আজকের প্রেক্ষাপটে নন্দিনী রঞ্জন ও বিশু পাগলার প্রাসঙ্গিকতা
মিরাজুল হক
মনে হয় দেশটা এখন যক্ষপুরী । পৌরাণিক যক্ষপুরী নয় । রক্তকরবীর যক্ষপুরী । এই যক্ষপুরীতে মানুষের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গেছে , যাচ্ছে । এখানে মৈত্রী নেই । আছে রাগ , হিংসা , অবিশ্বাস ও ষড়যন্ত্র । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অসাধারন সৃষ্টি । সেই যক্ষপুরীর মতো , এক প্রকার চাল চিত্রের ঘনঘটা , এখন সারা দেশ জুড়ে , সর্বত্র । একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে , চলছে অবিরত । এই লড়াই যক্ষপুরী থেকে বেরোনার রাস্তা খুঁজে বের হবার সংগ্রাম । তাই এখন নন্দিনী রঞ্জন ও বিশু পাগলার খুবই প্রয়োজনীয়তা , আবশ্যকতা ।
রবীন্দ্রনাথের এই নাটক সবচেয়ে বেশী আলোচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ । একাটি অসামান্য নান্দনিক সৌন্দর্যের নাটক । এই নাটকে বিষম দ্বন্দ্ব আছে। কৃষিজীবী ও যন্ত্র সভ্যতার লড়াই । এই লড়াইটাকে যন্ত্রের সংগে মনুষ্যত্বের বিরোধ হিসাবে ব্যাখ্যা করাও অযৌক্তিক নয় । মুক্তির জন্য মানুষ কাজ করছে , চঞ্চল অস্থির হয়ে উঠছে , কিন্তু বন্ধনটা বাস্তবতা , তাকে ভাঙ্গা সহজ নয় । তবু ভাঙ্গতে হয় । এই প্রচেষ্টা চলতে থাকে অবিরত । এটা আগের কালেও সত্য ছিল । একালে বিশেষভাবে প্রকট এবং প্রাসঙ্গিক ।
একদিকে মানুষের সর্বগ্রাসী রাক্ষুসে লালসা ও শাসন ক্ষমতার লভনীয় আকর্ষণ । অন্যদিকে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাহমান জীবন , বেঁচে থাকার ইচ্ছা , করুন আকুলতা । আর আছে শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধা , তৃষ্ণা হিংসা বিলাস সমূহের প্রতি প্রবৃত্তির তীব্র আকর্ষণ , যা সুশিক্ষিত রাক্ষসের মতো । একালের পরিপেক্ষিতে এই সুশিক্ষিত রাক্ষসই হল পুঁজিবাদী শোষনব্যবস্থা । তাতে বিষয়টা বুঝতে সহজ হবে । রক্তকরবী প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরে ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কয়েক বছর আগে লেখা । এই দুটি যুদ্ধ বিশ্বের পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর ভেতর আধিপত্য নিয়ে লড়াই ।
তাই দেশে দেশে “ চিরকাল মানুষের সভতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে , তাদেরই সংখ্যা বেশী , তারই বাহন ; তাদের মানুষ হবার সময় নেই ; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত । …… কথায় কথায় তারা রোগে মরে , উপবাসে মরে , উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে —- জীবনযাত্রার জন্য যত-কিছু সুযোগ সুবিধে সব কিছু থেকে তারা বঞ্চিত “ , ( রাশিয়ার চিঠি ) ।
বর্তমানে আমাদের দেশের রাজা মন্ত্রীদের দৃশ্য অদৃশ্য নিয়মের অনেক বেড়া জাল । জনসমক্ষে বলা হয়েছে , ‘ সব কা সাথ সব কা বিকাশ ‘ । দেশে গোলা ভরা ধান , গম , ডাল আছে , যথেষ্ট আছে । আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার মতো যথেষ্ট অর্থ আছে । অথচ প্রায় ১৪ কোটি ভারতবাসীর পাতের ভাত কেড়ে নেওয়া হল , রাজার এক আদেশে । চরম অপরাধ । আইন বিরুদ্ধ । অথচ সেনগুপ্ত কমিশন (২০০৭ সালে অর্থনীতিবিদ অর্জুন সেনগুপ্ত ) স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিল , দেশের মোট ‘ জি-ডি-পি’ র প্রায় অর্ধেক আসে এই অসংঘটিত শ্রমজীবী দেশবাসীদের কাছ থেকে এবং ভারতের সম্পূর্ণ কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশ এই শ্রেণীর অবদান ।
শিক্ষা , স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ন্যায্য অধিকারের সংগ্রামে যারা নিবেদিত প্রান , সেই সব তরুন ছাত্রছাত্রীরা , এমন কি অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীও রাষ্ট্রের বে-আইন নিয়মে কারাগারে । দেশের শাসনকর্তাদের অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই নেমে আসে হাড় হিম করা রাষ্ট্রীয় অত্যাচার । জেলে বন্দী লেখক , সাহিত্যিক , সমাজকর্মীর মুক্তির দাবীতে বিশ্বের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের আবেদন । তবও রাজা অনড় , হৃদয়হীন । রাজা অমানবিক , কঠোর অনমনীয় ।
