জোবায়ের রাজু
লোপার আজকাল মনে হয় সে তার জীবনের একমাত্র শেষ আশ্রয়টুকু হারাতে বসেছে। জীবনের প্রতি আজ তার বড়ই বিতৃষ্ণা। কিন্তু এমনটি প্রত্যাশা সে কখনোই করেনি জয়ের কাছে। তাইতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো লোপা তার বাবা মা ভাই বোন আর একটি সুখের সংসার ছেড়ে জয়কে ভালোবেসে তার কাছে চিরদিনের জন্য চলে এসেছে। এছাড়া আর উপায়ও ছিল না। বাবা যে জয়কে কোনদিনও মেনে নিবেন না।
লতিফ সাহেব যখন মেয়ে লোপার সাথে অতি সাধারণ ছেলে জয়ের দুই বছরের প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পারেন, তখনই লোপাকে করে রেখেছেন গৃহবন্দি। কিন্তু লোপা ছিল তখন এক রোখা। জয়কে সে হারাতেই পারবে না। তাই তো এক বছর আগের কোন এক নিশুতি রাতের আঁধারে জয়ের জন্য ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। সেই রাতে লোপা আর জয় শেষ রাতের ট্রেন ধরে চলে এসেছে এই শহরে। দুজনে সংসার পেতেছে একে অন্যের উপর বিশ্বাস রেখে।
কিন্তু বছর ফেরোতেই জয়ের উপর বিশ্বাস আর আস্থা, দুটোই হারাতে শুরু করেছে লোপা। নিজের মানুষটার আসল রুপ দিন দিন ভিন্ন রুপে ধরা পড়ে লোপার চোখে। একাধিক নারীর সাথে যে জয়ের অবৈধ সম্পর্ক। সেটাও দিনে দিনে বুঝতে পারে লোপা। জয়ের কাছে সে যতবারই এই অভিযোগ তুলেছে, ততবারই হয়েছে প্রতারিত। কোন কোন দিন কথা কাটাকাটির জঘন্য পর্যায়ে এসে জয় রাগে ক্ষোভে লোপাকে শারীরিক নির্যাতনেও বেপরোয়া হয়েছে। ফলে দুজনের সুখ সখ্যের জালে বোনা স্বপ্নের সংসার থেকে সুখ জিনিসটা ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। এই শোকে কত দিন কত রাত যে লোপা চোখের জলে নিজের সমস্ত আশাকে ভাসিয়ে দিয়েছে পরিস্থিতির দুর্গম মুহুর্তে, সেই হিসাবও একেবারে কম নয়।
কোন কোন রাতে জয় বাসায় ফিরত না। অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা কোন নারীকে নিয়ে ভাড়া করা হোটেলে রাত কাটিয়েছে অনেকবার। অনুতাপে পুঁড়তে পুঁড়তে নির্ঘুম রাত পার করেছে লোপা। সব কিছুই নিয়তির নির্মম পরিহাস বলে ভোরের আলোতে যন্ত্রণা ভুলে দিন শুরু করেছে সে।
আজকে এই বিপরীত জীবনে এসে চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলাতে গেলে লোপার মনে হয় তার ফেলে আসা দিনগুলি খুব ভালো ছিল। নোভের নামের একজনের সাথে বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছেন। কানাডা প্রবাসি নোবেল। সেখানে কর্মরত একজন ডাক্তার সে। স্বÑপরিবারে থাকে। বাবার কাছে এমন প্রস্তাবের কথা প্রথম শুনেই অমত প্রকাশ করে লোপা। লতিফ সাহেব মেয়ের উপর কোন চাপ দেননি। ফলে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তিনি তখনও জানতেন না লোপার সমস্ত হৃদয় জুড়ে বাস করছে একজন মানুষ। জয়।
পরিস্থিতির এই পর্যায়ে এসে আজ লোপার কেবল মনে পড়ে দূরের কানাডা শহরের অদেখা সেই নোবেলকে। নোবেলের কাছে থাকলে হয়তো আজ তার জীবনের এই পরিণতি হত না, যা এখন হচ্ছে জয়ের সংসার করতে এসে।
২.
রাত সাড়ে নয়টা। তিন দিন নিখোঁজ থাকার পর আজ জয় বাসায় এসেছে। দরজায় টোকা পড়ার পর লোপা দরজা খুলে ভুত দেখার মত চমকে উঠে। জয়ের পাশে এ মেয়েটি কে? মেয়েটির এত গর্জিয়েস সাজ সজ্জা কেন? জয়ের গায়েও নতুন সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী। ক্লিণ শেভ।
জয় তরল গলায় বললÑ‘লোপা, ও সুস্মিতা। আমরা আজ বিয়ে করেছি। সুস্মিতা তোমার আমার কথা জেনেও আমাকে বিয়ে করেছে। কেননা ওর আগের বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে।’
মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল লোপার। জয় একি করেছে। আরেকটা বিয়ে করেছে? রাগে অভিমানে লোপা দৌড়ে গিয়ে জয়ের পাঞ্জাবীর কলার চেপে ধরে ক্ষ্যাপা গলায় বলতে লাগলÑ‘তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছো। তুমি প্রতারক।’ বলতে বলতে জয়ের সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী টেনে টুনে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। হিং¯্র বাঘের মত জয়ও গর্জে উঠে লোপাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতেই বারান্দায় গিয়ে পড়ল লোপা। সুস্মিতাকে ঘরে ভরে জয় ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। বারান্দার মেঝেতে পড়ে রইল লোপা।
না, এই বিশ্বাস ঘাতকের ঘর আর একদিনও করবে না লোপা। একদিন রাতের আঁধারে এই অমানুষের কাছে চলে এসেছে সে। আজো সে রাতের আঁধারে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
গভীর রাতের একটি নিস্তব্দ নদীর ব্রিজের উপর এসে দাঁড়ালো লোপা। ব্রিজের নিচে বহমান নদীর পানি। দেরি না করে সে পানিতে ঝাঁপ দিল লোপা। এ জীবন আর সে রাখবে না।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।