মিরাজুল হক
মানুষ বিশিষ্ট ভূখণ্ডের সন্তান । মানুষের কল্পনা এবং ভাবনার বিন্যাস জল-নির্ভর , হাওয়া-নির্ভর এবং প্রাকৃতিক সম্পধ নির্ভর । কবি মহাকবিরা প্রকৃতির এই সংশ্লেষের হাত ধরেই মানব জগতে প্রবেশ করেন । সেকেলের মহাকবি কালিদাসের জীবনে তপোবন ও হিমালয়ের প্রভাব আছে। মেঘদূতের প্রকৃতি হিমালয়ের । শকুন্তলা তো তপবনের নাটক । শেক্সপিয়ারের প্রকৃতি নদীর ধারে স্ট্রাফোরড পল্লী । Wordsworth এর ‘ Lake District ‘ এই অর্থে সত্যি ।
আর একালের মহাকবি রবীন্দ্রনাথের কবি প্রেরনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশের নদনদী , নদীর তীরবর্তী জনবসতি , শস্যপূর্ণ বা শস্যহীন প্রান্তর । তাঁর কবিত্ব নদীমাতৃক । এ তাঁর জন্মস্থান নয় । এখানে এসে পৌঁছতে কিছু টা দেরী হয়েছে । তাই তাঁর প্রতিভার প্রকাশে কিছু বিলম্ব । এই বিলম্বের স্বরূপটা বুঝতে পারা যাবে স্বল্প আয়ুর কিটস ও শেলীর সংগে তুলানা করলে ।
রবীন্দ্রনাথের আশী বছরের জীবনকালকে আট টি দশকে ভাগ করে দেখা যায় । কবি জীবনের প্রথম কুড়ি বছর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে । তাঁর জীবনের তৃতীয় দশক থেকে প্রতিভার সূচনা । চতুর্থ দশকটি তাঁর কবিজীবনের সুফলতম সময় ।
সোনার তরী , চিত্রা , চৈতালি , কণিকা , ক্ষনিকা , কথা , নৈবেদ্য , চিত্রাঙ্গদা , মালিনী , গান্ধারীর আবেদন , কর্ণকুন্তীর সংবাদ – এই সব যে সোনার ফসল ফলল , তার তুলনা হয় না । এই সব ছাড়াও আছে ছোটগল্পের অনেকগুলো এবং ছিন্নাপ্ত্রাবলীর চিঠিপত্র । কিন্তু এই হিসাব সম্পূর্ণ নয় , তবে এই যথেষ্ট । তাঁর জীবনের এই দশক সফলতম । কিন্তু তা বলে পরবর্তী কোন দশক অ-সফল বা নিস্ফল নয় । প্রত্যেক দশকে শুধু যে নতুন ফসল ফলিয়েছেন তা নয় , নতুন বিস্ময়কর সব ফসল ফলিয়েছেন । তবে প্রাচুর্য , বৈচিত্র স্থায়িত্বের নিরিখে তাঁর জীবনের তৃতীয় চতুর্থ দশকে অবশ্যই আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে ।
ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে দশটি বছর কেটেছে – নদীতে , খালবিলে । যতদিন বাড়ীতে থেকেছেন , তার চেয়ে বেশী থেকেছেন বজরায় । নদীস্রোতে ভাসমান নৌকায় , নদীর চঞ্চলতায় । আজ শিলাইদহ , কাল সাজাদপুর , পরশু পতিসর । মাঝখানে কলকাতা , বোলপুর তো আছে ।
কলকাতার নাগরিক সন্তান , অভিজাত বংশের তরুণ যুবক । ঋণের ভারে প্রিন্স দ্বারকানাথের বিপুল ঐশ্বর্যের ভরাডুবি থেকে রক্ষাকর্তা হিসাবে তরুন রবীন্দ্রনাথকে জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্বে শিলাইদহে পাঠানো হয় । এই জমিদারী সম্পত্তি নদীয়া , পাবনা ও রাজশাহী জেলার মধ্যে ছড়ানো । শিলাইদহ , সাজাদপুর ও পতিসর – এই তিনটি স্থানে রবীন্দ্রনাথের পুষ্টিসাধনের প্রকৃতি ।
