জোবায়ের রাজু
গাঁও গেরামে এত বড় একটা সুপার মার্কেট হবে, এটা আমার মত অনেকেই ধারণা করেনি। সন্ধ্যায় এই মার্কেটের আলো ঝলমলে বাতিগুলো দেখে আমার চোখ আটকে যায়। ভিক্ষার থলে হাতে নিয়ে তাই আমি সন্ধ্যায় এ মার্কেটের সামনে চলে আসি। আমার মুগ্ধ চোখ রঙিন বাতির মত রঙিন হয়ে উঠে।
এখানে নতুন মার্কেট হয়েছে, তাই লোক লোকারণ্যে মার্কেট প্রাঙ্গন ভরপুর। আমার ভিক্ষার থলেতে পয়সাও বেশি পড়ে বলে আমার কেবল মনে হয় মানুষের দানের হাত দিন দিন লম্বা হচ্ছে। অথচ আগে দিন শেষে সারাদিনের আয় দেখে মনটা খারাপ হয়ে যেত। আর এখন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পয়সা পাই।
সেদিন এ মার্কেটে বাবার সাথে শপিং করতে আসা এক যুবককে দেখে আমার অতীত খুব মনে পড়ে গেল। ছেলেটির মত এক সময় আমিও ছিলাম আমার বাবার তিন সন্তানের বড় সন্তান। প্রাচুর্যে বেড়ে উঠা আমার। তরুণ বয়সে জীবনে প্রেম আসে। সুলতানাকে ভালো লাগত। এক সময় আমাদের প্রেম হয়। কোর্ট ম্যারেজ করি আমরা। বাবা এই সত্য মেনে নেননি। ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।
সুলতানাকে নিয়ে বিপাকে পড়ি। আজ এ বন্ধু তো কাল ও বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় খুঁজি। উচ্চশিক্ষিত ছিলাম না বলে ভালো মাইনের চাকরি পাওয়াটা আমার জন্য দুরহ হয়ে দাঁড়ালেও আমার চেষ্টার ত্রæটি থাকত না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রোজ ইন্টারভিউ দিতাম। ফলাফল শূন্য। ইন্টারভিউতে পাস করি না।
সুলতানাকে নিয়ে আমার বন্ধু আকরামের বাসা থেকে মানিকের বাসায় উঠলাম। একদিন যথারীতি চাকরি খুঁজতে বের হয়ে পূর্বের নিয়মে ব্যর্থ হয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। মানিকের স্ত্রী তিন্নি ভাবি হাতে ছোট্ট একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘এটা পড়েন।’
সে চিঠিতে সুলতানা লিখেছে-তোমার এই ছন্নছাড়া জীবনে আমি আর থাকতে পারলাম না বলে চলে গেলাম। চরম অভাবে সংসার করতে রাজি আছি, কিন্তু এভাবে জনে জনের দুয়ারে গিয়ে ফকিরের মত আশ্রয় নেয়াটা আমার সম্মানে বাঁধে। তাছাড়া তুমি আমাকে আর কতটুকু সুখি করতে পারবে জীবনে! তোমার বাবা তোমাকে ত্যাগ করেছেন। আজ তুমি চাল চুলোহীণ মানুষ। এই মানুষ আমাকে কতটুকু সুখি করতে পারবে, আমি জানি। তাই চলে গেলাম। তুমি চাকরিও পাও না। কিন্তু আমি ঠিকই গার্মেন্টসে কাজ খুঁজে নিতে পারব।’
সুলতানার চিঠি পড়ে সেদিন আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল মনে হল। কেঁদে অস্থির হলাম। ফিরে গেলাম বাবার কাছে। ক্ষমা চাইলাম। বাবা আমাকে কুকুরের মত তাড়িয়ে দিলেন। আমার ছোট দু ভাই রাহী আর রকি এ দৃশ্য দেখেও কোন প্রতিবাদ করেনি।
ভদ্রগাঁও বস্তিতে দিন শুরু করলাম। সর্বহারা এই আমার ভিক্ষা ছাড়া আর কোন গতি ছিল না বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে মেনে নিলাম। অথচ এই পেশা চিরটা কাল ঘৃণা করে এসেছি।
সারাদিন পথে পথে ভিক্ষা করে রাতে ভদ্রগাঁও বস্তিতে এসে চরম ক্লান্তিতে বালিশে মাথা গুজে দিতাম। ভাঙা টিনের ফুটা দিয়ে রাতের আকাশের অজ¯্র তারা দেখতাম আর অতীত মনে করতাম। রাহী রকিকে মনে পড়ত। আমার দশ বছর বয়সের পর ওরা যমজ হয়ে পৃথিবীতে এসেছে। দুটি শিশু বাচ্চা নিয়ে মায়ের তখন কঠিন অবস্থা। আমি কোলে কোলে রাখতাম দু ভাইকে। ওরা বড় হতে থাকে। আমি ওদেরকে স্কুলে নিয়ে যাই, নিয়ে আসি। বিকেলে দোলনায় দোল খাওয়াই। ওরা দু ভাই দোলনায় চড়ে ফোকলা দাঁতে খিলখিলিয়ে হাসে। বড়ই মধুর সে দৃশ্য। দিন দিন ভায়েরা বড় হতে থাকে।
২.
আজ সন্ধ্যায় সুপার মার্কেট থেকে শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে যে দুটি যুবক ছেলে বের হয়ে আসছে, তাদেরকে বড় চেনা চেনা লাগছে। আরে! এ তো আমার দু ভাই রাহী আর রকি। বাহ, কত্ত বড় হয়ে গেছে। দেখতে যেন রাজপুত। গায়ে দামি দামি জামা ভাইদের।
সামনে এগিয়ে গিয়ে বললাম-তোরা? অনেকদিন পর দেখলাম তোদের। ভালো আছিস?’ দুজনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-আপনি কে?’ বললাম-আমি তোদের বড়দা। চিনতে পারিসনি?’ ওরা চোখ কপালে তুলে বলল-বড়দা তুই? শুকিয়ে এতো কংকাল হলি কেন? হাতে এটা কিসের থলে? ভিক্ষা করিস নাকি?’ আমি মরা হাসি দিয়ে বললাম-ভিক্ষা করি। আয় তোদের একটু জড়িয়ে ধরি।’ রকি বলল-সত্যি ভিক্ষা করিস?’ হেসে বললাম-মিথ্যে কেউ ভিক্ষা করে? আয় ভাই আমার কোলে আয়।’
রাহী এদিক সেদিক তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল-এসব আচরণ করিস না তো বড়দা। তুই ফকির। এটা লোকে জানলে আমাদের ভারী শরম হবে।’ এই বলে দু ভাই দ্রæত স্থান ত্যাগ করে চলে গেল।
আমার চোখে পানি চলে এলো। আমি ভিক্ষা করি, এটা লোকে জানলে ওদের শরম হবে। অথচ ছোট বেলায় ওদেরকে যখন কোলে কোলে রাখতাম, তখন কোন শরম লাগেনি আমার।
হঠাৎ আমার সামনে দিয়ে একটি লাল প্রাইভেট কার চলে গেল। স্পষ্ট দেখলাম গাড়ির ভেতরে এক সুদর্শন যুবকের পাশে হাত ধরে বসে আছে সুলতানা। হয়তো আমার মত চাল চুলোহীণ মানুষের জীবন থেকে সরে গিয়ে সে ওই সুদর্শন যুবকের মাঝে খুঁজে পেয়েছে রাণীর মত বেঁচে থাকার অবলম্বন।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।