কৃকলাস
আশিক মাহমুদ রিয়াদ
(গল্পটি দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত)
শীতকালীন আষাঢ় মাস! আবহাওয়ারও বিচিত্র পরিবর্তন হচ্ছে আজকাল।শীতকালেও ভ্যাপসা একটা গরম পড়েছে৷ সৌরভ বাধ্য হয়ে জানলা খুলে দিলো৷ গভীর রাতে জানলা খুললে প্রথমে একটি স্নিগ্ধ বাতাসের সুবার পাওয়ার কথা। তবে আশাহত হলো সৌরভ। আবর্জনার স্তুপ থেকে গন্ধ এসে ঘিরলো তাকে। রাগে আবার জানলা বন্ধ করে দিলো৷ এভাবে বাঁচা যায় না, সত্যিই আর বাঁচা যায় না৷ এপাড়ার লোকেরা কিভাবে থাকে কে জানে। মানুষের নাকি থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে যায়৷ সৌরভের হয়নি তা৷ একটু আগে কি একটা ভাবছিলো সে। এভাবে এই বাসায় আর থাকা যাবে না৷ কিন্তু যাবে কোথায়? দুদিন হলো চাকরী হারিয়ে বসে আছে। হাতে জমিয়ে রাখা টাকা পয়সা যা আছে তাতে হিসেব করে দেখেছে, প্রতিদিন একটি করে সিগারেট খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলে এ বছরটা কাঁওটিয়ে দেয়া যাবে। তবে সিগারেট খেয়ে তো আর বাঁচা যাবে না। পেটে দানা দিতে হবে দুমুঠো। সেই দুমুঠো দানা, বাড়িভাড়া বাবদ টাকা নিয়ে চলতে গেলে সে বড়জোড় এমাস চাকরীহীন থাকতে পারবে। হাতে জমানো ততটাকাও নেই। সব মিলিয়ে হাজার পনেরো টাকা জমিয়েছে। এতে আর এই দুর্দিনের বাজারে কি হয়। কিছুটা বিষণ্য হয়েই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছিলো সৌরভ।আজ কেন যেন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। মাথা জুড়ে উকি দিচ্ছে অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা৷ এই চিন্তাভাবনা থেকে দূরে থাকতে একটি ফোন নম্বরই যেন সৌরভের বন্ধু ছিলো এ বিপদের দিনে। তবে সে নম্বরে ফোন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ রাতের দিকে কিছুটা বিষণ্য হয়েই সে নম্বরে ফোন দিলো সৌরভ। সারাদিন বন্ধ থাকার পরে নম্বরটি পাওয়া গেলো বটে। তবে রিং হয়েই গেলো, ওপাশ থেকে ফোন তুললো না কেউ।
👉রোমান্টিক (১৮+) গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
২.
আজ সারাদিন বেশ খানিকটা ঘুমাবে বলে ঠিক করেছিলো। সৌরভের এই আশায় ঠান্ডা পানি ঢাললো বিষুদা। সকাল সকাল এসে বান্দা হাজির। কোন মতে চোখ খুলে সাত সকালে দরজা খুলতেই বিষুদার হাসিমাখা চোখ পড়ে সৌরভের নজরে। এই সক্কাল সক্কাল হরেন কাকুর ছোটপুত্তুর, নিজেকে প্রেমসম্রাট দাবি করা বিষুদার চোখে কালো রঙা সানগ্লাস। সৌরভ দরজা খুলে কোনমতে বিছানায় গিয়ে কাত হলো। বিষুদা হাসিমাখা কন্ঠে বললো, কিরে সৌরভ। আবার শুয়ে পড়লি যে? আমি এসছি গায় লাগাচ্ছিস না বুঝি? সৌরভ বিছানায় গা এলিয়া ঘুম জড়ানো কন্ঠে কি একটা বললো৷ বিষুদা ঠিক শুনতে না পেয়ে বললো, আচ্ছা ঘুমো তাহলে আমি যাই। সৌরভ এবার ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে বসতে বললো, যেও না। ক’দিন তোমাকে ফোন দিয়ে পাইনি।
সৌরভের জীবনের দুর্দশা শুনে বিষুদা কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘একটা কাজ আছে! করতে পারবি? ‘
সৌরভ চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া বাদ দিয়ে বললো,’কাজ এখন একটা পেলেই হয়’। বিষুদা বিস্কুটের মুখে দিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে বললো, ‘আহা যেমন তেমন কাজ নয়! হাইফাই কাজ। ” সৌরভ কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি কাজ?’ বিষুদা বিস্কুটে কামড় দিয়ে বললো,’তোকে একজনার প্রেমিক হতে হবে। ‘
-যাও ঠাট্টা করো না তো,’ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো সৌরভ।
-তবে শোন খুলে বলি তোকে, ‘ এক বিবাহীত নারীর প্রেমিক হতে হবে৷ মহিলার বয়স বেশি না। মেয়ে আছে একটা স্কুলে পড়ে। সারাদিন ঘরে একা পড়ে থাকে৷ আজকালকার দিনে স্বামীকে ছাড়া একা কে থাকতে চায়? আর ক’দিন আগে খবর পেয়েছে। তার স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত। তাই জেদ করে এখন সেও প্রেম করবে৷ তুই তো ইয়াং আছিস! দেখতেও ভালো। তুই মনে করবি তুই একটা সিনেমায় অভিনয় করছিস। মাস শেষে টাকা পয়সা তোর পকেটে ঢুকলেই তো হলো?। সৌরভ মাথা নাড়ায়,’হ্যাঁ।’
৩.
