আদরের সন্তান

আদরের সন্তান

জোবায়ের রাজু

ড্রয়িংরুমে সেই অনেকক্ষণ ধরে টিলিফোন বাজছে। মজিদ সাহেব ইচ্ছে করেই ফোন ধরছেন না। আজকাল টেলিফোন জিনিসটার প্রতি তার আগ্রহ হারাচ্ছে। আগে তিনি এমন ছিলেন না। কারণে অকারণে বন্ধু বান্ধবদের সাথে লাগামহীন কথা বলতেন। টেলিফোনে মজিদ সাহেবের এমন অহেতুক প্রলাপ শুনে তার কোন কোন বন্ধু বিরক্ত হতেন। সেই মজিদ সাহেব হঠাৎ বদলে গেলেন। গত তিন মাসে কাউকে কল করেছেন বলে তার মনে পড়ে না।
একের পর এক টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। অবশেষে মজিদ সাহেব ফোন ধরতেই ওপার থেকে এক তরুণীর রিনরিনে গলাÑ‘কে বলছেন? মজিদ সাহেব?’ মজিদ সাহেব ছোট্ট করে বললেন ‘হ্যাঁ।’ ওপার থেকে সেই অজ্ঞাত তরুণীর ক্ষোভ মাখা গলাÑ‘আমি রাকা বলছি। আপনার ছেলের জ্বালায় অতিষ্ঠ। ওকে সাবধান করে দিবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সে আপনার কাছ থেকে এক লাখ টাকার আবদার নিতে আসবে। কিন্তু আপনি টাকাটা দিলে আমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।’
অজ্ঞাত তরুণীর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলেন না মজিদ সাহেব। রং নাম্বার নয় তো! কিন্তু রং নাম্বার বলেও তার মনে হল না। জিজ্ঞাসু সুরে বললেনÑ‘তুমি কে মা? আমি তোমার কথার কোন মানেই বুঝছি না। একটু ক্লিয়ার করে বলবে?’ ওপার থেকে মেয়েটির জবাবÑ‘আপনার ছেলে ইমন গত এক বছর ধরে আমার পিছু লেগেছে। আমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আমি আরেকজনকে দেড় বছর আগে গোপনে বিয়ে করেছি। আমার পরিবার এখনো এ ঘটনা জানে না। আপনার ছেলে আমার পিছুও ছাড়ছে না। আমি আর আমার মা সৎ ভায়ের সংসারে খুব কষ্টে আছি। ইমন আমার সৎ ভাইকে বশ করেছে। এক লাখ টাকার লোভ দেখিয়েছে আমার সৎ ভাইকে। টাকার লোভে আজ সৎ ভাই আমাকে ইমনের হাতে তুলে দিবে। টাকার জন্য ইমন এখন আপনার কাছে গেছে।’
রাকার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন মজিদ সাহেব। বিস্মিত গলায় বললেনÑ‘কি বলছো তুমি?’ রাকা ক্রন্দন সুরে বললÑ‘হ্যাঁ, আমাকে বাঁচান আংকেল। আপনি টাকাটা দিলে আমাকে ইমনের হাতে তুলে দেয়া হবে।’ মজিদ সাহেব কোমল গলায় বললেনÑ‘তুমি চিন্তা করো না মা। তোমার কিচ্ছু হবে না।’
টেলিফোন রেখে দিলেন মজিদ সাহেব। এ কোন বাস্তবতার মুখোমুখি তিনি! ইমনের এত অধঃপতন! ছেলেটার এমন বখাটেপনাও ইদানিং চোখে পড়ছে মজিদ সাহেবের। রাত করে বাসায় ফিরে এখন। সেদিন ওর ঘরে মদের গন্ধও পাওয়া গেছে। কিন্তু এসবের জন্য তো তিনি ইমনকে একুশ বছর আগে রাস্তা থেকে তুলে আনেননি।
একুশ বছর আগে কোন এক পড়ন্ত দুপুরে একটি শিশু তার মৃত মায়ের লাশের পাশে বসে কাতর গলায় কাঁদছিল। এই হৃদয় বিদারক দৃশ্যে আশে পাশের কারোই ভ্রæক্ষেপ ছিল না। সেদিক দিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন মজিদ সাহেব। পথের এই করুণ দৃশ্য দেখে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। স্থানীয় একজনের মুখে জানলেন মৃত মহিলাটি তার এই শিশু পুত্র নিয়ে এখানে ভিক্ষা করতেন। আজ হঠাৎ করে মরে পড়ে আছেন।