অন্যদিকে জনজীবনের অনেক দায় দায়িত্ব রাষ্ট্র ছেড়ে দিয়েছে বাজারের হাতে। তাদের যুক্তি বাজার নীতি সে দায়িত্ব , দক্ষতার সংগে পালন করবে । ভারি শিল্পের পরিকাঠামো থেকে শুরু করে জনপরিবহন , স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় রাষ্ট্র দায়িত্ব নিতে অপরাগ । বাজার বা মার্কেট ঠিক করবে মানুষকে কি ভাবে কাজে লাগানো হবে । বাজারের চাহিদা অনুযায়ী । দেশ বা মানুষের প্রয়োজনে নয় । এই বাজারের নিয়ন্ত্রণে আছে ভোগবাদী ব্যবস্থা । যার অন্য নাম ‘ পুঁজিবাদ ‘ ।
ভোটের আগে আগে এখন সীমান্তে যুদ্ধ লাগে , লাগিয়ে দেওয়া হয় । অথচ কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে প্রতিরক্ষা ও বিদেশ দপ্তরে ছোট মাঝারি থেকে বড় বড় সব সাহেব কে পোষা হয় ! বাস্তবিকই উগ্র অতিজাতীয়তাবাদী হুংকার সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় । দেশের রাজনীতিতে এই অতি জাতীয়তার তাস এবং বিদেশ নীতিতে এই তাস নিয়ে খেলা বিপদজনক । ঘরোয়া রাজনীতির লাভের গুড় বাঁচাতে যদি দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয় , তবে সেই নেতৃত্বের আর কি নৈতিক অধিকার থাকে , জাতীয়তাবাদের কথা বলার ?
সাম্প্রতিক কাশ্মীরে ঔপনিবেশিক শাসন ক্ষমতার পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকার যে ভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে ,তাতে আশঙ্খা অমুলক নয় । বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল “ দ্যা লানসেট “ – এর ১৭ই আগস্ট , ২০১৯ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে কাশ্মীরিদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে । ১৩ই আগস্ট , ২০১৯ দিল্লিতে অর্থনীতিবিদ জা- দ্রেজে ও তিন সহযোগী মিলে কাশ্মীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন , তাতে কাশ্মীরিদের উপর অবর্ণনীয় দমন ও নিষ্ঠুরতার উল্লেখ আছে । ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি র প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রাতের অন্ধকারে তরুণদের ধরে নিয়ে গিয়ে বেদম মার , এমন কি ইলেকট্রিক শক দেওয়ার পন্থা নিয়েছে নিরপত্তা বাহিনী ।
গভীর বেকার সমস্যা , বাজার অর্থনীতির বিপর্যয় , নিম্নগামী টাকার মূল্য , নগদ টাকার তরলতা ( লিকুইডিটি ) , জি – ডি – পি – এর নিশ্চল অবস্থা , বাঙ্কিং ব্যবস্থাতে নন – পারফর্মিং অ্যাসেট ( এন- পি – এ ) । উপার্জন নেই , চাকরি হারানোর ভীতি — সব মিলিয়ে একটা কঠিন পরিস্থিতি , আশা স্বপ্ন আনান্দহীন বেদনার বিহ্বলতার শূন্যতা ।
তারপরেও বাহিরে অদৃশ্য ভাইরাসের মহামারী । সংসারে টানাটানি । এই ভাইরাস একদিন বিদায় নেবে অবশ্যই । কিন্তু এই অশুভ হিংস্র প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসা ও উত্তরনের দিকে এগিয়ে যাওয়া , ভাবান চিন্তার বদল ঘটানো আমাদের এখন খুব দরকার , প্রয়োজনীয় আবশ্যকতা । অমানবিক স্বৈরাচারী নিয়মের বেড়া জাল থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে ।
এখানেই রক্তকরবীর নন্দিনী রঞ্জনের প্রাসঙ্গিকতা । নন্দিনী যে এ দেশের মেয়ে , আমাদের একান্ত আপনজন । এবং সহজ সুখ , সৌন্দর্যের প্রতীক । নন্দিনী রক্তকরবীর যক্ষপুরীর অন্ধকারে আলোর শিখা । রঞ্জনকে নিয়ে সে এগিয়ে চলেছে । নন্দিনীর সংলাপে আমারা প্রথম শুনতে পাই দুটি শব্দ ‘ রঞ্জন ‘ ও ‘ রক্তকরবী ‘ । রঞ্জন মুক্তির অনুপ্রেরনা এবং রক্তকরবী মুক্তির প্রতীক ।
সমস্ত যক্ষপুরীর সংগে রাজার সম্পর্ক ভয়ের । রাজাও বন্দী , নিজের গড়া এই ব্যবস্থার ভিতরে । থাকে লোহার তৈরি জালের ভিতরে । নন্দিনী রাজার চোখে চোখ রেখে সহজ সুরে বলে দিতে পারে যে , “ তুমি তো নিজেকেই জালে বেঁধেছ , তারপরে কেন এত ছটফট করছে বুঝতে পারি নে “ । এ এক গভীর পরিবর্তনের আভাষ । সমস্ত রক্তকরবী জুড়ে নন্দিনীর বিচরন , অপ্রতিরোধ্য তার গতি । সহজ উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্না নন্দিনী শুধু বিশু পাগলের কণ্ঠে গান জোগায় না , পরিস্থিতি অনুযায়ী সে বিদ্রোহ জনতাকে নেতৃত্বও দিতে পারে । রাজার ঘরে রঞ্জনের মৃতদেহ দেখা নন্দিনীর জীবনে চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি । রঞ্জনকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাজপ্রাসাদে । অন্য বিদ্রোহীদের সংগে তাকে হত্যা করা হয় । সেই বিপর্যয়ে ভেঙ্গে পড়া নয় , নন্দিনী বেছে নিয়েছে প্রতিরধের পথ ।
নন্দিনী ।। রাজা , এই বার সময় হল ।
রাজা ।। কিসের সময় ?
