গল্প: যোগ বিয়োগ

গল্প: যোগ বিয়োগ

জোবায়ের রাজু 

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে ঈদগাঁ থেকে নামায শেষ করে আলম খান বাসায় এসে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। এরকম বিবর্ণ মুখ আলম খানের আগে কখনো দেখিনি। তিনি সদা হাসি খুশি মনের একজন দানশীল মানুষ। আলম খানের এই অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পারছি না আসল ঘটনা কি? তাই অনেকটা আগ্রহ নিয়ে তার পাশে বসে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম আপনার মন খারাপ?’
আমার কথা শুনতে পাননি, এমন ভঙ্গিমায় আলম খান দেয়ালে ঝুলন্ত কাবা শরীফের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তারপর যে দৃশ্যটি দেখে আমি চমকে উঠলাম, সেটি হল আলম খানের চোখ বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে অশ্রু। ঘটনা কি?

প্রায় সাত আট মিনিট পর আলম খান আমাকে ডেকে বললেন ‘আমরা এক্ষুনি আশানগর বস্তিতে যাব, রেডি হও।’ হতবাক হয়ে প্রশ্ন করি ‘আশানগর বস্তিতে কেন? সেখানে কি?’ আমার প্রশ্নকে গুরুত্ব না দিয়ে আলম খান বললেন‘রতন, এত প্রশ্ন শুনতে আমার ভালো না।’

আলম খান নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছেন। তার পাশে সিটে বসে আছি আমি। ঈদের সময় বলে আজ পথে কোন যানজট নেই। রাস্তা বেশ ফাঁকা। ফাঁকা রাস্তা বেয়ে আপন গতিতে ছুটে চলছে আলম খানের চল্লিশ লাখ টাকা দামের গাড়ি। আমাদের গন্তব্য আশানগর বস্তিতে। সেখানে আমরা কেন যাচ্ছি জানিনা।

প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার পথ অতিক্রম করে আমরা আশানগর বস্তিতে এসেছি। বস্তি বলতে সাধারণত যে সর্বহারাদের গাদাগাদি জীবন যাপন আমরা বুঝি, এই বস্তি সেরকম না। অতি ছিমছাম একটা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। লোক লোকারন্য খুব একটা নেই। তবে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আশে পাশের বেশ ক’টা বাচ্চা ছেলে ছুটে এসে বড় বড় চোখ করে আমাদেরকে দেখছে। আলম খান এখানে আমাকে নিয়ে আসলেন কেন, বুঝতে পারছি না। তিনি কি এই বস্তির জীর্ণ জায়গাটা কেনার পরিকল্পনা করছেন?

উৎসুক বাচ্ছাগুলিকে প্রশ্ন করলেন আলম খান , ‘তোমাদের মধ্যে এখানে সোনিয়া কে?’ ছয় সাত বছরের একটা ফর্সা মেয়ে ফোঁকলা দাঁত বের করে বলল,‘আমি সোনিয়া।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলম খান বললেন,‘তোমার মাকে ডেকে আনো তো!’ ময়লাচ্ছন্ন জামা পরা মেয়েটি নাচতে নাচতে বস্তির ভেতরে চলে যাবার আমি আবারো দেখলাম আলম খান ঈদে কেনা তার গায়ের পঁাচ হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবির পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে ভেজা চোখ মুছলেন। আমি ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছি না। কি হচ্ছে এসব।

কিছুক্ষণ পর সোনিয়া তার কঙ্কালসার দেহের মাকে নিয়ে আমাদের সামনে এল। সোনিয়ার মা’র শরীরের এতই অবনতি যে তিনি রীতিমত পুষ্টির অভাবে কাঁপছেন। পরনে তার ছেঁড়া তাতের শাড়ি।

তারপর হঠাৎ…। আলম খান সোনিয়ার মাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চিৎকার করে কঁাদতে লাগলেন।

বাবা তুমি এখানে এসেছো? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

না পারুল মা। আমি সত্যি এসেছি। দেখতে এসেছি আমার মা কোথায় থাকে। কি সুখে আছে।

বাবা, আমি তোমার  রাজমহল ছেড়ে চলে এসে এখানে স্বামী সন্তান নিয়ে ভালো আছি। জামিল আমাকে সুখেই রেখেছে। যদিও আমরা বস্তিতে থাকি।

না মা। তোকে আর আমি এখানে রাখব না। আমার আজ কোন ক্ষোভ নেই। জামিলের প্রতি তোর গভীর ভালোবাসার মহা সাগরে আজ আমার সকল রাগ অভিমান ডুবে গেছে। আমাকে ক্ষমা কর মা।

ক্ষমা কিসের বাবা? তোমার প্রতি তো আমার কোন রাগ নেই। জামিলকে এতই ভালোবেসেছি যে, তোমার উপর রাগ করার সময়ই পাইনি।

আলম খান পারুল নামের এই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কি ব্যাকুল হয়ে কঁাদছেন। মেয়েটি আলম খানের মেয়ে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

পারুল মা, আজ ঈদের দিনে তোকে এতই মনে পড়ল যে আমি এখানে না এসে পারলাম না।

তোমাকে তো আমার রোজ মনে পড়ে বাবা।

আমি এখন আসি মা। বিকেলে গাড়ি পাঠাব। জামিল আর সোনিয়াকে নিয়ে এখান থেকে চলে আসিস।

বাবা, আমি সেমাই রান্না করেছি খেয়ে যাও।

আশানগর বস্তি থেকে আলম খানের সাথে ফিরে এলাম তার আলিশান প্রকান্ড বাড়িতে। তিনি আমাকে তার জীবনের এক লম্বা গল্প শোনালেন এই ঈদের দিনে। খুব বেদনার গল্প।

