পর্ব – ১ :
শুরুতেই কয়েকটা কথা
মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের জীবন যেন রাঙতায় মোড়া । বাইরেটা চকচকে , ঝকঝকে । ভিতরে আশা স্বপ্ন আকঙ্খা কষ্ট বেদনায় বিহ্বলতার টেনশানের নিশ্চয়তা – অনিশ্চয়তা। তিন দশক জুড়ে ‘ আমি ‘ এবং ‘ আমার ‘ জীবনের গতি ।
তবে এই দুই সর্বনাম মুখ্য নয় । একদমই না । এই স্মৃতি ‘ আমিত্ব ’ এর অশ্লীল সাগরে বারবার হাবুডাবু খাওয়া নয় । “ আমারে না যেন করি প্রচার , আমার আপন কাজে ( গীতবিতান ) । “ তাই ইহা প্রকৃতই প্রতিনিধিত্বমূলক । রিপ্রেজন্টেটিভ ।
ফার্মা সেলস ও মার্কেটিং- এর কর্পোরেট জগতের একটা দিন বদল । বিশেষ ধরনের , অন্য অভিজ্ঞতার । পড়াশোনা পর উপার্জনের উপায় , আর্থসামাজিক চড়াই উতরাই । গ্রাম মফস্বল থেকে মেট্রো শহরে , এই পেশার সংগে জড়িত মানুষজনের জীবন যাপনের দিনলিপি । বেঁচে থাকার কর্মকাণ্ড । যেন “ অধিকাংশ লোকই অন্য লোক ( Most people are other people ) “ — অস্কার ওয়াইল্ডের এই দাবিটির বর্ণনা । একটা নয় , অনেক । অন্য লোকের মতামত , তাদের জীবন , তাদের ভাবাবেগ ।
পেশাদারী জীবনের শুরু মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ থেকে এই কঠিন , খট্মটের কর্পোরেট জগতে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা অত্যন্ত জটিল ও কূটনৈতিক । আবার একটা কোম্পানির জন্মের আদি পর্ব থেকে শ্রমসাধ্য কষ্টকর লড়াইয়ের দীর্ঘ পথের বাঁকে বাঁকে আছে অর্থনীতির ছবি । জীবনকুশলতা , জীবনের গতি ।
“ মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল – মাঝে
আমি মানব , একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ……
অনন্ত এ দেশকালে , অগণ্য এ দীপ্ত লোকে ,
তুমি আছ মোরে চাহি — আমি চাহি তোমা পানে ।
স্তব্ধ সর্ব কোলাহল , শান্তিমগ্ন চরাচর –
এক তুমি , তোমা মাঝে আমি এক নির্ভয়ে । “
( গীতবিতান , রবীন্দ্রনাথ ) ।
উনিশ-শো নব্বই -এর ছাব্বিশে জানুয়ারি । কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিট । কন্-টেস্ট ( KonTest ) অফিসের রিসেপশানে ইন্টারভিউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি । জাতীয় ছুটির দিন হলেও চুপিসারে , অনেকটা ছুটির আমেজের মধ্যে এই ইন্টারভিউয়ের পর্ব । তা অবশ্য আমার জন্য বেশ ভালো হল । কেননা এ-দিন , আমার , ‘ ডব্লিউ- বি – সি – এস ‘ পরীক্ষা নেই । ছুটির দিন , স্বাভাবিক ভাবে কন্-টেস্ট ( KonTest ) অফিস প্রায় ফাঁকা । মোটা গোঁফ , কালো , কম বয়সের একটি ছেলে রিসেপশানে বসে আছে । সে প্রিয় দা । পরে নামটা জেনেছি ।
মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের জন্য দু – তিনবার ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম । ইউনিশারচ বলে বম্বের কোম্পানিতে আমার প্রথম ইন্টারভিউ দেওয়া , কলকাতার লিটন হোটেলে । সেটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতা । পরে আমেরিকান রিমেডিস ও বুলু-ক্রশ কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছি । এই ইন্টারভিউ গুলো হোটেলের বড় রুমে হয়েছিল । কিন্তু এখানে কোম্পানির অফিসে ইন্টারভিউ । তাই একটা ভালোলাগা অনুভূতি ।
