মনির চৌধুরী
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে আনন্দে লাফিয়ে উঠে রাজু। চিৎকার করে বলে ওঠে, আম্মু আজকে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক আসাদ স্যার বলেছেন, আগামীকাল একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই জন্য তোমাদের স্কুল ছুটি থাকবে। তোমরা সবাই আগামীকাল খুব ভোরে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাবে। স্যারের কথা মত আমি কিন্তু এবার দাদুর সাথে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাব। তুমি একটু পরে আব্বুকে ফোন করে জানিয়ে দিও, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাজার থেকে কিছু ফুল কিনে আনতে। এই সব কথা বলে রাজু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সেদিন তার রুমে চলে যায়।
রাজু বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান। এই জন্য রাজুর কোন অভাব অনাটন বিন্দুমাত্র আঁচ লাগতে দেন না, তার বাবা-মা। সে যখন যা চেয়ে বসে সাথে সাথে তার বাবা বাজারে থেকে কিনে এনে দেন। এই জন্য সেদিন রাজুর মা কোন দ্বিধাবোধ না করে, সাথে সাথে রাজুর আব্বুর কাছে ফোন করে জানিয়ে দেন একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার দিবসের জন্য কিছু ফুল কিনে আনতে।
একমাত্র আদরের সন্তানের বাইনা মেটাতে রাজুর আব্বু সন্ধ্যার দিকে বেশ কিছু ফুল কিনে আনেন। তারপর রাজুর রুমে গিয়ে রাজুর কাছে ফুলগুলো দিয়ে আসেন। রাজু ফুল পেয়ে আনন্দে নেচে উঠে। সে খুব খুশি হয়। রাতের দিকে তার মায়ের কাছে ফুলগুলো সুন্দর করে মালা বানিয়ে নেয় এবং মালাগুলো পড়ার টেবিলে রেখে সে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। নিস্তব্ধ নিশি রাত যখন অবসান প্রায়; পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে পরের দিন সকালে রাজুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে জেগে উঠে রাজু তাড়াহুড়ো করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ফুলের মালা হাতে নিয়ে দাদুর সাথে শহীদ মিনারে দিকে রওনা হয়। দাদুর সাথে শহীদ মিনারে যাওয়ার সময় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে, সেদিন রাজুর অনেক চিন্তা-ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়। মনের মাঝে নানান রকমের কৌতুহল সৃষ্টি হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কি? কেনে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাচ্ছি, এই সব বিষয় সম্পর্কে রাজুর জানার খুব আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এই জন্য রাজু তখন শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়ার সময় তার দাদুকে প্রশ্ন করে, ‘দাদু, মাতৃভাষা কাকে বলে? আর এই মাতৃভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা আমাদের দেশে কি হয়েছিল? আর আমরা কেনোই বা শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাচ্ছি?’
রাজুর দাদু তখন রাজুকে বলে, ‘দাদু ভাই, মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। মায়ের কোলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই একটি শিশু হাত-পা নাড়িয়ে হাসি-কান্নায় তাদের অব্যক্ত ভাষা প্রকাশ করে। আস্তে আস্তে যখন সে বড় হতে থাকে, তখন সে বিভিন্ন রকমের শব্দ খোঁজে। আর এই শব্দ খোঁজার পিছনে বড় ভূমিকা পালন করে তার মা। মমতাময়ী মা তার শিশু সন্তানটি পরম আদরের হাটি হাটি ছলনায় মুখের মিষ্টি ভাষা শিখিয়ে থাকে। আর এই হাটি হাটি ছলে মায়ের শেখানো মুখের ভাষাকেই মাতৃভাষা বলে।
যে মাতৃভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা আমাদের দেশে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৫২ সালে এই দিনে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার বাংলা মায়ের মুখের মিষ্টি ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। নিরীহ বাঙালি জাতির উপর অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকার প্রথমে আঘাত হেনেছিল আমাদের মাতৃভাষার ওপর। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রক্ষা করার জন্য সেদিন আন্দোলন নেমেছিল সকল শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ। রাজপথ ঘেরাও করেছিল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা।সেদিন তারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ভাষা আন্দোলনে ছোট ছোট দলে মিছিল নিয়ে ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। আপামর ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ মিছিল থামানোর জন্য সেদিন পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের ওপর লাঠিচার্য করেছিল। এমনকি ছাত্রীরাও পুলিশের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। পুলিশ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসরমাণ মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। আর সেদিন পুলিশের গুলিতে অনেকেই শহীদ হয়েছিল। বহু ভাষা শহীদদের লাশ গুম করে ফেলার কারণে সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে যারা শহীদ হয়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। তারা হল:– রফিক, শফিক, সালাম, বরকত ও জব্বার।
মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আমাদের দেশে যত মানুষ শহীদ হয়েছে, আজ পর্যন্ত কোন দেশে এত মানুষ মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়নি। এমন কি কোন দেশে বিন্দুমাত্র দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়নি। সারা বিশ্বের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল। সেদিন থেকে বিশ্বের সব দেশ একুশে ফেব্রুয়ারির দিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
এই জন্য আমাদের উচিত সদা সর্বদা মাতৃভাষাকে সম্মান করা। মনেপ্রাণে ভালোবাসা। কখনো অবহেলা না করা। আমাদের এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যাতে বাংলাভাষার অসম্মানিত হয় কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা সবসময় চেষ্টা করব সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহার করা এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বেশি বেশি সাহিত্য চর্চা করা। এখন তুমি কি আমার কথাগুলো বোঝতে পেরেছো দাদুভাই, আমরা কেনো আজকে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যাচ্ছি? তখন রাজু মুচকি হেসে বলছে, ‘তোমার কথাগুলো আমি বুঝতে পেরেছি দাদু, আমরা কেন শহীদ মিনারে যাচ্ছি, আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে ঠিকিয়ে রাখতে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাচ্ছি।’
দামুড়হুদা, চুয়াডাঙ্গা