যেমন গানের রেওয়াজ, শরীরীর চর্চা, সাঁতার শেখা, তেমনি নিয়মিত রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চা খুবই জরুরী

যেমন গানের রেওয়াজ, শরীরীর চর্চা, সাঁতার শেখা,  তেমনি নিয়মিত রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চা খুবই জরুরী

 মিরাজুল হক

তখন কি হবে?
যখন আমাদের নতুন প্রজন্ম চোদ্দ পনের বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যশা করা হবে । বিশেষ করে আশা করা হবে তারা যেন সঙ্কোচের বিহ্বলতা ভুলে দেশ গঠন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে , সভ্যতার অগ্রগতির জন্য । মানব সভ্যতার বিকাশের জন্য ।
কিন্তু দেশ সভ্যতা তো মৃন্ময় নয় । দেশ মাটিতে তৈরি নয় । দেশ মানুষের তৈরি । মানুষ তৈরির জন্য দরকার নানান উপকরন । মানবিক গুণাবলী – দয়া মায়া মমতা , পাড়া প্রতিবেশী প্রতি টান , সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার অভিজ্ঞতা লব্ধ বস্তু । সে জন্য দরকার গাছপালা নদী মাঠ প্রান্তর পরিবেশ ইত্যাদির জ্ঞানসম্পন্নতা ।
মানুষের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় স্থানিকতা – চারপাশের মানুষজন ,ছোট নদী , দূরের পাহাড় , গাছপালা রাস্তাঘাট ঘরবাড়ী , গলিতে টুকতে বা-হাতে পোস্ট অফিস , মোড়ের মাথায় নরেন কাকার মুদি দোকান – এই সব নিয়ে আত্মার সংযোগ । এই স্থানিকতার সবচেয়ে বড় অঙ্গটি অবশ্যই মানুষে মানুষে দৈনিক আদানপ্রদান ।
এই সব মানবিক গুনের প্রাপ্তি , জ্ঞান অর্জন তো এমনি এমনি হবে না । তা নিয়মিত অনুশীলন ও চর্চার বিষয় । আর এইখানে মানবচেতনার বিকাশে সাহিত্যের বড় ভুমিকা আছে – সাহিত্য কি , সাহিত্য কেন , কত দিক তার !
মানুষ তো মননশীল জীব । অন্যান্য প্রাণীদের মত সে শুধুই খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে না । বাঁচার জন্য তার মননশীলতার চর্চার প্রয়োজন । এই ধারনার অনুশীলনের অভাব আছে । চর্চা নেই । এই মননশীলতার চর্চার করতে গিয়েই সে সৃষ্টি করেছে সাহিত্য , বিজ্ঞান , শিল্প প্রভৃতি বিষয় ।

সেই শিশুবেলা থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এই চর্চার শুরু হয় । জল পড়ে , পাতা নড়ে । গাছে থাকে পাখি , পাখি গান গায় । এই সাহিত্যপাঠের অনুশীলন জীবনের ‘ স্কুল-বেলা ‘ য় খুব জরুরী । বিশেষত সতের আঠারো বয়সের সীমানায় তা পরিণত হয় , বিকশিত হয় ।
এই একটি ‘ সফট ওয়ার ‘ সঠিক ভাবে আপলোড না-করতে পারলে বিভিন্ন ধরনের মনের অসম্পূর্ণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে । হৃদয়ে অমানবিকতা বাসা বাঁধে । সতের আঠারো বয়সের পর নতুন করে এই ‘ সফট ওয়ার ‘ ইনস্টল ‘ করা সহজ নয় । কেনানা এই বয়সের পর পড়াশোনার গতিপরিবর্তন হয় , জ্ঞান-বিজ্ঞান , বাণিজ্য সাহিত্য সমাজনীতি অর্থনীতির নানান শাখা প্রশাখায় ।

আর এই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের ভুমিকা ও অবদান বড় বেশী প্রাসঙ্গিক । আমাদের মস্ত বড় সৌভাগ্য যে , আমরা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জন্মগ্রহণ করেছি। তা আমরা ঠিক বুঝতে পারি না । অবশ্য এই প্রজন্মের চৌদ্দ পনের বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এই আকুতি বড় বিদ্রুপের বিষয় !
তাঁকে নিয়ে এত মাথা ব্যাথা কেন ? তিনি কি আমাদের মতো এত ভালো ইংরাজি বলতে পারতেন ?

