গৌতম সরকার
মোবাইল অনেকক্ষণ থেকে জানান দিচ্ছে একের পর এক মেসেজ ঢুকছে। দুবার ফোনও এসেছিল। বাড়িতে বসে কোজাগরী খুব চিন্তা করছে। এই মুহূর্তে অথর্বেরও কিছু করার নেই। তবুও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে চটপট লিখে দিল, আয়াম ওকে, ডোন্ট ওয়ারি। মোবাইলটা যথাস্থানে রাখতেই একটা ঠকঠক আওয়াজ কানে এল। প্রথমে উৎসটা বুঝতে না পারলেও পরে বুঝল শব্দটা বাড়ির মধ্যে থেকেই আসছে। কিছুক্ষণ পর কাঠের খড়ম পায়ে দিয়ে এক মহিলা ছাদে উঠে এলেন। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে, চুলের জটা কোমর ছাড়িয়ে নেমে এসেছে, পরনে রঙিন শাড়ি, কিন্তু হাতে একটা রক্তলাল ভিজে শাড়ি। শাড়ি শুকোতে দিয়ে, জটা চুলগুলো ছড়িয়ে মহিলা রোদ পিঠে করে আলসের পাশে দাঁড়ালেন। ছাদটা খুব জোর পঁচিশ ফুট দূরে হবে, অথর্ব ভদ্রমহিলাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, যদিও এখন অথর্বর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন। অথর্ব আশপাশ নজর রাখতে লাগল, কিছু পর আবার সিঁড়িতে আওয়াজ হল। এবার আর খট খট নয়, জুতোর মসমস আওয়াজ তুলে যিনি ছাদে উঠে এলেন তাকে দেখে অথর্ব ভীষণ চমকে উঠল। সন্দেহ একটা ছিলই, কিন্তু তার নিরসন যে এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি। তার থেকে পঁচিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছেন হাটের সেই ভদ্রলোক, না না জঙ্গলবাড়ির সেই ভদ্রলোক। চোখের কালো চশমা, টুপি, আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি খুলে ফেলে একদম জঙ্গলবাড়ির ভদ্রলোক হয়ে গেছেন। অথর্বর দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। ও বুঝল এবাড়িতে নিশ্চয়ই গোপনে কোনো অন্যায় কাজ হচ্ছে। আর সেই জন্যই এই জঙ্গল শহরে তারা বারবার বাসা বদলাচ্ছে। ওই জঙ্গলবাড়িটা অথর্ব আবিষ্কার করে ফেলাতেই কি ওরা আস্তানা বদলেছে! কিন্তু ওখানে তো এই ভদ্রমহিলাকে দেখেনি! তাহলে? হতে পারে এই শিমুলতলায় ওদের একাধিক আস্তানা আছে। অথর্ব দেখল দুজনের মধ্যে কিছু শলাপরামর্শ চলছে। কিন্তু এত আস্তে কথা বলছে, অথর্বর কানে কিছু এসে পৌঁছচ্ছে না। তাছাড়া ভদ্রলোক আসতে অথর্ব আরেকটু ঘন ডালপালার মধ্যে ঢুকে এসেছে। কিছুক্ষন কথা বলে ভদ্রলোক নিচে নেমে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কাউকে হাঁক দিয়ে ডাকলেন। তার মানে বাড়িতে আরও মানুষ আছে। একতলায় নেমে ভদ্রলোক কাউকে কিছু একটা বললেন, কিন্তু কি বললেন সেটা এত দূর থেকে বোঝা গেল না। অথর্বর এবার ভয় ভয় করতে লাগল। এই পোড়ো বাড়িটাকে ঘিরে একটা রহস্য ঘন হয়ে উঠছে, এখন এদের দৃষ্টি এড়িয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়াটাও একটা ভয়ানক ঝুঁকির কাজ বলে মনে হচ্ছে। তার হাতপা কি একটু কাঁপছে? মনে মনে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করল অথর্ব। একটা রহস্যের মধ্যে সে ঢুকে গেছে, নিজের বোকামিতে ব্যাপারটা ভেস্তে যাক সে চায়না। এইসব ভাবনার মধ্যেই বাইরের দরজাটা খুলে গেল। এখানেও একটা দশাসই চেহারার লোক বেরিয়ে এল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। একহাতে একটা লাঠি, অন্যহাতে