কিছুক্ষণ পরে আমার পালা । একটা অস্বচ্ছ কাঁচের ঘরে দিকে আমাকে যেতে অনুরোধ করলো । একজন মাত্র মাঝ বয়সী । আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে , গম্ভীর কণ্ঠে বাংলায় বলেন , ‘ আমি অশেষ দাস ‘ । সেই আমার প্রথম আলাপ অশেষদার সঙ্গে । ছোটছোট কয়েকটা প্রশ্ন করে , আমার টেনশান অনেকটা কমিয়ে দিলেন । আমি কেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরির চেষ্টা করছি – এই প্রশ্নটাই উনি বারবার করেছেন । উত্তরটা ঠিক ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে পারছিলাম না । সে দিনের অল্প কয়েক মিনিটের আলাপ , ধীরে ধীরে নিবিড় হয়েছে । সম্পর্কের গভীরতা বেড়েছে । পিতৃ-সম অবিভাবক ছিলেন অশেষদা , আমার এই পেশাদারী জীবনের বাঁকে বাঁকে ।
পড়াশোনাটা যতটা গভীরভাবে করা উচিত ছিল , ততটা করা হয় নি । স্কুলে ভালো ছাত্র হিসাবে বিশেষ ভাবে পরিচিত । কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ফিজিওলজি অনার্স নিয়ে , পড়াশোনাটা অতটা গভীরভাবে হল না । জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা করার অগাধ বাসনা থাকলেও , আন্তরিকভাবে ততটা জয়েন্টের পড়াশোনাতে নিমগ্ন ছিলাম না হয়তো । ঐ সময়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বাবা-মা দের তীব্র ইচ্ছা ও উদ্যোগ থাকতো ছেলেমেয়েদের ডাক্তার – ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে ‘বড় ‘ করে , সামাজিক স্ট্যাটাস । তবে ‘ডাক্তার ‘ হবার একটা বাসনা মনের গভীরে বাসা বেঁধেছিল । বড় নামজাদা ডাক্তার ভেবে নিজেকে নিয়ে কত কি যে কল্পনা করতাম !
গত শতকের আশির দশক । আমাদের পড়াশোনার আবহাওয়াতে যান্ত্রিকতা কম ছিল । পড়াশোনার সিলেবাসের বাহিরে লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পড়া , যুব উৎসব , সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা , বিজ্ঞান মডেল প্রদর্শনী ইত্যাদির একটা বাড়তি গুরুত্ব ছিল, আমাদের ছাত্রজীবনে । বাবা মা এবং অভিবাকদের মধ্যেও । মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই কবিতা লেখা শুরু করি । সাহিত্য আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করার একটা বাড়তি আকর্ষণ ছিল । এই ব্যাপারে ভালো রকম প্রেরনা ও উৎসাহ ছিল মাস্টারমশাইয়ের , শ্রীকান্ত দত্ত সরকার ( আমার গৃহ শিক্ষক ) ।
‘ এম-এস সি ‘ তে চান্স না- পেয়ে , খুব আশাহত হয়েছিলাম । ঐ সময়ে কলেজের ও ইস্কুলের বন্ধুদের সার্কেলের বাইরে থাকার চেষ্টা করেছি । মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডাম ‘- এর তিরিশ পাতার অপ্রকাশিত কিছু লেখা নিয়ে বেশ আলোড়ন । কলেজ স্ট্রিট থেকে পুরনো বইটা কিনে পড়া শুরু করেছি । পড়তে পড়তে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতরে মিশে গেলাম । এই বইটা আমার রাজনৈতিক ভাবানার গতি বদলে দিল । পাড়ার দাদা সম্পর্কের কানুদা , আমাকে হীরেনদ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ তরী হতে তীর ‘ পড়তে বলেন । কলেজ স্ট্রিটের মনীষা থেকে ডিসকাউন্টে জমানো পয়সায় বইটা কেনা । ‘ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডাম ‘ স্বদেশকে চেনার ও দেখার জানালা খুলে দিয়েছিল । আর ‘ তরী হতে তীর ‘ আমাকে বিশ্বের উঠানে দাঁড় করিয়েছে ।
ছেলেবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি যে মাধ্যাকর্ষণের বীজ বপন করা হয়েছিল । মনের উর্বর জমিতে , ‘ মানুষ হও , বড় হও ‘ বলে যে প্রেরণার ইনপুট দেওয়া হয়েছিল । যেন সেইসবের প্রাসঙ্গিকতার যুক্তি পাল্টা যুক্তিতে অনেক পরিণত হওয়ার অনুপ্ররনা হল ‘ তরী হতে তীর ‘। আমার মনের বিকাশ ও উত্তরনের সিঁড়ি । এই যে সফটওয়ার সেই সময়ে ঠিক ভাবে আপলোড করতে পেরেছিলাম বলেই , তা এখনও আমার পরিণত ভাবানচিন্তার অবয়ব । মনের প্রশান্তি । হৃদয়ের স্বচ্ছতা ।