বাংলা ভাষা আজ থেকে দেড়শ বছর আগে একটা অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ভাষা ছিল । অতি মান্ধতা আমলের হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা একটা প্রাকৃতজনের ভাষা ছিল ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের আশি বছর দিয়ে , বাংলা ভাষাকে পাঁচশ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন । আধুনিক ভাষার সমকক্ষ করে তুলতে পেরেছিলেন । ভারতের যে চোদ্দ পনেরটা প্রাচীন ভাষা আছে , তার সংগে যদি তুলনা করা যায় তাহলে বৈশিষ্ট্যে ও আভিজত্যে বাংলা ভাষা বহুদূর এগিয়ে আছে । পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলি ইংরেজি , স্প্যানিশ , ফরাসী ইত্যাদি ভাষার সমগোত্রে পৌঁছে গেছে ।
এই কারনে বাংলা ভাষার সাহায্যে যে কোন চিন্তার মধ্যে পোঁছে যেতে পারি । ভাষা যত এগিয়েছে , আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা তত এগিয়েছে । ভাষা হচ্ছে চিন্তার আধার । এই চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য একটা সমকক্ষ ভাষার দরকার । রবীন্দ্রনাথ সেই ভাষাকে সেই স্তরে উন্নিত করে দিয়েছেন ।

তাঁর ৭০ তম জন্মদিনে যে জয়ন্তী উৎসব হয়েছিল , সেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁকে মানপ্ত্র অর্পণ করতে গিয়ে ‘ সার্বভৌম কবি’ বলে সমদ্ধোন করেছিলেন । সর্ব ভূমিতে তাঁর বিচরণ , সর্ব ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপ্তি , সর্ব মানবীয় আস্বাদে ও আকুলতায় তাঁর শিল্পসত্তার বিকাশ , সর্বজনের অন্তরে তাঁর অধিকার ।
ধর্মগুরু বা জননেতা না হয়ে যদি কেউ বাঙালীর হৃদয়ে পূজা পেয়ে থাকেন তো তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ।
সেই শিশু বয়সে স্কুলে প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়ে “ সারা জীবন দিল আলো , সূর্য গ্রহ চাঁদ “ থেকে শুরু করে কৈশোরের “ একটুকু ছোঁয়া লাগে “ থেকে পরিনত বয়সে ,“ জগত জুড়ে উদার সুরে “ আনান্দের গান গেয়ে কোন ফাঁকে যে পরম সৃষ্টিকর্তার চরণে মাথা ঠেকিয়ে দিয়েছি – তা বেশ অনুভব করতে পারি ।
যে বিষয় নিয়ে এখনো প্রশ্ন উঠে আসে তা হল , সুখ হতে স্মৃতিতে , বাসনা হতে শান্তিতে , ব্যথা হতে গীতিতে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হই । বারবার অনেকবার নিজের অজান্তেও ।
জগতকে আমারা যেভাবে দেখব , জগত ঠিক সে রকম ভাবে আমাদের কাছে প্রকাশিত হবে । তাই তো রবীন্দ্রনাথের ঋষি -বানী –
“ আমারই চেতনার রঙে পান্না হল
সবুজ ,
চুনি উঠলো রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে , জ্বলে
উঠলো আলো ,
পুবে – পশ্চিমে ।
গোলাপের দিকে তাকিয়ে বললুম
সুন্দর ,
সুন্দর হল সে । “