একটা টিফিন কৌটো। লোকটা বাইরে বেরিয়ে সতর্ক চোখে চারপাশ দেখে নিল, তারপর বাড়িটার পিছনের দিকে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। অথর্ব প্রচন্ড কৌতূহল বোধ করল। লোকটা টিফিন বক্স নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় গেল! ও চটপট ভেবে নিল, এখনও পর্যন্ত ও বাড়িটায় তিনজন মানুষ দেখেছে। দুজন বয়স্ক আর যে লোকটা খাবার নিয়ে গেল। আর যদি কেউ না থাকে বুড়োবুড়ির জঙ্গলের দিকে নজর করে বসে থাকার সম্ভাবনা কম। ও তরতর করে গাছ থেকে নেমে এল, আশপাশ তাকিয়ে একটু রিস্ক নিয়েই বাড়িটার পাশ দিয়ে দৌড়ে পিছনের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। বেশিক্ষণ যেতে হলনা, আন্দাজ একশো মিটার গিয়েই বুঝল জঙ্গলের মধ্যে আরেকটা ঘর আছে। তবে এটা বেশ ভেঙে পড়েছে, মাথায় খাপড়ার চাল। অথর্ব গাছপালার মধ্যে দিয়ে নজর চালিয়ে দেখল, লোকটা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। অথর্বের কৌতূহল বাধা মানলোনা, ও আগাপাশ চিন্তা না করে চট করে গাছের আড়াল দিয়ে ঘরটার পিছনে পৌঁছে গেল। তবে হতাশ হতে হল, পিছনে একটা জানলা থাকলেও সেটা বন্ধ। সে বন্ধ জানলায় গিয়ে কান পাতল। প্রথমে কিছু শুনতে পেলোনা। একটু পরে লোকটার গলা কানে এল, “এই খাবার রেখে গেলাম, খেয়ে নে।” হঠাৎ একটা মেয়ের ক্ষীণ গলা কানে এলো, “আমরা খাবো না, আমাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে এস।” সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটা মেয়ের কান্নার গলা, “প্লিজ আঙ্কল, আমাদের বাড়ি যেতে দাও। আমরা তোমাদের কি করেছি।” লোকটা এক ধমক লাগাল, “চুপ! একদম চুপ! কেউ একটা কথা বলবিনা, এরপর গলার আওয়াজ পেলে এই লাঠি তোদের পিঠে ভাঙব।” এই বলে বাইরে থেকে আওয়াজ করে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল। পিছন থেকেও অথর্ব স্পষ্ট শুনতে পেল, লোকটা যেতে যেতে বলছে, ‘খাবেনা! দেখবো কতদিন না খেয়ে থাকিস।” পিছনের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অথর্ব থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে বুঝতে পারল, এরা মেয়েগুলোকে এখানে আটকে রেখেছে। কি ভয়ানক! এরাই কি দেওঘরের সেই স্কুল পালানো মেয়েগুলো! অথর্ব আর কিছু ভাবতে পারলোনা। একটা কথাই মনে হল, এক্ষুনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু একটা করতে হবে। আবার যদি পাখি উড়ে যায়, তাহলে আর কি সে পাখিকে জালে বন্দি করা যাবে! তাকে কিছু একটা করতেই হবে, কিন্তু তার আগে ঠান্ডা মাথায় এই জঙ্গল ছেড়ে বেরোতে হবে। সে বুঝে গেছে, এই জঙ্গলে পদে পদে বিপদ ওত পেতে বসে আসে। অথর্ব সন্তর্পণে ফেরার পথ ধরল।
জঙ্গলে পথ হারানো খুব সহজ, দিক ঠিক রাখা যায়না। সে আস্তে আস্তে ফিরে বাড়িটা থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাড়িটার দিকে এল। যে গাছটায় চড়ে বসেছিল সেটাকে খেয়াল করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা যাওয়ার পর তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল, দেখতে পেল উল্টো দিক থেকে জঙ্গল ভেঙে এগিয়ে আসছে মেলার সেই সাধুবাবা। দুজনের দূরত্ব খুব জোর হলে পঞ্চাশ মিটার। কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলোনা অথর্ব, প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে। তার মধ্যেও বুঝতে পারলো এই অ্যাডভেঞ্চারেও তীরে এসে তরী ডুবতে চলেছে। সাধুবাবা এর মধ্যে আরও এগিয়ে এসেছে, একটাই মঙ্গল সাধুবাবা নিজের মনে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। শেষ মুহূর্তে উবু হয়ে বসে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে সটান মাটিতে শুয়ে চোখ বুজল অথর্ব। প্রায় দুমিনিট পর চোখ খুলল, স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিল। চারদিকে সতর্ক চোখে দেখে নিল, কেউ কোথাও নেই। এবার উঠে কোনো দিকে না তাকিয়ে জঙ্গল ভেঙে দৌড় লাগাল।
অন্ধকার অমাবস্যার রাত্রি। তার উপর আকাশে ঘন মেঘ। রাত নটা বেজে গেছে। শিমুলতলার পশ্চিম দিকের জঙ্গলটা ঘিরে ফেলেছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। ইতিমধ্যে দেওঘর এবং জসিডি থেকে বড় বড় অফিসার তাদের ফোর্স নিয়ে এসে পড়েছেন। গোটা ব্যাপারটা ঘটেছে সন্ধ্যে ঘনাবার পর। যাতে করে শত্রু শিবিরে কোনোভাবেই এই প্রস্তুতির খবর না পৌঁছতে পারে। বেশ কয়েকবছর ধরে একটা আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্র বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ জুড়ে কাজ করে চলেছে। পুলিশ বিশ্বাস করে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মদত ছাড়া এরা এখানে তারা কোনোভাবেই ব্যবসা করতে পারতো না। বহুদিন ধরে অদ্ভুত দক্ষতায় বারংবার পুলিশের জাল কেটে বেরিয়ে গেছে। এবারে জেলার এসপি সাহেব, তিনটে থানার অফিসার এবং পুলিশবাহিনী দলটিকে হাতেনাতে ধরতে বদ্ধপরিকর। জঙ্গলের চারদিক থেকে চারটে দল ঢুকছে বাড়িটার উদ্দেশ্যে। একটা দলে পুলিশ কর্মীদের সাথে আছে অথর্ব, কোজাগরী, সঞ্জু আর সবিতা। সবিতাকে সঞ্জু আনতে চাইছিল না, কিন্তু সে তর্ক জুড়েছিল প্রথম থেকে যেহেতু সেও এই অভিযানটার সাথে যুক্ত আছে, তাই শেষ অঙ্কে বাদ পড়তে রাজি নয় । অন্ধকারে চলতে খুব অসুবিধা হচ্ছে, পুলিশ টর্চ ব্যবহার করছেইনা বলা চলে। অপারেশনে সমস্ত রকমের সতর্কতা অবলম্বন করে প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। মিনিট কুড়ি চলার পর চোখের সামনে একদলা অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠল। বুঝল তারা বাড়িটার সামনে পৌঁছে গেছে। অন্য তিনটে দলও এসে উপস্থিত হয়েছে। কারণ পূব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চার দিক থেকেই অন্ধকারে একই পাখির আওয়াজ ভেসে এল। এবার পুরো একটা মানবশৃঙ্খল প্যাটার্নে পুলিশেরা বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল। অথর্ব সামনে দাঁড়ানো এক অফিসারকে মনে করিয়ে দিল পিছনের জঙ্গলে একটা ঘরে বাচ্ছা মেয়েগুলিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। পুলিশ ওকে আশ্বাস দিল, ওখানে একদল পুলিশ আগেই চলে গেছে। এবার তারা আরেকবার সংকেত দিল, আর একসাথে কয়েকশো আলো জ্বলে উঠে সবাইকার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। বেশ কিছুটা সময় লাগল চোখ সইয়ে নিতে। তারপর তাকিয়ে দেখল তাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রাচীন, পোড়ো, নিষ্প্রাণ বাড়ি, কোনো জানলা বা দরজা থেকে এককনা আলোও বেরিয়ে আসছে না। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। মনে হচ্ছে সপ্রাণ জগৎ থেকে বহু কোটি আলোকবর্ষ দূরে অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাগৈতিহাসিক বাড়িটা।