‘আসলে আমার স্বামী আমার সাথে এমনটা করবে আমি ভাবতে পারিনি। ওকে আমি ভীষণ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। বছর দুই হয়েছে ওর টাকা পয়সা বেড়েছে৷ এর মধ্যেই এই বাজে অভ্যাস হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। সৌরভ বেশ খানিকক্ষণ ধরে এই মহিলার প্যানপ্যানানি শুনছে। মহিলা দেখতে সুন্দরী, চুলে স্টাইলিশ কালার করা। মুখে দামী মেকাপ। আর পড়নে দামী পয়সার ফিনফিনে শাড়ি। মহিলা বললো, ‘আপনাকে তো আমার নামটাই বলা হয়নি, আমি মৌমিতা।’ সৌরভ এক গাল হেসে বললো, ‘আমি সৌরভ’। মৌমিতা এক গাল হাসে। সৌরভ বিব্রত বোধ করে কিছুটা। ‘আমার বয়ফ্রেন্ডের নাম ছিলো সৌর’ আর আপনি সৌরভ। এবার সৌরভ হাসে।
ওরা দুজন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে পাশের পার্কটাতে পায়চারি করে। মৌমিতা একা একা হাটে, সৌরভ পিছনে এগিয়ে যায়। এবার সতিই সৌরভের অস্বস্তি লাগছে। মৌমিতা পেছনে ঘুরে বলে, ‘ তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?
-‘না’
-আমি তোমাকে তুমি করা বলবো। কিছু মনে করো না।
-আচ্ছা। কোন অসুবিধা নেই।
-তুমি চাইলে আমাকে,’তুমি করে বলতে পারো। ‘
-হ্যাঁ। আচ্ছা।
সৌরভের সাথে মৌমিতার সখ্যতা হতে সময় লাগে না বেশিদিন। তবে সৌরভ নিজেকে ভীষণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এভাবে একজন সিঙ্গেল যুবক হয়ে একজন সুন্দরী নারীর সাথে প্রেমে পড়ে গেলে ভীষণ ঝামেলা। আফটার অল, তারা দুজন তো প্রেমই করছে।
৪.
সৌরভ বসে আছে হোটেলের ওয়েটিং রুমে। মৌমিতা সৌরভকে একান্ত সময় পাড় করার জন্য হোটেলে ডেকেছিলো। তবে মৌমিতার স্বামী টের পেয়ে যাওয়ায় ঝামেলা হয়েছে কিছুটা। সৌরভকে রুমের বাইরে চলে আসতে হয়েছে।
মৌমিতার স্বামী আফজাল সাহেব রুমে ঢোকার আগে তার সাথে আসা মেয়েটিকে বললেন বাইরে দাঁড়াতে। এরপর তিনি কামরায় প্রবেশ করলেন।মেয়েটি এসে সৌরভের পাশে বসলো। মনের অজান্তেই মেয়েটির দিকে চোখ যায় সৌরভের। মেয়েটিও তাকায় সৌরভের দিকে। দুজনার একসঙ্গে চোখাচোখিতে বিব্রতবোধ করে দুজনই। মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী, যাকে স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী উপমা দিলেও মন্দ হবে না। একটি কমলা রঙা, কালো পাইড়ের শাড়ি পড়েছে, গায়ে কালো রঙের ব্লাউজ এসব কিছুই চোখ এড়ালো না সৌরভের। মেয়েটি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি বই বের করলো। মাথা নিচু করে চোখ বোলালো বইয়ের পাতায়, চুলগুলো সামনে এসে পড়েছে৷ দুধে আলতা গায়ের রঙে মেয়েটিকে দেখে বার বার থতমত খেয়ে যাচ্ছিলো সৌরভ৷ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে। মেয়েটির চোখ বইয়ের পাতায়। চোখ সরিয়ে আবার তাকালো সৌরভের দিকে। বিব্রতকর হাসি দিয়ে সৌরভ বললো, ‘আপনার কাছে কি এক্সট্রা কোন বই আছে?’ মেয়েটি ভ্যানিটিব্যাগ থেকে একটি বই বের করে দিলো। বইয়ের নাম, ‘কৃকলাস’। কৃকলাস মানে গিরগিটি।
সৌরভ চোখ বোলালো বইয়ের পাতায়। তবে শুধু ভাণ করে বই পড়লো। মেয়েটির সাথে ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে সৌরভের। সময় গড়িয়ে যায়, আরও বার কয়েক চোখাচোখি হয়। মেয়েটি হাসে। সেই হাসিতে সৌরভের হৃদস্পন্দন বাড়ে। ভেতরের কামরায় মৌমিতা আর তার স্বামীর বাকবিতন্ডা শোনা যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই দুজনার।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, কৃকলাস হয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোও স্বস্তি পায় সময়ের ফেরে, সম্পর্কের ধূম্রজালে।
গল্পটির (দ্বিতীয় পর্ব)
ম্রিয়মাণ
আশিক মাহমুদ রিয়াদ
রাস্তায় জ্যাম লেগে আছে ঘন্টা দুয়েক ধরে৷ এই জ্যামে অতিষ্ট হয়ে কেউ কেউ রিক্সা থেকে নেমে হেটেছে ফুটপাথ ধরে। মানুষের কর্মব্যস্ততায় মুখর এই নগরী৷ এই নির্জন নিরিবিলি পথটায় সাধারণত জ্যাম লাগে না। জ্যাম লাগার কারন হচ্ছে একটি রিক্সাকে একটি মোটর সাইকেল ধাক্কা দিয়েছে। রিক্সাওয়ালা রাস্তায় পড়ে আছে। আশেপাশে মানুষদের জনসমাগম। রিক্সাওয়ালারা এখানে ছোটখাট একটা বিক্ষোভ ডেকেছে৷ মোটর সাইকেলওয়ালা মোটরসাইকেল রেখে সটকে পড়েছে।
রাস্তার ধারে বসে দুধচায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এসব দেখছিলো সৌরভ৷ কি যেন আনমনে ভেবে মুচকি হাসলো। ‘এই যে ভাই! শুনছেন? ‘, পাশ থেকে ডাকা লোকটির কথা খেয়াল করলো না সৌরভ। লোকটি কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো, ‘এক্সকিউজ মি ব্রাদার৷ আর ইউ লিসেন টু মি?’ সৌরভ চায়ের কাপে চুমুক থামিয়ে লোকটির দিকে তাকালো। অর্ধেক বিস্কুটটা মুখে নেওয়ায় কথা বলতে পারলো না ততক্ষণিক। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললো, ‘আমাকে বলছেন?’
-হ্যাঁ৷ আপনি কাইন্ডলি এদিকে আসবেন একটু?,বললো লোকটি।
-কেনো?
-আসুন আপনার সাথে কথা আছে একটু৷
সৌরভ উঠে লোকটির সাথে হেটে গেলো বড় সিরিস গাছটার আড়ালে।
-আসলে ঐখানে যে বাইকটি রাখা ওটা আমার বাইক৷ আমি ওখানে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না৷ আপনি আমাকে একটু হেল্প করবেন? ঐ বাইকটি প্লিজ ওখান থেকে এনে দেবেন?
