ড. গৌতম সরকার
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খবরটায় ‘গ্লোবাল ইকোনমি’ শব্দবন্ধটি আরোও একবার হাস্যকর এবং স্ববিরোধী হয়ে উঠল। আসলে কথাটির মধ্যে ‘ইকোনমি’ শব্দটা মিশে থাকলেও সাধারণ মানুষের স্বপ্নে সেইরকম একটা পৃথিবীর ছবি ভেসে ওঠে যেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতি সবকিছু মিলেমিশে মানুষজন পরস্পরে হিংসা ও অধিকারের রাজনীতি ভুলে সুখে-শান্তিতে বাস করবে। এটা পড়ে পাঠকের মনে প্রবন্ধকারের মানসিক স্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বুঝতে হবে স্বপ্নকে কোনও নিষেধের বেড়াজালে বন্দি করা যায়না। তাই একদিকে দেশে-দেশে শান্তিচুক্তি, বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষরিত হবে, রমরম করে এগিয়ে চলবে ন্যাটো, ইউরো জোন, আসিয়ান, নাফতা, জাতিপুঞ্জ ইত্যাদি ইত্যাদি, আবার অন্যদিকে হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ, হত্যা, মৃত্যু, হাহাকার, লোভ, মোহ, মাৎসর্যও নিজের মত করে চলতে থাকবে, এবং এই শান্তি আর হিংসার মধ্যে কার্যত কোনও বিরোধ থাকবে না। আর আজ যারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য রাশিয়াকে ভর্ৎসনা জানাচ্ছে, বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, স্থল-জল-আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিচ্ছে, তাদের পূর্ব ইতিহাস একটু স্মরণ করলে দেখা যাবে তারাও একই দোষে দোষী। আসলে কার স্বার্থ কখন ক্ষুন্ন হয় কে বলতে পারে! যার যখন ক্ষুন্ন হয় সে তখন স্বমূর্তি ধারণ করে।
যুদ্ধ শুরু:
রাষ্ট্রসংঘের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইউক্রেনে নিজেদের ‘সামরিক অভিযান’-এর কথা ঘোষণা করল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বেশ কয়েকদিন ধরেই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। সেই আশঙ্কায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির অনুরোধে গত বুধবার আমেরিকায় রাষ্ট্রসংঘের জরুরি বৈঠক বসেছিল। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রসংঘের প্রধান পুতিনকে হামলা বন্ধ করে শান্তিবৈঠকের মধ্যে দিয়ে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানায়। সে অনুরোধে কর্ণপাত না করে ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার ভোরে পুতিন যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ঘোষণার একমিনিটের মধ্যেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাশিয়ান সৈন্যবাহিনী একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে দেয়।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাশিয়ান সেনারা কিয়েভ, খারকোভ, ওডেসা-সহ ইউক্রেনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। রাশিয়ার প্রাথমিক নিশানায় ছিল ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বিভাগ। শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ডিফেন্স মিনিস্ট্রির বিল্ডিং থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ সাধারণ নাগরিকদের দেশ বাঁচাতে অস্ত্র হাতে বাড়ির বাইরে বেরোতে আহবান জানিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইউক্রেনের সমর্থনে বার্তা আসছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানিয়েছেন, ‘এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমার দেশ সর্বতোভাবে ইউক্রেনের মানুষের পাশে রয়েছে।’ বার্তায় তিনি এটাও জানিয়েছেন, ‘আমরা আপনাদের পাশে আছি। আগামী দিনে ব্রিটেন রাশিয়ার সঙ্গে সমস্তরকম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে।’ প্রথম দিনই ইউক্রেনে মৃতের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ, যার মধ্যে ছিল চল্লিশ জন সেনা আর দশজন সাধারণ মানুষ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দাবি তার দেশ রাশিয়ার এই আগ্রাসন রুখতে বদ্ধপরিকর, তিনি দেশের প্রতিটি মানুষের এই যুদ্ধে ঐকান্তিক যোগদানের ব্যাপারে বিশ্বাসী। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে দুই দেশের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় আক্রমনের ঘটনা।
কেন এই যুদ্ধ:
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত দীর্ঘদিনের। সেই ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে ইউক্রেন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন থেকেই দুই দেশের বিবাদ শুরু। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অভিযোগ, ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতারা রুশবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত। গত বছরের জুলাই মাসেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন পুতিন। বৃহস্পতিবার যুদ্ধঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ এবং আত্মসমর্থনের দাবি জানিয়েছেন রাশিয়ান্ট প্রেসিডেন্ট।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়। রাজনৈতিক, সমাজনীতি ও আর্থিক দিক দিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় একদা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সমাজতন্ত্র। সেইসময় ইউরোপের বহু দেশ, যেমন- হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ন্যাটোতে যোগদান করে। সাম্যবাদী রাশিয়াকে প্রতিহত করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই ন্যাটো তৈরি হয়েছিল। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ হল, রাশিয়া চায় না ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, রাশিয়ান আর ইউক্রেনীয়রা এক জাতি। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও অনেকটা এক। একটা সময় তারা একই দেশ ছিল, সেই দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণকারী একটি আন্তর্জাতিক জোটের সামিল হবে সেটি তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