বলা বাহুল্য এই প্রকৃতির প্রধান পদ্মা । শিলাইদহের উত্তর দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা । ঠিক সরাসরি উত্তরে পাবনা শহর , বাজিতপুর স্টিমার ঘাট এবং ইছামতি নদীর মুখ । পাবনা শহরে পদ্মার ধারে দাঁড়ালে শিলাইদহের ঝাপসা দৃশ্য চোখে পড়ে । গ্রামটির পূর্বদিকে গোড়াই নদী । ধ্নুকের মতো বেঁকে গ্রামটি কে অর্ধ বৃত্তে ধরে রেখেছে । গ্রামের উত্তরে বারো তেরো বিঘে জমির উপরে প্রসিদ্ধ কুঠিবাড়ী । কুঠিবাড়ীটা আড়াইতলা , পরে সেটাকে পুরোপুরি তিন তলা করে নেওয়া হয় । এখানেই কবির বাসের ও লেখাপড়ার জায়গা । জানালা দিয়ে দুটো নদীকেই দেখতে পাওয়া যায় । কুঠি বাড়ীর উপরে দাঁড়ালেই দেখা যায় কিছুদূরে পূর্বদিকে ডাকঘর । কুঠি বাড়ীর উত্তরে পদ্মার উপরে খেয়া ঘাট । দক্ষিনে দিকে গোড়াই নদী পর্যন্ত চলে গিয়েছে পাকা রাস্তা । নদীর ওপারে কুষ্টিয়া শহর ।
প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুরের তৈরি করা ‘বোট ‘ টির নাম দিলেন ‘ পদ্মা ‘ । বৃহৎ হাউস বোট খানির ভিতরে ঢুকলে মনে হত একটা বড় বাড়ী । দু টি বড় বড় কক্ষ , ডাইনিং রুম এবং কয়েকটা ছোট বড় প্রয়োজনীয় কক্ষ । এই পদ্মা বোটে করে কবির পদ্মাকে দেখা নানান রূপ , ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি , তাঁর সাহিত্যের স্থায়িত্ব ।
পদ্মা কে যে দেখেনি , সে বাংলাদেশ দেখেনি । পদ্মাকে যে জানে না , সে বাংলাদেশকে বোঝেনি । তাঁর প্রত্যক্ষে পরোক্ষে পদ্মাকে নিয়ে অনেক কবিতা । তবুও পদ্মার মহাকাব্য ছিন্নপ্ত্রাবলী , রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ গদ্যকবিতা । বাস্তবিকই রবীন্দ্রনাথের মতো মহাকবির দৃষ্টিতে পদ্মাকে আর কেউ দেখেন নি । বছরের পর বছর , ঋতুর পর ঋতু পদ্মাকে নিরীক্ষণ করে , বিশ্বরূপ দর্শন করতে সমর্থ হয়েছেন । তা কবির কল্পনার দৃষ্টিতে , দিব্য দৃষ্টিতে । নববর্ষায় , ভরা বর্ষায় , শরতে , শীতে গ্রীষ্মে । দিনে ও রাতে । “ বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালোবাসি । “
শিলাইদহ বাসের প্রথম ফসল হল সোনার তরী , চিত্রা , চৈতালি । ভাষায় , ছন্দে , অলঙ্কারে এবং অনুভুতির গভীরতায় একটা দার্শনিক মাত্রা আছে । দিগন্ত ও গ্রামগুলির পটভূমি – “ তরুছায়া মসীমাখা , গ্রামখানি মেঘে ঢাকা “ , “ ভরা নদী ক্ষুরধারা । “ আর আছে মানুষের জীবন জীবিকা ।
কবির দৃষ্টি নদীর দিকে শুধুমাত্র নয় । তাঁর দৃষ্টি নদীরে তীরের ওপারে – জীবনদেবতা , সাধনা , মৃত্যুর পরে ইতাদ্যি । প্রেমের অভিষেক , স্বর্গ থেকে বিদায় , এবার ফিরাও মোরে , সন্ধ্যা প্রভৃতি এই অভিজ্ঞতার ফসল । আবার চিত্রা মূলত সৌন্দর্য বোধের কাব্য । এই সময়ে কবি দেখেছেন প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে উর্বশীর নৃত্য , আর কানে শুনেছেন , “ মনে হল সুখ অতি সহজ সরল ।“ এই সময়ে তাঁর লেখা ‘ নদী ‘ কবিতাটি সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ ।