নন্দিনী ।। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সংগে আমার লড়াই ।
রাজা ।। আমার সংগে লড়াই করবে তুমি । তোমাকে যে এই মুহূর্তে মেরে ফেলতে পারি ।
নন্দিনী ।। তারপর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা , তোমাকে মারবে । আমার অস্ত্র নেই । আমার অস্ত্র মৃত্যু ।
নাটকের শেষে যক্ষপুরীর অচলায়তন ভাঙার অভিযানে নন্দিনীর নেতৃত্বে এগিয়ে চলা । রাজার ভাষায় , ‘ প্রলয়ের পথে আমার দীপশিখা ‘ । ফাগুলালের পরামর্শে নন্দিনী নিজে নিরাপদ স্থানে যেতে চায় নি । বরং বলেছে , ‘ ঐ দেখো , বর্শার আগে আমার কুন্দফুলের মালা দুলিয়েছে । ঐ মালাকে আমার বুকের রক্তকরবী রঙ করে দিয়ে যাব । সর্দার আমাকে দেখতে পেয়েছে । জয় রঞ্জনের জয় । ‘
আমাদের আসল লড়াই স্বৈরাচারী শাসনকর্তাদের ক্ষমতার লালসার বিরুদ্ধে , যা পুঁজিবাদের আড়ালে দানবের রূপ নিয়ে কেড়ে নিতে চেয়েছে মানুষের মনুষ্যত্ব । টুটি টিপে হত্যা করছে গনতান্ত্রিক অধিকারবোধ । মানুষের সংগে যন্ত্রের যে বিরোধ সেটার মুলে আছে শ্রমের উপর পুঁজির কৃতিত্ব । যদিও রবীন্দ্রনাথ ঘটনাটিকে সে ভাবে দেখাচ্ছেন না । তাঁর নাটকে সত্য , সত্য হয়ে উঠেছে মানুষের অস্বাভাবিক ধনলিপ্সা । এই লালসাই আদতে পুঁজিবাদের রূপ গ্রহণ করেছে ।
যন্ত্রের নিজের কোন দোষ নেই , যন্ত্র পুঁজিবাদের দাসে পরিণত । শুধু যন্ত্র কেন , যন্ত্রের উদ্ভাবক বিজ্ঞানও পুঁজিবাদের দাসত্ব করছে । মকররাজ এই সিস্টেমের কেন্দ্রবিন্দুতে । এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ , তাতে নন্দিনী আছে , রয়েছে রঞ্জন ও বিশুপাগলা । নন্দিনী একা হলে এতসব ঘটনা ঘটতো না । বিজ্ঞান , যন্ত্র , সম্পদ — সমস্ত কিছুর উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে একটা নতুন ব্যবস্থার তথা সভ্যতার উদ্ভব ঘটা সম্ভব । সেটা ঘটবে কি ঘটবে না তা বলার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের নয় ।
এই দায়িত্ব আমাদের । আমারা বিশ্বাস করি এই অমানবিক অবিচার অত্যাচারের বেড়া জাল ভাঙ্গতে হবে । মানুষের বেঁচে থাকার সমস্ত কিছু আছে , এই দেশে , আমাদের গ্রহে । যথেষ্ট আছে । অভাব একটি উপকথা । মিথ্যা কথা । তাই দেশে বিদেশে এ লড়াইয়ের মিছিলে আমারা সবাই । শুধু দরকার নন্দিনী রঞ্জন বিশু পাগলাদের নেতৃত্বের আবশ্যকতা ।
হাওড়া,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।
[প্রকাশিত লেখাটির দায়ভার লেখকের৷]