নিয়মিত রবীন্দ্র চর্চা মনের শ্রেষ্ঠ দরজাটিকে খুলে দেবে । পান্নাকে সবুজ , গোলাপকে সুন্দর বলবে । শান্ত বা দিকভ্রান্ত সহযাত্রী কেও আপন করে নিতে শেখাবে । চেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটবে । এই ভাবেই রবীন্দ্র সাহিত্য আমাদের সুস্থ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । ‘ সুখ দুঃখ আনান্দ বেদনা ভয় বিহ্বলতা ‘র সঙ্গী । অবসরে , আনামনে । সব সময়ে ।
আজ আমরা একটা সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি । আমাদের অনেকেরই আশা ছিল , রবীন্দ্রনাথের সমৃদ্ধ , সম্ভ্রান্ত , এত শ্রদ্ধা-কাড়া ভাষায় গোটা সমাজ , সমাজের মানুষজন এবং শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হবে । অনেক কারনের মধ্যে , একটা বড় কারন আছে । তা হল আর্থিক কারন । গরীব নিরক্ষর পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের ভাবনাচিন্তার বিকাশ । নীচে তলার মানুষরা বিলেত আমেরিকা যেতে পারবে না । তাদের লেখাপড়া শিখতে হবে ।
রবীন্দ্রনাথের ভাষার সংগে তাদের পরিচয় ঘটবে না । কিন্তু এটাই শেষ কথা নয় । দূষিত একটা শিক্ষাব্যবস্থা ভাষাব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়েছে । এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে ।
রবীন্দ্রনাথের ভাষা থেকে আমারা যাদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করছি , গোটা সমাজব্যবস্থাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে , তারা একদিন প্রতিশোধ নেবে ।
রবীন্দ্রনাথের গানে কবিতায় গল্পে – সাহিত্যে আমাদের মন ভরে যায় । এই সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি , রবীন্দ্রনাথের প্রতি , তাঁর ভাষার প্রতি আমরা যে বিশ্বাসঘাতকতা করছি , সেই সংগে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের অধিকারের প্রতি যে বিশ্বাসঘাতকতা করছি , তা আমাদের মনে রাখা দরকার ।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
আত্মজ

আত্মজ

গৌতম সরকার “নবমী নিশি পোহালো……………. উমা আমার যাবে চলে…………….” নবমীর রাত্রি এক আকাশ কান্নার ঝুলবারান্দা। এই রাত্রিটা আপামর বাঙালির বুকের মধ্যে লক্ষ-কোটি পিন ফোটায়। পঙ্কজ ...
The Frightening Affect of Climate Change on Government

The Frightening Affect of Climate Change on Government

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
ছোটগল্প- চশমা

ছোটগল্প- চশমা

শুভাঞ্জন  চট্টোপাধ্যায় লেন্স খুলে পড়া চশমার ফ্রেমটা নিয়ে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে খুটুরখাটুর করার পর শেষমেশ মুখটা ব্যাজার করে ভদ্রলোক বললেন, ‘ না দাদা, এ জিনিস মিউজিয়ামে ...

বেঁচে থাকার শেষ দিন

|ফজলে রাব্বী দ্বীন   শিয়ালের বেঁচে থাকার শেষ দিন আজ ওঁৎ পেতে আছে ধূর্ত গাধা; কয়েকটি খরগোশ প্রতিনিয়ত কচ্ছপ দৌড় শিখছে,   আর শেখাচ্ছে লাঠি ...
রক্তকান্না

রক্তকান্না

সৌর শাইন অরণ্যের বুক চিরে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে সম্রাট পরিবহন! জানালার পাশে বসে নিশ্বাস নিচ্ছে সৌরুদ্র! সবুজের সাম্রাজ্য ভাওয়ালগড়, শালবৃক্ষের সমারোহ চোখে স্নিগ্ধতার ঝাপ্টা ...
বাবা

বাবা

আবু সায়েম চৌধুরী  বাবা মানে- মাথার উপর বট গাছের ছায়া, বাবা মানে- ভালোবাসার এক অদ্ভুত মায়া। বাবা মানে- বাবার কাছে হাজারো আবদার, বাবা মানে- যার ...