আলো জ্বলতেই এসপি সাহেব চিৎকার করে ফোর্সকে নির্দেশ দিলেন বাড়িটা রেইড করতে। দুজন অফিসার চারটে বাচ্চাকে অনেক পিছনে দুটো মোটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। কারণ এনকাউন্টার শুরু হলে গোলাগুলি চলবে। একটা হইচই শুরু হল, তারপরেই জনা কুড়ি পুলিশ অস্ত্র উঁচিয়ে বাড়িটার ভেতর ঢুকে গেল। অথর্ব ভাবতে লাগল, ওই বয়স্কা মহিলা, বৃদ্ধ ভদ্রলোক, সাধুবাবাজি আর সকালের দেখা ওই লোকটা ছাড়া আর কতজন বাড়িটার মধ্যে থাকতে পারে! আন্তর্জাতিক চক্র মানে কতটা ভয়ানক! ওদের কাছে কি অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র আছে! সেগুলো ব্যবহার করলে তো অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। সে দিদি, সঞ্জু আর সবিতাকে ঠেলে আরও পিছনে নিয়ে এল। মনে মনে ঠিক করল, গোলাগুলি শুরু হলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে এই জায়গা ছেড়ে চলে যাবে। মা-বাবা ব্যাপারটার বিন্দুবিসর্গ জানেনা। বোকার মত কোনো কাজ করে ফেলা চলবেনা।
পুলিশেরা ভিতরে ঢোকার মিনিট পাঁচেক পরেই একটা চেঁচামেচি শুরু হল, সবাই মিলে হাঁকডাক শুরু করল। কি হল বুঝবার জন্যে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই অথর্ব দেখতে পেল এসপি সাহেব তাদের দিকেই আসছেন। কিছুটা এগিয়ে এসে অথর্বকে দেখতে পেয়েই হাত নেড়ে ডাকলেন। অথর্ব দৌড়ে গেল। পুলিশ অফিসার বললেন, “বাড়িতে তো কেউ নেই। তুমি সকালবেলায় কজনকে দেখেছিলে?” অথর্ব থমকে যায়, তার মানে আবার পালালো! মুখে বলল, “সকালে তো তিনজনকে দেখেছি। একজন বয়স্কা মহিলা, মেলায় দেখা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ভদ্রলোক, আর আরেকজন লোক যে মেয়েগুলোর খাবার নিয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে মেলার সাধুবাবার সাথে দেখা হয়েছিল, যদিও তাকে এবাড়িতে ঢুকতে দেখিনি।” এরমধ্যে আরেকজন পুলিশ এসে খবর দিল, মেয়েগুলোও ওই ঘরে নেই। তার মানে আবার খবর পেয়ে দলবল সমেত পালিয়েছে। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? দুপুরবেলা ফিরে অথর্বরা থানায় গিয়ে জানাতে ওসি মন দিয়ে সবটা শুনেই আশপাশের সমস্ত থানা, আর রেলওয়ে স্টেশনগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছিল যাতে এলাকা থেকে একটা মাছিও গলে বেরোতে না পারে। অথর্বর কথা শুনে এসপি সাহেব কি যেন একটু ভাবলেন, তারপর আবার পিছন ফিরে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা চারজনও পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। এখন বাড়িটা থেকে অনেক পুলিশ বেরিয়ে আসছে, অনেকে আবার ঢুকছে। বাড়িটার একতলা, দোতলা, ছাদে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বড়বড় আলো হাতে ভিতরে ঢুকে বাড়ির প্রতিটা ইঞ্চি সার্চ করা হচ্ছে। অথর্বরাও ঢুকে একতলা, দোতলা