-ইম্পসিবল! এটা কোন ভাবেই সম্ভব না৷ ওরা কি পরিমাণ খেপে আছে আপনি জানেন না।
লোকটি সৌরভকে হাতজোড় করলো।
-সৌরভ বললো, চলুন ঐ পুলিশের কাছে গিয়ে সমাধান খুঁজি।
পুলিশের প্রচেষ্টায় সেই বাইকটিকে উদ্ধার করা গেলো। অবশ্য বাইকার লোকটি সেই রিক্সাওয়ালাকে কিছু টাকা দিলো চিকিৎসার জন্য। পুলিশ ভদ্রলোককে এককাপ চা অফার করলেও পেটে এসিডিটি থাকায়, চা খাওয়ার প্রস্তাব সে গ্রহণ করতে পারলো না।
বাইকার সৌরভকে বললো, আপনি কি খাবেন বলুন। আমার একার পক্ষে এই বাইকটি ফিরে পাওয়া সম্ভব হতো না। সৌরভ ভদ্রলোকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলো না। সৌরভ বললো, কিছু খাওয়াতে হবে না। চলুন আমাকে একজায়গায় ড্রপ করে দেবেন।
২.
হাসপাতালের করিডোরে হাটছে সৌরভ। মৌমিতাকে কত নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে তা ঠিক খেয়াল নেই। রিসিপশন থেকে সৌরভ কায়দা করে জেনে নিয়েছে, মৌমিতা নামের তিনটি মেয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে৷ যাদের মধ্যে একজন বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টায়, আরেকজন গর্ভবতী আর আরেকজন মাথায় চোট পেয়ে। তিনশো বত্রিশ নম্বর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে সৌরভ। ভেতরে যাবে কি না ভাবছে। দরজায় হালকা কড়া নাড়তেই ভেতরে থাকা নার্স কঠিন কন্ঠে বললো, ‘কাকে চান?’ সৌরভের ভেতরে দোলাচল শুরু হলো। নিজেকে প্রস্তুত করে জবাব দিলো,’ভেতরে মৌমিতা আছে?’ নার্স দরজা মুখের ওপর লাগিয়ে দিয়ে। কিছুক্ষণ পর আবার খুলে দিলো। বিনয়ী কন্ঠে বললো, ভেতরে আসুন।
মৌমিতা সৌরভকে দেখে বললো, আমি জানতাম তুমি আসবে। দেখো আমি সুস্থ হয়ে গেছি৷ তাও ওরা আমায় ছাড়ছে না, আসলে ঐ ক্রিমিনালটা আমায় ছাড়তে দিচ্ছে না৷ আমাকে জোড় করে বেধে রেখেছে যাতে সুযোগে ঐ মেয়েটার সাথে লীলাখেলায় মজতে পারে।
-সৌরভ ঠান্ডা গলায় বললো,’প্লিজ আপনি উত্তেজিত হবেন না৷ মাথা ঠান্ডা রাখুন। ‘
-মৌমিতা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘ ও তুমিও আমাকে এখন আপনি করে বলছো? কি একটা অবস্থা দেখো ‘
-সৌরভ হালকা বিষম খাওয়ার মতো করে বললো,’ইয়ে না মানে।সরি। তুমি টেনশন করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
-ক’দিন ধরে আমার মেয়েটাকে দেখি না। ওকে একটু নিয়েও আসে না ক্রিমিনালটা৷’
-সৌরভ বললো, আচ্ছা আমি নিয়ে আসবো।
বেশ কিছুক্ষণ মৌমিতার সাথে কথা বলে, কেবিন থেকে বের হয়ে আবারও হাসপাতালের করিডোর ধরে হাটা শুরু করলো সৌরভ৷ হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার আগে দেখা হলো মৌমিতার স্বামী আফজাল সাহেবের সাথে। অবশ্য মাস্ক পড়ে থাকার কারনে আফজাল সাহেব খেয়াল করলো না সৌরভকে।
৩.
