মাসপয়লা – গৌতম সরকার

মাসপয়লা - গৌতম সরকার

ড. গৌতম সরকার

ছোটবেলায় ইংরেজি মাসের এক তারিখটা একটু অন্যরকম ভাবে আসত; বিছানায় শুয়ে শুয়ে টের পেতাম বাড়ির সবাই উঠে পড়েছে, আমি আর আমার ছোট বোন তখনও বিছানা আঁকড়ে পড়ে আছি৷ অন্যদিন এরকম হয়না, সবাই ওঠার ব্যাপারে গড়িমসি করে৷ রান্নাঘর থেকে ইতিমধ্যে রসুইয়ের গন্ধ আসতে শুরু করেছে৷ বাবা আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিস যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আর শুয়ে থাকা যায়না, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ আজ একটা বিশেষ দিন, আজ আমার বাবার মাইনে পাবার দিন৷

ছোটবেলায় বাবার অফিস যাবার প্রস্তুতিপর্বটা খুব মন দিয়ে দেখতাম, বিশেষ করে সাজসজ্জা পর্বটি৷ আমার বাবা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পড়ত, কখনও কখনও সরুপাড়ের ধুতি৷ পরিধানের ব্যাপারে এত নিখুঁত ছিল যে ইস্তিরি করা ছাড়া কোনোদিন কোনও পোশাক পড়তে দেখিনি৷ আর জামাকাপড়ের অসম্ভব যত্ন নিত৷ শুধু জামাকাপড়ই নয়, সমস্ত জিনিস ওরকম যত্নে গুছিয়ে রাখতে আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি৷ এই পরিধান পর্ব আরো সুচারু হত মাস পয়লার দিন, নিখুঁত ভাবে বাবা নিজেকে সাজিয়ে তুলত৷ ওইদিন মাও বাবাকে সাহায্য করত, হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিত, দিদিদেরও ফাইফরমাশ খাটতে দেখতাম৷ সবাই হাঁসিমুখে প্রসাধন পর্বে বাবাকে সাহায্য করে যেত, সবাইয়ের মুখে আনন্দের একটা হালকা আলো খেলে বেড়াত, যেটা দেখে খুব সহজেই বোঝা যেত- আজ মাসপয়লা, আমার বাবার মাইনে পাওয়ার দিন৷ আমি আর বোন ছোট বলে কেউ কোনও কাজের ফরমাশ দিত না৷ আমি যদিও আশপাশেই ঘুরে বেড়াতাম আর বাবার সাথে চোখে চোখে অনেক কথা চালাচালি হত, যে ভাষা আমি আর বাবা ছাড়া কেউ বুঝত না৷

দিনটা একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে যেত, সবই করছি, খাচ্ছি, বই গোছাচ্ছি, স্কুলে শিক্ষকদের পড়া শুনছি, বিকেলে বন্ধুদের সাথে মাঠে ফুটবল পেটাচ্ছি, কিন্তু মনের মধ্যে গুন গুন করে সততই এক আনন্দ গান বেজে চলত- আজ বাবার মাইনের দিন৷ ওই দিন একটু তাড়াতাড়িই মাঠ থেকে বাড়ি ফিরতাম, মা বলার আগেই হ্যারিকেনের আলোয় ভাইবোনেরা পড়তে বসে যেতাম; কিন্তু মন বইয়ে কতটা থাকত জানিনা, কারণ কান উৎকর্ণ হয়ে বাবার ফেরার অপেক্ষায় থাকত৷ অধিকাংশ সময় অপেক্ষাই সার হত, বাবা ফেরার আগেই ঘুমে চোখ ঢুলে আসত, মা কোনোরকমে খাইয়ে শুইয়ে দিত৷ আমার নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাবা সংসারের সারা মাসের চাহিদা সওদা করতে করতে দেরী করে ফেলত; অনেক রাত করে যখন ফিরত তখন মা ছাড়া প্রতীক্ষা করার মতো আর কেউ থাকত না৷ গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে বাবার কথা মনে পড়ে যেত, পাশ ফিরতেই বাবার গায়ের মন ভালো করা গন্ধ পেতাম; তত্ক্ষনাৎ বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়তাম৷