ঘুরে এলো, সত্যিই কোথাও কেউ নেই। তবে এ বাড়িতে লোকজন ছিল তার চিহ্ন চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। কিছু কিছু পুলিশ দেওয়ালে হাতুড়ি ঠুকে দেখছে কোনো চেম্বার আছে কিনা, ছাদের চতুর্দিক দেখে এসে তারা বুঝতে পারল বাড়িতে কেউ নেই, পাখি পালিয়ে গেছে। এরই মধ্যে ওয়ারলেসে সমস্ত থানা আর রেলস্টেশনকে এখানকার খবর জানিয়ে এলাকায়, বিশেষ করে বড় রাস্তা আর রেলস্টেশনগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসপি সাহেবের নির্দেশে এখান থেকে পুলিশ বাহিনী ফিরে গিয়ে বিভিন্ন পোস্টে পজিশন নিয়ে নিয়েছে। পুলিশ অফিসারদের ছটফটানি দেখে মনে হচ্ছে, বারবার নাগালের মধ্যে এসেও এভাবে পুলিশ-প্রশাসনকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে যাওয়া কিছুতেই তারা মানতে পারছেনা, সেটা তাদের মুখচোখের কঠিন দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে।
কিছুক্ষণ পর একজন অফিসার এসে বললেন, “সবাই বাইরে চলুন। এবার ফোর্স ফিরে যাবে। বাড়িটাকে সিল করে দেওয়া হবে।” তারপর অথর্বের দিকে চোখ পড়াতে বললেন, “তোমরাও চল। আমাদের গাড়ি তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে।” অগত্যা কি করা! বিষণ্ণ মুখ আর তেঁতো মেজাজ নিয়ে সবাই উঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে ধুপ করে আওয়াজ শুনে অথর্ব পিছন ফিরে দেখে সবিতা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। কিসে হোঁচট খেল দেখতে গিয়ে দেখে সবিতা বসেই আছে, মাথাটা নিচু। ঘর থেকে পুলিশেরা বেরিয়ে গেছে, ওরা তিনজনই দাঁড়িয়ে গেছে। সবিতা ওদের দিকে না তাকিয়ে হাত নেড়ে ডাকল। ওরা এগিয়ে গেল। সবিতা মেঝেতে কি একটা ধরে টানাটানি করছে। কি করছে দেখতে গিয়ে সবাই ঝুঁকে পড়ল। সবিতা বলছে, “দেখো দাদাভাই, এখানে সুতোর মতো কি একটা বেরিয়ে আছে। এতেই আমি হোঁচট খেলাম!” সুতোতে কেউ হোঁচট খেতে পারে না। অথর্ব সবিতার পাশে বসে পড়ল, দেখল সত্যিই মেঝেতে সূতোর মত কতকগুলো আঁশ পড়ে আছে। হাত ধরে টানতে বুঝতে পারল, ওগুলো মেঝেতে আটকে আছে। সেটা কি করে হয়! যতই আটকে থাক, তাহলে তো উঠে আসার কথা। যদিনা! যদিনার কথা ভাবতেই, ও সুতো গুলো আরও জোরে টানল, তারপর মেঝেতে হাতটা ঘষতেই বুঝতে পারলো এখানে ফ্লোর সমতল নয়। হালকা হলেও বোঝা যাচ্ছে, এখানকার টাইলসগুলো ঘরের অন্যগুলোর তুলনায় একটু আলাদা। ও দৌড়ে গিয়ে একজন পুলিশ কাকুকে ডেকে এনে দেখালো। তারপর যা হল, সেটা ডিটেকটিভ গল্পকেও হার মানায়।
অথর্বের সন্দেহই সত্যি প্রমাণিত হল। চারটে টাইলস নিয়ে একটা প্যানেল তৈরি হয়েছে সেটা সূক্ষ্ম চোখেও বোঝা সম্ভব নয়। সবিতা পাতলা চটি পরে এসেছে বলে হোঁচট খেয়েছে, জুতো পরে এলে এটা ঘটত না। টালিগুলো ভালো করে লক্ষ্য করতেই বোঝা গেল, এই জায়গায় টালিগুলো ঠিকঠাক বসেনি। অপারেশনের সময় পুলিশদের কাছে সমস্ত অস্ত্র মজুত থাকে। কাটার নিয়ে টালি কাটা হল, দেখা গেল ভিতরে একটা প্রকোষ্ঠ যার মধ্যে দিয়ে একজন মানুষ গলে যেতে পারে। গর্তের ভিতরে সিঁড়ি নেমে গেছে। চারজন পুলিশ সেই অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পাতালে হারিয়ে গেল। অথর্বের প্রচন্ড ইচ্ছে করছিল সেও পুলিশকাকুদের সাথে নিচে নামে।