হাসপাতালের গেট থেকে বের হওয়ার আগে পিছু ডাকে ক্ষাণিক থমকে দাঁড়ালো সৌরভ। ‘এই যে…এই যে শুনছেন? হ্যালো?’ সৌরভ পেছনে ফিরে তাকালো.. এই মেয়েটিকে সৌরভ সেদিন দেখেছিলো। হোটেলের ওয়েটিং জোনে! মেয়েটির কাছ থেকে একখানা বই আনা হয়েছিলো সৌরভের৷ বইটির নামটা এখন ঠিক মনে পড়ছে না।
সেদিন বই পড়তে পড়তে এসির ঠান্ডা বাতাসে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো সৌরভ। চোখ খুলে আর মেয়েটিকে দেখেনি।
-সৌরভ মেয়েটিকে বললো,’সর্যি, সেদিন ভুলে আপনার বইটা নিয়ে গিয়েছিলাম। আর দেওয়া হয়নি।’
-এসব বাদ দিন..সময় করে একদিন বইটা দিলেই হবে। আমি তিথি! ‘ হাত দুটোই সামনে এনে বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো মেয়েটি। এক হাত বাড়িয়ে দিলো সৌরভের দিকে।
সেদিনের পরিচয় পর্বটা আজকেই সারতে সারতে ওরা দুজন শহরের ফুটপাত দিয়ে হেটে চললো। ক্ষাণিক দাঁড়ালো, আবার হাটলো।
মৌমিতা যে ক্ষোভের কারণে সৌরভের সাথে প্রেম প্রেম খেলছে সেই প্রেমের আগুনে তপ্ত ঘি.. তিথি।মৌমিতার সন্দেহ তার স্বামী আফজাল সাহেবের সাথে মেয়েটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তারা প্রেম খেলায় লিপ্ত। এ কথা জানে সৌরভ।
মেয়েটিকে সেদিন থেকেই তার ভীষণ ভালো লাগে। মেয়েটির মধ্যে কেমন সরলতা আছে, তবে কোন আড়ষ্টতা নেই। সেদিনের পর থেকে মেয়েটির মুখখানা কতবার যে সৌরভ মনে করার চেষ্টা করেছে, তবে বিভ্রম রোগে সে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। গভীর রাতে অচেনা বুক ধড়ফড়নিতে নিজের অজান্তে সিগারেট জ্বালিয়ে লম্বা টান দিয়েছে। সামনের ময়লার স্তুপ থেকে বিদঘুটে গন্ধে, আষ্টে গন্ধ, বিশ্রি গন্ধ মিলেমিশে তাকে দিয়েছে অদ্ভুত এক অনুভূতির সঞ্চার। মানুষজন একে প্রেম বলে, অপার্থিব পাক্ষিক প্রেমের নিদারুণ আবেগের রসটসা সুখ।
৪.
বসন্তের লালচে দিনের কথা, শহুরে গাছে পলাশ শিমুল। রিক্সার টুংটাং আওয়াজ, গাড়ির চাকার ভোতা শব্দের অর্কেস্ট্রা শুনতে শুনতে দুধ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলো সৌরভ। আজ সারাদিন কোন কাজ নেই, এতদিন যে প্রেম-প্রেম অভিনয়ের চাকরীটা করে আসছিলো সেটা থেকে আজ সে মুক্ত। তবে মৌমিতা সৌরভকে লাখখানেক টাকা দিয়েছে, মৌমিতার খালাতো ভাইয়ের অফিসে একটা চাকরী জোগাড় করে দিয়েছে। আজ সৌরভের সুখের দিন। এই সুখে সে দুধ চা’তে চুমুক দিয়েছে।
রাস্তার ওপাশে তখন রাস্তা পাড় হতে ব্যস্ত একটি মেয়ে। সৌরভ চায়ের কাপ রেখে এগিয়ে গেলো মেয়েটির দিকে। ব্যস্ত রাস্তায় মেয়েটি পরিচিত ভরসার হাত পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলো। ওরা দুজন রাস্তার ধারের ফুটপায়ে শিমুল গাছের তলায় বসলো।
ফাল্গুনের শহরে বইমেলা শুরু হয়েছে। কত লেখকের গল্পপটে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সব চরিত্রের। শহুরের বিষাক্ত বাতাস থেকে মুক্তি পেতে ওরা দুজন হাটলো বই মেলার দিকে। তিথি সৌরভের হাত ধরলো.! সৌরভ খুঁজে পেলো ম্রিয়মাণ অশোক সূর্যাস্ত শেষে নব সুখের স্নিগ্ধ শীতল সূর্যোদয়.. ওরা দুজন.. একে অপরের ফাগুন-মলাট হয়ে ঘুরে বেড়ালো বইমেলায়।
বিষন্যতা শেষে ফাগুন আসে তুমুল যুগল প্রণয় হরণে, হিমেল হাওয়া সাজায় প্রেম পঙ্ক্তি৷