২.
কোটিপতি আলম খানের স্ত্রী জেসমিনের অকাল মৃত্যুর পর তিনি মেয়ে পারুলকে নিয়ে বাকি জীবন কাটানোর যখন পরিকল্পনা করেছেন, তখনই তার মেয়ে পারুলের জীবনে আবির্ভাব ঘটে জামিল নামের এক দরিদ্র ঘরের ছেলের সাথে। আলম খান কোন ভাবেই জামিলকে মানতে পারছেন না। একদিন পারুল তার বাবার প্রাচুর্য ছেড়ে চলে আসে জামিলদের আশানগরে।

এই ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন আলম খান। মেয়ের প্রতি ঘৃনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। কিন্তু পিতৃত্বের বন্ধনের কাছে পরাজিত হয় আলম খানের সকল ঘৃণা আর ক্ষোভ। তাই তো এই দিনে মেয়েকে দেখতে ছুটে যান দূরের ওই ছন্নছাড়া বস্তিতে। যেখানে পারুল জামিলকে ভালোবেসে খুঁজে নিয়েছে জীবনের ঠিকানা। সংসারে তাদের একটা মেয়েও আছে সোনিয়া নামে।

আজ মেয়ের জন্য ভালোবাসার টানে আলম খান যেভাবে বস্তিতে ছুটে গেছেন, ঠিক সেভাবেই দুই বছর আগে রাস্তা থেকে আমাকে কুড়িয়ে এনেছেন।

দুই বছর আগেও আমার জীবন ছিল জলে ভাসা। মা বাবার মৃত্যুর পর আমার চাচারা যখন সমস্ত বিষয় সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিল, সেই পথ থেকে দুই বছর আগে আলম খান আমাকে তুলে এনে এখানে আশ্রয় দিয়েছেন নিজের সন্তানের মতন করে। গত দুই বছর থেকে এখানে আমি ভালো আছি। শুনেছি আলম খান আমাকে তার সম্পদের এক শতাংশ লিখে দেবার চিন্তা করছেন। কিন্তু তার এই সম্পদে আমার কোন লোভ নেই, নিঃস্ব এতিম আমি এই রাজমহলে ঠঁাই পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া।

সন্ধ্যার পর রাজমহলে ঈদের আনন্দ দ্বিগুণ বাড়ল। পারুল আশানগর বস্তি থেকে এখানে চলে এসেছে তার স্বামী সন্তান নিয়ে। অনেক বছর পর মেয়ের ফিরে আসার আনন্দে যেমন বাকরুগ্ধ আলম খান, তেমনিই তার নিষ্পাপ ওই দুটি চোখের কোনে জল টলমল করছে। সোনিয়া ফোকলা দঁাতে বলল ‘নানাজান, কান্দেন কেন? আমার আব্বায় কইছে ঈদের দিনে মানুষ কান্দে না। হাসে। আপনি কান্দেন কেন?’ পরম স্নেহে আলম খান যখন নাতনি সোনিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন, পারুল তখন শব্দ করে কেঁদে ফেলল।

 

আমিশাপাড়া, নোয়াখালী। 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
ভেসে যায় ভিতর-বাহির

ভেসে যায় ভিতর-বাহির

অনঞ্জন সে ঠিক করল বৃষ্টি দেখবে, ভিজবেনা কিছুতেই, বৃষ্টি এল, অরণ্যের মতো, দুকুল ছাপিয়ে- আজই ধুয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত পুরনো বিশ্বাস, আকাশে তখন অনন্তের সব ...
জোবায়ের রাজুর দু'টি গল্প [আজ রবিবার, পুত্র]

জোবায়ের রাজুর দু’টি গল্প [আজ রবিবার, পুত্র]

জোবায়ের রাজু রকি আমার দশ বছরের ছোট। একটাই ভাই আমার। বোন নেই। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। মেজো মামার বড় মেয়ে লামিয়ার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ...
বাংলা ভাষার তরে

বাংলা ভাষার তরে

আশিক মাহমুদ রিয়াদ একুশ এসেছে একুশ, এসেছে মিছিলে মিছিলে প্রতিবাদের প্রতিধ্বনী এসেছে পুরণো রাজপথে নতুন কুঁড়ি। গাছে গাছে ফুটেছে বাসন্তী ফুল, অথচ রাজপথ ছেঁয়ে গেছে ...
কবিতা - প্রিয়জন

কবিতা – প্রিয়জন

নির্মল ঘোষ এইতো আর কটা দিন, বর্ষা পেরিয়ে আসবে শরৎ, চারিধারে ছেয়ে যাবে সাদা রঙের কাশফুলে। আনন্দে আপ্লুত হবে গোটা দেশ। আকাশে মেঘেরা খেলা করবে বাঁধনহারা। ...
বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে; মা'কে নিয়ে যে গানগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়!

বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে; মা’কে নিয়ে যে গানগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়!

আশিক মাহমুদ রিয়াদ আজ মা দিবস। মা-ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এই শব্দের পরিধি কিংবা বিস্তৃতি কি বিশাল। সৃষ্টি শুরু থেকে এই শব্দটি শুধু মধুর নয়,ভালোবাসার,আবাগের,ক্ষমতার ...

কবিতা-“শিক্ষক”

আরিফুল ইসলাম আকাশ     অ, আ, ক, খ, গ বর্ণমালার বাণী,  যিনি দিলো মোর একালো মস্তিষ্কে ঢালি। তারা ঝড়, তুফানে ছোটে ছাড়িয়া ঘর,  তারাই ...