খান আলাউদ্দিন
সমান্তরাল মহাবিশ্ব তত্ত্বের মতে, আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের বাহিরেও অসীম সংখ্যক মহাবিশ্ব থাকতে পারে। কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলে স্থানকালের শূন্যতার ভেতর এদের উৎপত্তি ঘটে। এসব মেমব্রেন মহাবিশ্ব সাবানের ফেনার মতো উচ্চমাত্রায় ভেসে বেড়ায় , আবার মিলিয়েও যায়। প্যারালাল মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে সময় বইছে ভিন্ন খাতে। পৃথিবীতে জঙ্গি তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করে নিলেও এমন পৃথিবী থাকতে পারে যেখানে তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো জন্মই হয়নি। আবার এমন পৃথিবীও থাকতে পারে যেখানে একটি দেশের নৈরাজ্যবাদী, উগ্র ধর্মীয় ভাবধারাপুষ্ট কিছু কবি তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। প্যারালাল মহাবিশ্বে একই ঘটনার থাকবে ভিন্ন বাস্তবতা, নন লিনিয়ার টাইমলাইন। একই ব্যক্তি যাপন করবে ভিন্ন ভিন্ন জীবন। অর্থ্যাৎ সৈয়দ শামসুল হকের বলা, ’’জীবন এক এবং তার অক্ষরগুলো এক অধোয়া কালিতে লিখিত’’, মিথ্যে বলে মনে হবে। নিষাদ, হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী সিরিজের একটি বই। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনিরের একটি দুটি নয় , জীবন ছিলো অনেক এবং জীবনগুলো ছিলো পাশাপাশি প্রবহমান। একজীবনে তার ও নিজাম সাহেবের মেয়ে বিনুর বিয়ে হয়েছে। তাদের একটা আট-ন বছর বয়সী ছেলেও রয়েছে। নাম টগর। অন্য জীবনে টগর চার বছর বয়সেই মারা গেছে। অথচ ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে মুনিরের সাথে বিনুর বিয়েই হয়নি। মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব তত্ত্বের সফল প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে মি. নোবডি চলচ্চিত্রে। ২০৯২ সাল। মানবজাতির হাতে এসে গেছে অমরত্বের চাবিকাঠি। তবে নিমো নোবডি পৃথিবীর সর্বশেষ মরণশীল মানব। একজন রিপোর্টারের কাছে বর্ণনা করা তার জীবনকাহিনীই মালমশলা যুগিয়েছে মুভিটিতে। নিমো নোবডির নয় বছর বয়সে তার পিতামাতার বিচ্ছেদ ঘটে। আমরা দেখতে পাই, একটি ট্রেন স্টেশনে তার মা ট্রেনে উঠে চলে যাচ্ছে। তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। নিমোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেকি তার মার সাথে চলে যাবে নাকি বাবার সাথে থাকবে। সে মার সাথে গেলে তার জীবন, মহাবিশ্ব একধরণের হবে। সে বাবার সাথে গেলে তার জীবন, মহাবিশ্ব আরেকধরণের হবে। তার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে তার জীবনধারা কেমন হবে বা জীবনে কি কি ঘটতে পারে। অর্থ্যাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলেই আবির্ভাব ঘটবে বিভিন্ন মহাবিশ্বের। বিভিন্ন সম্ভাবনার। বিভিন্ন বাস্তবতার। সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগ পর্যন্ত সব ধরণের সম্ভাবনাই জারি থাকে। নিমো নোবডির কথায়, “As long as you don’t choose, everything remains possible.” অথবা “ If you never make a choice anything is possible.” তার কথার মধ্যে আমরা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বকে প্রতীকায়িত হতে দেখি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় বাক্স খোলার আগপর্যন্ত বলা যায়না এরউইন শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালটি জীবিত না মৃত। অনুর ওয়েভ ফাংশন করার আগপর্যন্ত ঢেউরুপ ইলেকট্রন যেকোনো কক্ষপথেই থাকতে পারে।শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল ধারণাটি এমন, ধরা যাক, একটি বাক্সে একটি বিড়ালকে বন্দি করে রাখা আছে। বিড়ালটির দিকে তাক করা আছে একটি রাইফেল। রাইফেলের ট্রিগার একটা গাইগার কাউন্টারের সাথে যুক্ত। গাইগার কাউন্টারের সাথে আছে তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তেজক্রিয় পদার্থ ক্ষয় হলেই গাইগার কাউন্টার চালু হবে এবং বন্দুক থেকে গুলি ছুটে গিয়ে বিড়ালটি মারা পড়বে। বাক্সের বাইরে থেকে বাক্সের ভেতরটা দেখা যায়না।ফলে বাক্স না খোলে বলা যাবেনা বিড়ালটি জীবিত না মৃত।তেজস্ক্রিয় ক্ষয় হতে পারে , নাও হতে পারে। বন্দুক থেকে গুলি ছুটে যেতে পারে , নাও যেতে পারে।
মুভিটিতে দেখানো হয় নিমোর দুটি জীবনধারা । একটিতে সে রয়ে গেছে তার বাবার সাথে । শারীরিক অসহায়ত্বের কারণে তার বাবা কাজ করতে পারেনা। ফলে সে একটি দোকানে কাজ করে এবং অবসর সময়ে টাইপরাইটার নিয়ে মঙ্গলগ্রহে যাত্রা বিষয়ক সায়েন্স ফিকশন লেখে। স্কুলের নুত্যুানুষ্ঠানে সে এলিসকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। কিছুদিন পর নিমো এলিসের বাড়িতে যায় এবং তার বাইশ বছর বয়সী প্রেমিক স্টেফানোকে আবিষ্কার করে।এতে সে গভীর দুখে দুখী হয়ে যখন উদভ্রান্তের মতো মোটরসাইকেল চালায় তখন অ্যাকসিডেন্ট করে কোমায় চলে যায়।…নিমোর অন্য জীবনধারা প্রবাহিত হয় তার মায়ের সাথে।এই জীবনে সে তার সৎবোন অ্যানার প্রেমে পড়ে।কিন্তু তাকে সে জীবনে পায়না। বিকল্প সময়রেখায় সে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে শিক্ষামুলক অনুষ্ঠান উপস্থাপনার কাজ করে। হয়তো নিমো তার মা বা তার বাবা কারো সাথেই থাকেনি।সে বেছে নিয়েছে তৃতীয় আরেকটি স্বাধীনপথ।ফলে খোলে গেছে একটি নতুন সম্ভারনা, নতুন ভবিষ্যতের দরোজা।
ছবি: মি. নোবডি
পরিচালক: জ্যাকো ভেন ডরমেল
ধরণ: সাই-ফাই
অভিনয়ে: জেরার্ড লিটো, সারাহ পলি, ডাইয়েন ক্রুগার, লিন দেন ফেম, রিস আইফেনস, টোবি রেগবো, জুনো টেম্পল…