সভায় কম্পমান।

 

মনেতে পাইয়া মর্ম, সবে বোলে রাখ ধর্ম,

তোমা বিনা কে করে পরিত্রাণ ॥

এইরূপে দ্বিজগন,করে ছিষ্টি সংহরণ,

বড় হইল অবিচার।

বৈকুন্ঠে থাকিয়া ধর্ম, মনেতে পাইয়া মর্ম,

মায়াত হইল অন্ধকার ॥

ধর্ম হৈলা জবনরূপী মাথায়েত কাল টুপি

হাতে শোভে ত্রিকচ কামান।

 

চাপিয়া উত্তম হয় ত্রিভুবনে লাগে ভয়

খোদা বলিয়া এক নাম ॥

নিরঞ্জন নিরাকার হৈলা ভেস্ত অবতার

মুখেতে বলে দম্বদার।

জথেত দেবতাগণ সভে?হৈয়্যা এক মন

আনন্দেত পারিলা ইজার ॥

 

আমরা লক্ষ্য করতে পারছি যে ধর্ম, সনাতন ঠাকুর এবং অন্যান্য সকল কিছুকেই সেই সময়ে বাংলা ভাষা ইসলামের মাঝেই খুজেছে, অর্থাৎ বাংলার লালন ও শ্রী-বৃদ্ধি ঘটেছে ইসলামের আগমনের পরে মুসলিম গণের মাধ্যমেই। এছাড়াও ইসলামের ক্ষেত্রে প্রতিটি জনপদেই নবী ও রসুল এসেছেন এবং তারা নিজের মাতৃভাষাতেই ওহী এর প্রচার করেছেন এবং তাদের উপর তাদের মাতৃভাষাতেই ওহী নাযিল হয়েছে। এই কারণেই কবি আব্দুল হাকিমের ন্যায় দেশপ্রেমিক কবি আমরা দেখতে পাই ষোলশ সালের দিকে যিনি বলতে পেরেছিলেন, “যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি” কেননা ইসলামের মাঝে কোন ভাষাকে অপর ভাষা অপেক্ষা শ্রেয় ভাবার কোন স্থান রাখা নেই। 

আমাদের এই ভাষার অভিযাত্রার সাথে সাথে হাত ধরে চলেছে আমদের নিজ ভুমির ইসলাম যা আমাদের মাটি পানি হাওয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, যার মাধ্যমেই আমরা পীরের আর্যা সহ বাকি সব ধরণের গান লাভ করি, যদিও এগুলি ইসলামের সকল দিক অনুযায়ী বৈধ ও সিদ্ধ নয়, কিন্ত এরপরেও আমাদের মাঝে কোরআন হতে শুরু করে সকল কিছুকে বাংলার মাঝে রুপান্তর করার ইচ্ছা এবং বহু দরবেশ গণের আল বাঙালি নাম ধারণ আমাদের বাংলা ও ইসলামের হাত ধরে চলবার সত্যকেই প্রকাশ করে। 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
"একটি গ্রাম, একটি শহর"

“একটি গ্রাম, একটি শহর”

এম.সাইদুল ইসলাম তালুকদার দুর্বাসিত একটা রুদ্ধ শহর ছেড়ে গ্রামে এসেছি যে শহরে সতেজ অনুভূতিগুলোর মৃত্যু হয়েছে অনিবার, সমীরচ্যুত বিষাদের চারদেয়াল ছেড়ে ঘরে ফিরেছি যে দেয়ালে বন্দি পাখির ...
নেই, কোথাও কেউ

নেই, কোথাও কেউ

জোবায়ের রাজু গ্রাম থেকে শহরে এসেছে দিদার। ভর্তি হয়েছে শহরের নামকরা একটি কলেজে। এই শহরে থাকার মত দিদারের কেউ নেই। তাই সে বন্ধুদের সাথে মেসে ...
গল্প - ব্যবধান / আশিক মাহমুদ রিয়াদ  

গল্প – ব্যবধান / আশিক মাহমুদ রিয়াদ  

আশিক মাহমুদ রিয়াদ কালবেলা চাদর গায়ে দিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন আতাহার সাহেব। জানলা থেকে  একফালি রোদ এসে পড়েছে তার কোলে। এখন শীতকাল। দুয়েকদিন ...
দাম্পত্য জীবন

দাম্পত্য জীবন

জোবায়ের রাজু শিখার আজ বাসর রাত। সে চুপচাপ বাসর ঘরে বসে আছে। এখন রাত প্রায় বারটা। তার বর বাদল বারান্দায় কার সাথে যেন লম্বা আলাপ ...
গল্প - চোর

গল্প – চোর

জোবায়ের রাজু পড়ন্ত দুপুরে নিনার কল দেখে আমি অনেকটা হকচকিয়ে উঠলাম। আমার মনে হল এই কলটা রিসিভ করলেই নিনার বাবার মৃত্যুর সংবাদ পাবো। নিনা হয়তো ...
এক মাছলি, পানি মে গায়েই? অর্থ কি? কিভাবে খেলে?

এক মাছলি, পানি মে গায়েই? অর্থ কি? কিভাবে খেলে?

এক মাছলি, পানি মে গায়েই? অর্থ কি? কিভাবে খেলে?   ভাইরে ভাই! বন্ধুবান্ধব একসাথে বসে আড্ডা দেওয়ার মজা আর কিছুতে নেই। সেই সাথে বসে যদি ...