গল্পগুচ্ছ কবি জীবনের চতুর্থ দশকের বিশিষ্ট ফসল । শিলাইদহ অঞ্চলের নদীময় বঙ্গে এই গল্পগুলোর জন্ম বললে , বোধ হয় অন্যায় হয় না । রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের আকারে গহিনে আছে দুটি দিক – মানবজীবন ও প্রকৃতির টানাপড়েন । একটা নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের সুখদুঃখ এবং অন্যটি প্রকৃতির সৌন্দর্য । কোন একটি বাদ পড়লে , গল্পের পরিকাঠামো সঠিক হয় না ।
পল্লীগ্রাম বাদ দিলে , ‘ পোস্টমাস্টার ‘ গল্পটি অতি সাধারন ঘটনায় পরিণত হয় । পদ্মার রহস্যময় রাক্ষুসী ক্ষুধার উপরেই ‘ খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ‘ গল্পের ভিত্তি । বোবা মেয়ে ‘ সুভা ‘ পল্লীগ্রামে নদীতীরে প্রকৃতির মতোই বোবা । আর ছুটি গল্পের ফটিক । পল্লীগ্রামে বেশ ছিল সে । পড়াশোনার জন্য তাকে শহরে পাঠালে , বেচারা শুকিয়ে বেঘোরে মারা গেল ।
আকাশের রোদ বাতাসকে কি করে ঘরের মধ্যে বাঁধা যায় । নিশীথে গল্পে একটা মনস্তাত্তবিক রহস্য আছে । সেই রহস্যটি পদ্মাচরের একঝাক বুনো পাখি , যাদের উৎকট ডাক । এবং সেই ডাকের সংগে মিশে দক্ষিনাচরণবাবুর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর , ‘ ও কে , ও কে , ও কে গো ‘ প্রশ্ন । আর কিছু গল্পে আছে , পল্লী প্রকৃতির চেয়ে পল্লীর মানুষের বৃহত্তর ভুমিকা । দিদি , মহাময়া , জীবিত ও মৃত ইত্যাদি ।
ক্ষনিকা কাব্যে কবি নদী ও নদীতীর ছেড়ে গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করেছেন । পল্লীবাসীদের জীবনযাত্রার সুখদুঃখের অংশীদার হয়েছেন । গৃহস্থ বধূর ঘরে অতিথি এসে শিকলটি নাড়ছে , দুই বোন জল আনতে যাওয়ার সময়ে একবার হেসে যাচ্ছে , ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়েটি আড় চোখে তাকিয়ে আছে , রথের মেলায় তালপাতার বাঁশির সুরে শিশুটির আনান্দ , একটা রাঙা লাঠি কিনতে না পারায় অন্য শিশুটির দুঃখ , মাঠের পথে ক্ষনিক দেখার বিহ্বলতা , জলের ধারে বেঁকে পড়া খেজুর গাছটির উপরে মাছরাঙা পাখিটি , ঘোর বর্ষায় গগনে মেঘের গর্জন , মেঘমুক্ত প্রভাতের স্নিগ্ধ প্রশান্তি কবিকে পেয়ে বসেছে । কাব্যের বিষয় যেন কবিকে খুঁজে পায় ।
কবিতায় বাংলাদেশের কালবৈশাখীর তাণ্ডব । বাংলা সাহিত্যে এটি ঝড়ের সর্বোত্তম কবিতা । কথা ও কাহিনী কাব্যের কাহিনী অংশের গানভঙ্গ , পুরাতন ভৃত্য ও দুই বিঘা জমিতে শিলাইদহ অঞ্চলের প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে । কেষ্টা ও উপেন কে নিশ্চয় কবি অনেকবার দেখে থাকবেন , এই শিলাইদহে ।