আরে এখনই তো অ্যাডভেঞ্চারের ক্লাইম্যাক্স! এই সময় ঘটনার কেন্দ্রে থাকতে না পারলে আর কখন থাকবে! এনকাউন্টারের ভয়ে ওদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অথর্ব দৌড়ে গেল এসপি সাহেবের কাছে। হাত নেড়ে অনেক কিছু বোঝাল। এসপি সাহেব প্রথমে ঘাড় নেড়ে আপত্তি জানালেন। অথর্ব হাল ছাড়লোনা, অনেক অনুরোধের পর এসপি সাহেব নিমরাজি হয়ে দুজন আর্মড ফোর্সকে সামনে রেখে নিজে ওদের নিয়ে সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন। পনের-কুড়ি ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নামার পর একটা সরু গলি পেল। গলিটা এঁকেবেঁকে কিছুটা এগোতেই ওরা আসল নাটকের মহল্লায় প্রবেশ করল। পুলিশ ইতিমধ্যেই দুষ্কৃতীদের চেপে ধরেছে। অথর্ব বুঝতে পারল, ওরা যে ঘরে এখন দাঁড়িয়ে আছে সেটা মাটির নিচে। বেশ প্রশস্ত ঘর, এবং রীতিমতো ফার্ণিশড । তার মানে এখানে নিয়মিত ভাবে মানুষ থাকে। অথর্ব দেখল, দেওয়ালে পিঠ করে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মানুষ, আর ঘরের এককোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে চারটি মেয়ে, যাদের পরনে স্কুল ইউনিফর্ম।
পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়েই চটজলদি সবাইকে নিয়ে এই পাতালঘরে আশ্রয় নিয়েছিল দলটি। চারজনের মধ্যে একটি মেয়ে নামার সময় নিজের রুমালটার একটা কোনা বের করে টাইলসটা মাথায় ওপরে চাপা দিয়েছিল। তখন সবাই নিজেকে বাঁচাতে এত ব্যস্ত ছিল যে ব্যপারটা নজর এড়িয়ে গেছে। আর সেই সূত্র ধরেই এই রহস্যের কিনারা হল। দলটার একটা অংশ ধরা পড়ল, পুলিশের বিশ্বাস এদের কাছ থেকেই বাকি দলের হদিশ পাওয়া যাবে। নাটকের যবনিকাপাত ঘটেছে, অথর্বরা সবার আগে ওপরে উঠে এল। কিছুক্ষণ পর ঘাড়ের পিছনে পুলিশের পিস্তল সমেত একে একে মক্কেলদের পাতাল থেকে উর্ধ্বরোহণ শুরু হল। প্রথমে উঠে এলেন সেই ফ্রেঞ্চকাট ভদ্রলোক, তারপর মহিলা, অল্পবয়সী লোকটি, আর শেষে সাধুবাবাজি। আরও কিছু পরে ঝিমোতে ঝিমোতে উঠে চারটি মেয়ে। ওপরে উঠে তারা দাঁড়াতে পর্যন্ত পারলোনা। বসে পড়ল, তারপর আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন অনাহারে বন্দিজীবন কাটিয়ে শরীরে একফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই। ভিড়ের মধ্যে পথ করে এসে এসপি সাহেব অথর্বকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাইকে চেঁচিয়ে বলল, “এই বাচ্ছা ছেলেটি আর এর সঙ্গীদের জন্য আমরা এতবড় একটা নারী পাচারকারী দলকে ধরতে পারলাম। এরা আমাদের পুলিশকর্মীদের বিশাল লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছে।” এই বলে তিনি অনায়াসে অথর্বকে চাগিয়ে মাথার ওপর তুলে ধরলেন। ঘরে গিসগিস করছে মানুষ, সবাই অথর্বের দিকে হাঁসিমুখে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছে। অথর্ব খুব লজ্জা পেতে লাগল, কারোর মুখের দিকে না তাকিয়ে ও নিচে নামার জন্য ছটফট করতে লাগল। পুলিশকাকু বুঝতে পারলেন, নিচে নামতে নামতে আড়চোখে দেখল সেই ফ্রেঞ্চকাট বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে, আর সাধুবাবাজি চোখ বুজে মালা জপে যাচ্ছেন।