ঘটনাটা বেশ কষ্ট দিল মজিদ সাহেবকে। শিশুটির প্রতি তার বেশ মায়া হল। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই ছেলেটাকে তিনি নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে তুলে আনলেন ছোট্ট বাচ্ছাটাকে। বিশাল আলিশান বাড়িতে ঠাঁই হল রাস্তার অচেনা বাচ্ছাটির। মজিদ সাহেব বাচ্ছাটার নাম রাখলেন ইমন।
এই ঘটনার এক মাস আগে স্ত্রীকে হারালেন মজিদ সাহেব। সাগর দেখতে গিয়েছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বালুচরে তলিয়ে গেল মোর্শেদা। স্ত্রীকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতেন বলে বাকি জীবন একা থাকার সংকল্প করলেন তিনি। হঠাৎ তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে ইমনের এমন আর্বিভাবকে তিনি ¯্রষ্টার করুণা বলে মনে করলেন। দুই মাসের অন্তঃসত্তা ছিল মোর্শেদা। কিন্তু সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই সাগরে হারিয়ে গেছে সে।
ইমনকে তিনি পিতৃ¯েœহে লালন করার স্বপ্ন বুনলেন। পিতৃ¯েœহ নিয়ে দিন দিন বড় হতে লাগল ইমন। এই যে মজিদ সাহেবের অগাধ সম্পদ, সবই তিনি ইমনকে দিয়ে দিবেন।
ইমন বড় হতে লাগল। মজিদ সাহেব ইমনকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার কোন ত্রæটি রাখলেন না। বাবার কাছে যখন যা চেয়েছে ইমন, কখনো নিরাস হয়নি। মজিদ সাহেব ইমনকে আজীবন সুখেই রেখেছেন। বন্ধু বান্ধবদের বলতেনÑইমন আমার আদরের সন্তান।
কিন্তু দিন দিন বদলাতে থাকে ইমন। তার বন্ধুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। আজে বাজে ছেলেদের সাথে তার অবাধ উঠাবসা। ধুমপানও শিখে গেছে ততদিনে। নিয়মিত ক্লাসে যায় না। রাত দুপুরে বাসায় ফিরে। চোখের সামনে ছেলেটার এমন পরিস্থিতি দেখে অনুতাপে জ্বলতে থাকেন মজিদ সাহেব।







মজিদ সাহেব রাকার সাথে টেলিফোনে কথা বলার ঠিক চল্লিশ মিনিট পর ইমন বাসায় এসে বাবার সামনে দাঁড়ালো। আজ ইমনকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। স্বাভাবিক গলায় ইমন বললÑ‘আব্বু আমার এক লাখ টাকা লাগবে।’ মজিদ সাহেব কোন কিছু না বলে সোফায় বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর তরল গলায় বললেনÑ‘এত টাকার কাজ কি তোমার?’ ইমন বললÑ‘একটা বাইক কিনবো।’ ছেলের কথা শুনে গা জ্বলে উঠল মজিদ সাহেবের। ইমন এমন কৌশল করে তার সঙ্গে মিথ্যেও বলে। বেশ উদ্দিপ্ত গলায় মজিদ সাহেব বললেনÑ‘রাকা কে? তুমি তার ভাইকে এক লাখ টাকা দিবে?’ চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে ইমন বললÑ‘তুমি এসব কিভাবে…?’ মজিদ সাহেব সোফা থেকে উঠে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলেন ইমনের গালে।
তারপরের দৃশ্যটির জন্য অপ্রস্তুত ছিলেন মজিদ সাহেব। ইমন রেগে মেগে ঘরের সমস্ত আসবাব পত্র ভাংচুর করতে করতে হিং¯্র গলায় বললÑ‘টাকা দিবে কি না বল! আমার যা ইচ্ছে তাই করব। কি করবে তুমি?’
এসব কি দেখলেন মজিদ সাহেব! এসবের জন্যে কি সেদিন তিনি রাস্তা থেকে ইমনকে তুলে এনেছেন? পিতৃ¯েœহে বড় করা এই আদরের সন্তানের কাছ থেকে কি এটাই প্রাপ্য তার?

 

আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

গৌতম সরকার আজ এলাম সাম বালিয়াড়ি থেকে জয়সলমের হয়ে যোধপুর। এটাই আমাদের শেষ গন্তব্য। কয়েকদিন ধরেই বিপ্রতীপে পথ চলা শুরু হয়ে গেছে। ট্যুর শেষ হতে ...
একটিবার-মনিরুজ্জামান অনিক

একটিবার-মনিরুজ্জামান অনিক

মনিরুজ্জামান অনিক     বুনোহাঁসের দল যখন ছুটে যায় জলে, আমি দীঘর্শ্বাস ফেলি কিছু ফেলে আসা অতীতে। আমার চোখ ঝাপসা হয়, চশমাটা খুলে রাখি টেবিলে। ...
চক্ষুজ্ঞানী- মেহেদী জাহিদ

চক্ষুজ্ঞানী- মেহেদী জাহিদ

মেহেদী জাহিদ চক্ষু পড়িয়াছে চক্ষুর বাইরে; কোন চক্ষুতে দেখবে তুমি আঁখি নাহি খুলিলে? চক্ষুর ভিতরস্থও যে চক্ষু আছে; কোন স্থানে তা বিরাজবান? নয়নে নয়ন সর্ব ...
Why Stock Market Affects Men and Women Differently

Why Stock Market Affects Men and Women Differently

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালী মুসলমান সমাজ  [পর্ব – ৩ ]

রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালী মুসলমান সমাজ  [পর্ব – ৩ ]

|মিরাজুল  হক     পর্ব – ৩ :    ( বাঙালী মুসলমানের ধর্মচিন্তা ও রবীন্দ্রনাথ )  বেশির ভাগ বাঙালী মুসলমান ধর্মপ্রাণ । ইসলাম বিশ্বাসী । মৈত্রী ...
কবিতার- রাত কাহন

কবিতার- রাত কাহন

দিপংকর ইমন এ কেমন রাত এলো? আমাদের কিছু দ্রুপদী পাপ আলো কে যারা ভালোবাসেনি কখনো সূর্য তাদেরই হাতে মুঠো বন্দী। আমাদের চোখগুলো সম্মোহিত মাতৃভুমির চোখের জলে ভেসে ...