আমার চাকরিজীবনে মাস পয়লার আনন্দ যে একেবারে পাইনি তা কিন্তু নয়, মাসের এক তারিখে অলিখিত ভাবে ক্লাসের চাপ একটু কম থাকত৷ স্টাফরুমে গল্প, হাঁসি-ঠাট্টার মধ্যে কানটা খাড়া থাকত কখন ওপরওয়ালার ডাক আসে৷ ওপরওয়ালা মানে ক্যাশিয়ারবাবু, ডাক আসার সাথে সাথে লাফ মেরে দৌড়তাম এবং সিনিয়র জুনিয়র নির্বিশেষে লাইন দিয়ে দাঁড়াতাম ক্যাশিয়ার বাবুর টেবিলের সামনে৷ উনি খুব মুডি মানুষ ছিলেন, খাতায় একে একে সই করতাম, একটু দেরী হয়ে গেলে খাতার মুখ ওনার দিকে ঘুরে গেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হত৷ এবারে উনি যাদের যাদের সই হয়েছে ধীরে সুস্থে তাদের চেক দিতেন, সবাইকে দেওয়া হয়ে গেলে খুব অনিচ্ছা সহকারে সামনের অপেক্ষমানদের দিকে খাতাটি করুণার সাথে ঘুরিয়ে দিতেন, তখন আবার সই করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত৷ চেক পাবার পর আর অপেক্ষা নয়, দলে দলে ছুটতাম ব্যাংকের দিকে, কারণ সেখানেও তো আবার অপেক্ষাপর্ব শুরু হবে৷ আজ যে মাসপয়লা, দুনিয়ার সব মানুষ আজ ব্যাঙ্কমুখো৷ হঠাৎ করে সেই আনন্দটাও কবে যেন হারিয়ে গেল৷ অজান্তেই ঘটে গেলো সব, গতিময় জীবন প্রযুক্তির সাথে মিলেমিশে কবে যেন আমাদের পরিশ্রম অনেক কমিয়ে দিল, সেই সাথে মাস পয়লার সবটা আনন্দ কেড়ে নিল৷ এখন কখন মাইনে পাই অনেক সময় টেরই পাইনা, কখনও কখনও একটা ছোট্ট মেসেজ জানান দেয় কিছু টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকলো, খুব কিছু তাপ-উত্তাপ হয়না৷ যখন প্রয়োজন হয় যান্ত্রিক নির্লিপ্ততায় এটিএম মেশিনের বোতাম টিপি৷ টাকার ওম পাইনা বহুদিন, মাসের শেষ কটা দিনে একটা একটা করে টাকা হিসেব কষে খরচ করার জৈবিক তৃপ্তি ঘুচে গেছে বহুদিন৷ অভাব কিছুটা মিটেছে এই প্রজন্মের, কিন্তু অনেক দিকে আমরা বড় বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছি, তার হিসেব রাখিনা৷