নৈবেদ্যে সৃষ্টিকর্তার-উপলব্ধির প্রচেষ্টার কাব্য । এই শান্তির প্রথম স্পর্শ তিনি লাভ করেছেন পল্লীপ্রকৃতির কাছে , যাকে তিনি সারাজীবন লালন করেছেন হৃদয়ের গভীরে ।
শিলাইদহ গ্রাম আর পাবনা শহর পদ্মা নদীর এপারওপার । পাবনার নীচেই ইছামতী নদী । কবির বজরা ছেড়ে দিয়েছে । গোড়াই ও পদ্মার সঙ্গমস্থলে শিলাইদহ । গোড়াই থেকে সামান্য এগিয়ে পদ্মায় পড়তে হয় । নদীটা “ যেন লেজ- দোলানো কেশ্র-ফোলানো ঘাড়-বাকানো তাজা বুনো ঘোড়ার মতো । গতির গর্বে ঢেউ তুলে ফুলে ফুলে চলছে , এই ক্ষ্যাপা নদীর উপরে চড়ে আমারা চলেছি । এর মধ্যে ভারি একটা উল্লাস আছে ।“ কবির লক্ষ্য সাজাদপুর ।
“ ছোটোখাটো গ্রাম , ভাঙাচোরা ঘাট , টিনের ছাতাওয়ালা বাজার , বাঁখারির বেড়া দেওয়া গোলাঘর , বাঁশঝাড় , আম কাঁঠাল , শিমুল , খেজুর কলা আকন্দ ওলকচু লতা গুল্মের ঝোপঝাড় জঙ্গল , ঘাটে বাঁধা মাস্তুল তোলা বড় বড় নৌকার দল , নিমগ্ন প্রায় ধানের ক্ষেত এবং অর্ধ মগ্ন পাটের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত এঁকে বেঁকে কাল সন্ধ্যার সময় সাজাদপুরের এসে পৌঁছেছি … অনেকদিন বোটে থাকার পর সাজাদপুরের বাড়ীটা বেশ লাগে ভালো , একটা যেন নতুন স্বাধীনতা পাওয়া যায় ।“
কবি বসে থাকলে বলেন চলো , চলতে থাকলে বলেন বসো । সাজাদপুরের বাড়ীতে এসে ভাবেন বেশ আরাম । কিন্তু কতক্ষণ সে আরাম স্থায়ী হবে ! শীঘ্রই আবার বের হয়ে পড়তে হবে পতিসরের দিকে । সাজাদপুর থেকে পতিসর দীর্ঘ পথ । অনেক নদীনালা পার হয়ে যেতে হয় , তার মধ্যে প্রধান চলনবিল । পাবনা ও রাজশাহী জেলার অনেকটা জুড়ে চলনবিল । এই বিলটি পার হয়ে বেশ খানিকটা গেলে তবে পতিসর গ্রাম । সেটা ঠিক আত্রাই নদীর উপরে নয় , তার একটা উপশাখার উপরে ।
শিলাইদহে সাহিত্য অনুরাগী শ্রোতার অভাব । দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তখন কুষ্টিয়ার হাকিম । সময় পেলেই আসেন । গান গেয়ে যান । মাঝে মাঝে আসেন রাজশাহীর উকিল অক্ষয় মৈত্রেয়ে । লোকেন পালিত রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সের বন্ধু , সামান্য কয়েক বছরের ছোট । লন্ডনে তাঁদের পরিচয় হয়েছিল কৈশোরে । রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টার না হয়ে ফিরে এলেন , আর লোকেন পালিত ফিরে এলেন সিভিলিয়ান হয়ে । এই সময়ে তিনি রাজশাহীর জজ । কবি মাঝে মাঝে রাজশাহী শহরে যান । আবার কখন দুই বন্ধুতে নাটোরের মহারাজার কাছে চলে যান , ঘোড়ার গাড়ীতে । মাইল পচিশের পথ , বিকেলে রওনা হলে পৌঁছতে রাত হয়ে যায় । রাত্রি জোৎস্নাময়ী । দুই বন্ধুর সাহিত্য আলোচনা চলে । লোকেনে পাণ্ডিত্য বেশী , রবীন্দ্রনাথে প্রতিভায় । লোকেনে জ্ঞানের বিস্তার , রবীন্দ্রনাথ পুষিয়ে নেন গভীরতায় ।
সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু । জগদীশচন্দ্র বসু দেশ বিদেশ ঘুরে এসেছেন , তবুও তাঁর মতে পদ্মার চরের মতো এমন মনোরম ও স্বাস্থ্যকর স্থান কোথাও পাওয়া যায় না । জগদীশচন্দ্র বসুর পছন্দ কচ্ছপের ডিম , কচ্ছপের মাংসও । শীত কমে গরম পড়লে , রাতের আহার সেরে নিয়ে সকলে ডিঙি নৌকায় চেপে নৌকা খুলে দেওয়া হত । স্রোতের টানে নৌকা এবং সুরের টানে শ্রোতাদের মন ভেসে চলতো । জগদীশচন্দ্রের প্রিয় গানগুলো গাইতে হত , কখনো কবি কে , কখনো শ্রীমতী অমলা দাশ কে ( দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বোন )।
শিলাইদহ থেকে সংসার গুটিয়ে ফেলার সময় হল । সপরিবারে কবির বিদায়ের পালা । তাঁর মতো লোক তো সংসার পাতার জন্য আসেননি । তাঁর পারবারিক জীবন সংসার পাতা আর সংসার ভাঙার ইতিহাস । জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবন তাঁর পৈতিক বাসস্থান । এটা তো দাসদাসী আত্মীয়স্বজন নিয়ে দেড়শ জনের বৃহৎ মহর্ষির সংসার । রবীন্দ্রনাথের সংসার কই ? বিবাহের পরে স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে গাজিপুরে সংসার পেতেছিলেন ক মাসের জন্য । কখনো সত্যেন্দ্রনাথের কাছে সোলাপুরে , কখনো শান্তিনিকেতনে , কখনো ক্ষনিকের জন্য শিলাইদহে – এই ভাবে চলেছে । স্ত্রী কন্যা পুত্র নিয়ে কবির সংসার পাতা হয় নি । তবু আশা ছাড়লেন না রবীন্দ্রনাথ । তাঁর মনে হল শান্তিনিকেতন আশ্রমটি তাঁর সংসার ।
১৯০১ সালের মাঝামাঝি শিলাইদহ ছাড়ার পরিকল্পনা হল । ক্রমে কথা টা রাষ্ট্র হয়ে গেল । প্রথমে বাহির-বাড়ীতে , তারপর কাছারী-বাড়ীতে , অবশেষে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল সংবাদটি । শিলাইদহ ছেড়ে আসার দিন এসে পড়লো । ‘পদ্মাবোটে ‘ সকলে উঠলেন । আর দু খানি বোট তৈরি জিনিষপত্র বোঝাই করে । তীরে দাঁড়িয়ে অগণিত দাসদাসী আমলা কর্মচারী আর গাঁয়ের মানুষজন । ছেড়ে দিল ‘পদ্মাবোট’ – “ ছল ছল করে গ্রাম চূর্ণি নদীতীরে ।“
“ একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল ফিরিয়া যাই … কিন্তু পালে বাতাস পাইয়েছে , বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে , গ্রাম অতক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে , এবং নদী-প্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল , জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ , কত মৃত্যু আছে , ফিরিয়া ফল কি । পৃথিবীতে কে কাহার ।“ তখনো শুনতে পাওয়া যাচ্ছে পুরনো কুঠি বাড়ীর ঝাউগাছগুলোর করুন দীর্ঘশ্বাস ।