এই সময়টা চাকরী পাবার জন্য অনেক ধরনের পড়াশোনা করেছি । ডাবলু – বি -সি- এস , ফরেস্ট সার্ভিস ইত্যাদি পরীক্ষা দিয়েছি । ইচ্ছা ছিল যতটা বেশী , প্রচেষ্টা ততটাই কম ছিল । এই প্রেক্ষিতে অন্য বিষয়ে পড়াশোনাটা করেছি বেশী । রবীন্দ্রনাথে হাবুডুবু খেয়েছি , বুঝে না-বুঝে । এমনকি ডি এইচ লরেন্সের ‘ লেডি চাটারলিস লাভার ‘ । বন্ধুদের সংগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাত জেগে আড্ডা দেওয়া হয় নি । বাড়ীর নিয়মের অবাধ্য হয় নি , কখনও । সুবোধ বালকের মতো সরল রুটিন মেনে চলতাম । পরের দিকে , পরিণত জীবন যাপনের দিন গুলোতে সেটা সমান ভাবে প্রকট আছে । প্রচ্ছন্ন হয় নি ।
কলেজের বন্ধু জয়দেব । মেদনীপুরের বেলদার ছেলে । ওর বাগবাজারের বাসা বাড়ীতে মাঝে মাঝে সারা দুপুরটা গল্প করে কেটেছে অনেক দিন । জয়দেব হাঁসের ডিমের ডালনা ভালো রান্না করতো । বাকীদের সংগে সম্পর্কটা আলগা হয়েছে । আমার এম -এস -সি তে চান্স না-পাওয়াই , এই হীনমন্যতায় ভোগার এক ধরনের যুক্তি সংগত কারন । কলকাতার বাহিরে থেকে এম -এস -সি করার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে । পারিবারিক সামর্থ্যের সীমা । জোর করে সেই সীমা টপকে হাওয়ার ইচ্ছায় আমার নিজেরও ঘাটতি ছিল ।
এই সময় জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হল বাপি , সুবীরের সংগে তিন বন্ধু মিলে দিল্লী আগ্রা মথুরা বেড়ানো । এই ভ্রমনের বিবরণ জীবনের বিরাট সঞ্চয় । বেড়ানোর পয়সা বেশী নেই । প্রয়োজনের থেকে অনেক কম পয়সা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর এক নির্মল আনান্দ । এখনকার মতো মোবাইলের ছোট দুনিয়া তো ছিল না । সম্পূর্ণভাবে আমারাই রাজা , স্বাধীন , স্বশাসিত । ঐ কদিনের জন্য । বুঝে মেপে খরচ করা , থাকা এবং খাওয়া । শরীর ঝিমিয়ে পড়লেও , উদ্দাম আনান্দে উচ্ছ্বাসে ঘুরে বেড়িয়েছি ।
বেড়ানোয় পয়সার টানাটানি ছিল , তবে আনান্দ ছিল অসীম । তা পরবর্তী জীবনে অনেক টাকা খরচ করেও পাই নি । সে দিনকার তাজমহলের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য , সেই বিস্ময়ের বিশালতা , অনুভূতির আবেগ আজও পাই নি । পরে তিন চারবার তাজমহলের চত্বরে বসে সে দিন কার সেই তাজমহল খুঁজে পাবার চেষ্টা করেও পাই নি । সৃষ্টিকর্তার তৈরি আমাদের মনের এই সফটওয়ারে , সেই অনুভূতি পুন্রুজ্জীবিত করা যায় না হয়তো । তাই । সেই বিস্ময়ের অনুভূতি এখনও অবসরে আনমনে মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে । না-বলা আনন্দে শিহরিত হয় , পুলকিত হয় ।
উনিশ-শো নব্বই -এর এপ্রিলের মাঝামাঝি ফাইনাল ইনটারভিউর চিঠি পেলাম । ডাকযোগে । ইনটারভিউতে অশেষদা ছিলেন না । কন্-টেস্ট ( KonTest )-এর অল ইন্ডিয়া সেলস ম্যানেজার — মিস্টার ভিক্টর ইমানুয়েল আম্বেট । উনি ব্রিটিশ সাহেব নন , বাঙালি খ্রিস্টান । বড় বড় চোখ পাকিয়ে , ঘুরিয়ে বাঁকিয়ে নানান অজস্র প্রশ্ন । আমার পড়াশোনার গভীরতা আছে । বাবা পদস্থ সরকারী পদে কর্মরত । দুই কাকাও সরকারী চাকুরীজীবী । ফার্মা কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজন্টেটিভের পেশায় আমি ঠিক মানিয়ে নিতে পারবো না হয়তো । তাই মিস্টার আম্বেট বেশ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন । যাই হোক , অবশেষে উনি আমাকে এই চাকরির অফারটা দিলেন । ইউ আর সিলেক্টেট ।
লেখক- প্রাবন্ধিক,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত ।