রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালী মুসলমান সমাজ  [পর্ব – ৩ ]

রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালী মুসলমান সমাজ  [পর্ব – ৩ ]

|মিরাজুল  হক  

 

পর্ব – ৩ : 

 

  • ( বাঙালী মুসলমানের ধর্মচিন্তা ও রবীন্দ্রনাথ

বেশির ভাগ বাঙালী মুসলমান ধর্মপ্রাণ । ইসলাম বিশ্বাসী । মৈত্রী ও শান্তি সাধনাই – ইসলাম । একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম বিশ্বাস । ‘ আল্লাহ ‘র একত্ববাদ  ( তৌহিদ ) ।  তা কেবল তসবি , নামাজ ও আলখাল্লার ধর্ম নয় । পবিত্র কুরআনের বিষয়বস্তু মানুষ । জীবন ব্যবস্থার দর্শন । কুরআনে পৃথিবীর ও আকাশ রাজ্যের গঠন , বিশ্ব প্রকৃতির নিদর্শন সমূহের গভীর পর্যবেক্ষণ । নৈতিক চরিত্র ও কর্মধারার দার্শনিক বিষয় ।  

 

আমরা মানুষ । মানুষই চাই  অনন্ত সুখ । একই সংগে  থাকে  অনন্ত দুঃখ , অনন্ত রূপ । আমাদের জীবন  আশা স্বপ্ন কষ্ট যন্ত্রণা বেদনায় বিহ্বলতার শূন্যতা ।  রবীন্দ্র সাহিত্যের এই অনুভূতির প্রভাব বাঙালী মুসলমানরা বুঝুক আর না-বুঝুক ,  রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই মানব মনের পরম বন্ধু । 

 

রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস ছিল । “  যদিও সে বিশ্বাস কোনও বিশেষ ধর্মের সীমাবদ্ধতা থেকে এত মুক্ত ছিল , যা সচরাচর দেখা যায় না । “   ( তর্কপ্রিয় ভারতীয় – অমর্ত্য সেন , পৃষ্ঠা – ৯৪ ) ।  মানবপ্রীতি , ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ । জগত , বিশ্বপ্রকৃতি , চন্দ্র সূর্য – ঈশ্বরের যে সম্পদ , তার প্রতিফলন রবীন্দ্র সাহিত্যের  নানান শাখা প্রশাখা জুড়ে । এবং তা  গভীর বিচার বিশ্লেস্ণের বিষয় । গবেষণার প্রেক্ষাপট ।  

 

“ আমরা তোমারই এবাদত ( উপাসনা ) করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা  করি । আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন কর  ( কোরআন –  সুরা আল-ফাতিহা ) । আকাশ ও পৃথিবীর প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহরই  । তিনি ছাড়া তোমাদের বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই  ( সুরা – ২ বাকারা , রুকু – ১৩ আয়ত – ১০৭  ) “ ।

 

একেশ্বরবাদী  বিশ্বাস   রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ছুঁয়ে ছিল । ইরানি কবি হাফিজের গজল  মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নিত্য সঙ্গী ।   পরম করুণাময়ী সৃষ্টিকর্তার প্রতি রবীন্দ্রনাথের তাই কাকুতি – মিনতি —  

  

“ আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার 

          চরণ ধূলার তলে ।

সকল অহংকার হে আমার 

        ডুবাও চোখের জলে । …… 

……  আমারে না যেন করি প্রচার 

         আমার আপন কাজে 

তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ 

       আমার জীবন মাঝে । “ 

 

“ আল্লাহই তোমাদের জন্যে মাটির শয্যা বিছিয়ে দিয়েছেন , আকাশের ছাদ তৈরি করেছেন , বৃষ্টিপাত করিয়েছেন এবং তার সাহায্যে নানাপ্রকার ফল উৎপন্ন করে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন । অতএব তোমরা যখন এ সব কথা জান , তখন অন্য কাউকে আল্লাহ র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে স্বীকার কর না । ( কোরআন – সুরা – ২ রুকু -৩ আয়ত – ২২  ) । “ 

 

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি এবং দার্শনিক । প্রকৃতি ও মানব মনের সংসারে ,  যা কিছু দেখা যাচ্ছে  , তাতে , কবি ঈশ্বরের রূপ প্রত্যক্ষ করলেন ।   তাই তিনি আমাদের জানালেন – 

 

“ সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ 

তোমার আশীর্বাদ , হে  প্রভু , তোমার আশীর্বাদ । 

মেঘের কলস ভরে ভরে  প্রসাদবারি পড়ে ঝরে …… 

ফুল যে আসে দিনে দিনে ,   বিনা রেখার পথটি চিনে 

এই যে ভুবন দিকে দিকে পুরায়  কত সাধ –

তোমার আশীর্বাদ , হে প্রভু , তোমার আশীর্বাদ । “ 

 

‘ কৃপণ ‘ কবিতা । এক ভিখারি গ্রামের পথে পথে ভিক্ষা করে ফিরছিল । সেই সময়ে মহারাজ যাচ্ছিলেন স্বর্ণরথে চড়ে । সহসা রথ থেমে গেল , 

  “ আমায় কিছু দাও গো বলে 

         বাড়িয়ে দিল হাত ।“ 

 

ভিখারি বড় নিরাশ হল , বড় লজ্জিতও । ঝুলি থেকে একটি ছোট কনা তুলে দিল । ঘরে ফিরে এসে সে দেখল , তার ঝুলির সাথে একটি সোনার কনা রয়েছে । তখন ভিখারির আক্ষেপ – 

 

  “ দিলেম যা রাজ ভিখারিরে

            স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে 

     এখন কাঁদি চোখের জলে 

           দুটি নয়ন ভরে – 

তোমায় কেন দেইনি  আমার 

          সকল শূন্য করে । “ 

 

ভিখারি মানুষ । পরম কৃপণ । তোমার অনেককিছু আছে । মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিতে হয় । তাই পবিত্র কোরআনে আছে , “ কে আছে আল্লাহ কে উত্তম দান দেবে , তা তিনি বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন ( সুরা -২ , আয়াত – ২৪৫ ) । 

 

সাহিত্য তো  আসমানি ফসল  নয় । জীবনযাপনের  প্রতিফলন । অন্তরের উপলব্ধি । চরম ভাববাদে রবীন্দ্রনাথ ,  — “ আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ / চুনি উঠল রাঙা হয়ে …… “   

 

রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-প্রকৃতির বিচিত্র তে , নিসর্গ সৌন্দর্যে , মানব সম্পর্কে এক সীমাহীনতা রক্ষা করেছেন । এক অনন্ত পরম রহস্যময়ের প্রকাশ । অসীম অনুভূতির অভিব্যক্তি । 

 

      “ সীমার মাঝে অসীম তুমি 

               বাজাও আপন সুর 

         আমার মাঝে তোমার প্রকাশ 

                 তাই এত মধুর । “ 

       

  রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়কর প্রতিভা । বহুমাত্রিক কর্মময় তাঁর জীবন । তিনি ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য থাকাকালীন পবিত্র  কোরআন প্রথম  বাংলা ভাষায় অনুদিত হয় । অনুবাদক শ্রী গিরিশ সেন । ভাষাতত্ত্ববিদ মহম্মদ শহীদুল্লাহর ধারনা , ‘ তিনি এর মগজটা রেখে বাকিটা সরিয়ে রেখেছেন । তাঁর কাব্যে কুরআনের বানীর উপস্থিতি অনুবভ করেছেন । ‘   

 

আগের পর্ব সমুহ

রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালী মুসলমান সমাজ পর্ব-০১

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
জোড়া কবিতা- লুনা রাহনুমা

জোড়া কবিতা- লুনা রাহনুমা

লুনা রাহনুমা   হৃদয় ঢেকে রেখেছিলাম কুসুমে কোমলে বাজার থেকে কিনে আনা দামি সুগন্ধে, গোলাপে আতরে জরির ওড়নায় লোকচক্ষুর অন্তরালে – আমার মগজের পচে যাওয়া ...
কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ঈদের কবিতা (আবৃত্তি)

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ঈদের কবিতা (আবৃত্তি)

ঈদ মোবারক- কাজী নজরুল ইসলাম (আবৃত্তি-মহীতোষ গায়েন) কত বালু চরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো, বরষের পরে আসিল ঈদ! ভূখারীর দ্বারে সওগাত বয়ে রিজওয়ানের, কন্টক-বনে আশ্বাস ...
ফ্রগমাউথকে পত্রী

ফ্রগমাউথকে পত্রী

গোলাম রববানী    প্রিয় ফ্রগমাউথ , সুপ্রিয় প্রিয় পাখি আমার্‌ আজকাল তোমাকে আর খুঁজে পাই না মাত্র । সবুজ বৃক্ষের সতেজ পাতার রক্তাক্ত ক্ষতে । ...
অনুভব- অমিতা মজুমদার

অনুভব- অমিতা মজুমদার

 অমিতা মজুমদার আজকাল নিজেকে আমার মায়ের প্রতিবিম্ব মনে হয়, বলতে গেলে সব মেয়েকেই তাই মনে হয়। একটু একটু বড় হয়েছি আর মায়ের কাছ থেকে, আস্তে ...
এক মাছলি, পানি মে গায়েই? অর্থ কি? কিভাবে খেলে?

এক মাছলি, পানি মে গায়েই? অর্থ কি? কিভাবে খেলে?

এক মাছলি, পানি মে গায়েই? অর্থ কি? কিভাবে খেলে?   ভাইরে ভাই! বন্ধুবান্ধব একসাথে বসে আড্ডা দেওয়ার মজা আর কিছুতে নেই। সেই সাথে বসে যদি ...
আবেদন

আবেদন

 জাহেদ আহমদ     (এক). আমি শত সহস্র রাতের উপোস হতে রাজি আছি কবি__শুধুমাত্র একটি কবিতার জন্য মোলায়েম শব্দের শীতল স্পর্শে হৃদ দ্বিখণ্ডিত হয় হউক ...