পুতিনের মতে, পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রক্ষা করতেই তাঁর এই যুদ্ধ ঘোষণা। তাঁর অভিযোগ, ইউক্রেন সরকার দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর হামলা চালাচ্ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য, কিছুদিন আগেই পূর্ব ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দিতে রাশিয়া সৈন্য প্রেরণ করেছিল। যুদ্ধ ঘোষণার পর দুই দেশের মধ্যে সমস্তরকম যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে রাশিয়া কিয়েভে মিসাইল হামলা চালিয়েছে। যদিও পুতিন জানিয়েছিলেন তারা কেবলমাত্র পূর্ব ইউক্রেনেই হামলা চালাবে, কিন্তু যুদ্ধ যত এগোচ্ছে আক্রমনের ঝাঁজ দশদিকে টের পাওয়া যাচ্ছে।
ইউক্রেন হল ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। ইউক্রেনের পূর্বে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাস। তারা আগেই এই অঞ্চলের দুটি জায়গাকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে এই যুদ্ধ নিয়ে উদগ্রীব সারা বিশ্ব। এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করছে পশ্চিমী দুনিয়া। তাদের অভিযোগ ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় হামলা শুরু করেছে রাশিয়া।
বিশ্বের হুমকি:
স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রসংঘের আপত্তি অস্বীকার করে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই যুদ্ধের শুরুকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালোভাবে নিচ্ছে না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই যুদ্ধে জীবনহানির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত শুক্রবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে কথা বলেছেন। মোদি পুতিনকে যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। বাইডেন জানিয়েছেন, তাঁর দেশ যুদ্ধের প্রত্যেকটি ব্যপারে নজর রাখবে এবং পাশাপাশি ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির সাথে বৈঠক করে নিজেদের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করবে। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার প্রস্তাব পেশ হয়েছে। সমস্যা হল রাশিয়া এই নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য। তারা যদি ভেটো দেয়, তাহলে কোনও প্রস্তাব আইনগত স্বীকৃতি পাবে না।
হামলা চালানোর প্রতিবাদে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সমস্ত ব্যাংকগুলির সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে। যদিও পুতিন সেই হুমকিকে গ্রাহ্যের মধ্যে নেন নি। পুতিনের পাল্টা হুমকি, ‘যে দেশ এই সামরিক অভিযানে হস্তক্ষেপ করবে, তাদের ফল ভুগতে হবে’৷ রাশিয়া পশ্চিম দুনিয়ার কাছে প্রতিশ্রুতি চায়, ইউক্রেনকে তারা কোনোভাবেই ন্যাটোর সামরিক জোটের অংশীদারী করবে না। যদিও বাইডেন জানিয়েছেন, মার্কিন সেনারা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না, কিন্তু যুদ্ধ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে আগামী দিনে কি ঘটতে চলেছে সেটা ভবিষ্যতই বলবে।
ইউক্রেন পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার অংশ হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে অর্থনীতি এবং রাজনীতির ব্যাপারে জেলেনস্কি সরকার পশ্চিমী দেশগুলোর উপর নির্ভর করতে চায়। এখানেই রাশিয়ার আপত্তি। ইউক্রেনের বেশ কিছু মানুষ, বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনের মানুষেরা রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। এই মানুষগুলো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে সমর্থন করে। এই সমর্থনই পুতিনের শক্তি। এরমধ্যে ২০১৪ সালে যখন ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তখনও দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই সময় ক্রিমিয়া সমেত পূর্ব ইউক্রেনের একটা বড় অংশ রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে চলে যায়। এর পরের বছর শান্তির খোঁজে দুই দেশের মধ্যে ‘মিনস্ক’ চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু সেই চুক্তি খাতায় কলমেই থেকে গেছে, বাস্তবে কোনোরকম প্রকাশ ঘটেনি।
যুদ্ধ কখনও কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারেনা। শিশুপাঠ্যের এই সহজ-সরল নীতিবাক্য বড়দের কানে পৌঁছয়না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে কোনও কিছুই দেশের কাঁটাতার দিয়ে আটকে রাখা যায়না, যুদ্ধের ক্ষেত্রে তো আরোই নয়। যুদ্ধ শুরুর প্রথমদিনেই বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারে ব্যাপক ধস নেমেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যেই অতিমারীর কারণে মুদ্রাস্ফীতি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। যুদ্ধ তাকে আরও নাগালের বাইরে ঠেলে দেবে। এখন সমস্ত দেশই উন্নত প্রযুক্তির পারমাণবিক অস্ত্রে নিজেদের শক্তিশালী করে তুলেছে। সেই অস্ত্রের ন্যূনতম প্রয়োগে সারা বিশ্বে যে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে সেই ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন! তাছাড়া আজ যারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কাল তারাই যদি যুদ্ধে সামিল হয়ে পড়ে, তাহলে জীবদ্দশায় আরও অনেক আশ্চর্য এবং আজব দর্শনের সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটাও দেখা হয়ে যাবে।
লেখক: অর্থনীতির সহযাগী অধ্যাপক
তথ্যঝণ: ইন্টারনেট