বহুদিন পর ২০১৬ সালে মোদি সরকারের এক যুগান্তকারী আর্থিক নীতি টাকার হারিয়ে যাওয়া সেই রূপ, রস, স্পর্শ, গন্ধ, কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিয়েছিল৷ যেদিন ঘোষণাটি হল আমি মাঝরাতে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম, পাগলের মতো মানুষ চারশো টাকার জন্য এক এটিএম থেকে অন্য এটিএম-এ দৌড়ে বেড়াচ্ছে৷ যারা পাচ্ছে তাদের মুখের তৃপ্তি যেমন দেখেছি, যারা পাচ্ছে না তাদের হতাশাও চোখ এড়ায়নি৷ আমিও দু -তিন জায়গায় লাইনে দাঁড়িয়েছি, কপালে কিছুই জোটেনি৷ কয়েকদিন পর অবস্থা সঙ্গীন হল, কোনওভাবেই টাকা জোগাড় করতে পারলাম না; সব এটিএম-এর দরজা অর্ধেক তোলা৷ কোথাও গিয়ে শুনি-এসেছিল কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ৷ একদিন টাকা আসবে শুনে একটা বন্ধ এটিএম-এর সামনে দু ঘন্টা লাইন দিলাম, তারপরও এলোনা দেখে বাড়ি ফিরে এলাম৷ ফিরে স্ত্রীকে বললাম, তুমি একটু যাও, দেখো যদি পরে আসে৷ অনেক রাতে আমার স্ত্রী যুদ্ধজয়ের উন্মাদনায় যখন চল্লিশটা একশো টাকার কড়কড়ে নোট নিয়ে বাড়ি ফিরল, তখন আমি টাকার হারিয়ে যাওয়া সেই গন্ধ, স্পর্শ আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম৷ যখন ও আমার হাতে টাকাগুলো তুলে দিল, শীতের কনকনে সকালে এক ফালি রোদের ওম যেন সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, মনে হল যেন কোনও লটারি জিতে গেছি৷ প্রয়োজনের তুলনায় হাতে অর্থ কম থাকলে যে প্রতিটি টাকার মূল্য বেড়ে যায় সেটা জানার জন্য বিরাট কোনো অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার পড়েনা৷ এরপর নোটবন্দীকালে যতবার এটিএম কাউন্টার বা ব্যাঙ্কের লাইনে দীর্ঘ অপেক্ষায় থেকেছি, টাকার প্রতি ভালোবাসা উত্তরোত্তর বেড়েছে, আর অপেক্ষা শেষে হাতে পাওয়ার আনন্দের আলো শুধু আমার চোখে নয়, সকলের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি৷ তবে এটাও জানতাম এই অবস্থা আস্তে আস্তে কেটে যাবে, দিন দিন জীবনযাত্রা আরোও যান্ত্রিক হয়ে পড়বে, ক্যাশলেশ ইকনোমিতে তো দুটো মানুষের দেখা হওয়ারও প্রয়োজন পড়েনা৷ আমি বদলে যাওয়া জীবনযাত্রার বিরোধী নই, কিন্তু যন্ত্র প্রতি মুহুর্তে ছোটবড়ো অনেক আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে সেটাও মাঝে মাঝে কাঁটার মতো বুকে বেঁধে৷ মাঝে মাঝে মনে হয় এটাই হয়তো শেষের শুরু- আস্তে আস্তে একদিন সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের মৃত্যু ঘটবে, বস্তুগত সম্পর্কের মাকড়সাজাল ঘিরে ধরবে পৃথিবীকে, তখন মানুষ ক্রমে ক্রমে যন্ত্রে পরিণত হবে, প্রাকৃতিক অভিযোজন যন্ত্রের হাত ধরেই সম্পূর্ণ হবে৷

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
Facebook Status: বাংলা রোমান্টিক ছন্দ (এসএম এস, FB Post, Best FB Caption)

Facebook Status: বাংলা রোমান্টিক ছন্দ (এসএম এস, FB Post, Best FB Caption)

১.তোমার আগমনে আমার জীবন যেন নতুন রং খুঁজে পেয়েছে। সে রঙের মহিমায় আমি সব সময় উচ্ছ্বসিত থাকি। সে রং আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা যোগায়, আত্মবিশ্বাস ...
মুজিব মানেই বাংলাদেশ

মুজিব মানেই বাংলাদেশ

নাজিফা আক্তার শারিকা “হে মুজিব, কে বলেছে তুমি মৃত? কে বলেছে তুমি নেই? ৫৬ হাজার বর্গমাইলে আমি শুধু তোমায় খুঁজে পাই!!” মুজিব আমার ভালোবাসার নাম। ...
কবিতা-‌আকাশের রাজধানীর দিকে

কবিতা-‌আকাশের রাজধানীর দিকে

গোলাম রসুল   তোমার কবর অবধি পৌঁছুতে বেলা গড়িয়ে গেল তার ওপর আমার হাতে সমুদ্রের বই ছিল আর ঢেউগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল   আমার পায়ের ডাঙা ...
ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট - ফ্যাদোর দস্তয়েভস্কি

ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট – ফ্যাদোর দস্তয়েভস্কি

শিবাশিস মুখোপাধ্যায় বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা কাজ অপরাধ এবং শাস্তি (ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট) একক সর্বাধিক পরিচিত রাশিয়ান উপন্যাসের পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা কাজ। এটি ...
গল্প - চোর

গল্প – চোর

জোবায়ের রাজু পড়ন্ত দুপুরে নিনার কল দেখে আমি অনেকটা হকচকিয়ে উঠলাম। আমার মনে হল এই কলটা রিসিভ করলেই নিনার বাবার মৃত্যুর সংবাদ পাবো। নিনা হয়তো ...
স্রোতের টানে

স্রোতের টানে

রেবেকা সুলতানা রিতু মাথার উপর খাঁ-খাঁ রোদ্দুর।হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে চিল উড়ে যায়।চারিদিকে নিস্তব্ধতা। তীব্র বন্যা আর নদী ভাঙনে মানুষের মুখে-চোখে  তার ছাঁপ বিদ্যমান। বড় বকুল ...