ফজলে রাব্বী দ্বীন
আরাফ খুবই অসুস্থ। চার দিন ধরে টানা বিছানায় পড়ে আছে। তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। মুখে কোন কথা বলতে পারছে না। মাঝেমধ্যে দু’একটা শব্দ উচ্চারণ করে। ‘শালিক পাখি’, ‘দাদু’, ‘জঙ্গল’ ইত্যাদি। তারপর আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বাড়ির কেউই ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। মায়ের চিন্তার কোন অন্ত নেই। আরাফের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর ঝরঝর করে চোখের জল ফেলছে মা। এ কেমন ধরণের অসুখ? ডাক্তারের ঔষধেও কাজ হচ্ছে না। দেশের বাইরে থেকে এইমাত্র বাড়িতে এসে পৌঁছালো আরাফের বড় ভাই আকবর হোসাইন। আরাফের জন্য কত কি যে কিনে এনেছে তা আর কাকে দেখাবে? যাকে দেখাবে সেই তো চোখ খুলতে পারছে না। বাবার কাছে গিয়ে ঘটনার শুরুটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায় সংক্লান্ত কাজের জন্য ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম দশ দিন আগে। পাঁচ দিনের মাথায় কাজ শেষ করে যখন বাড়িতে ফিরছিলাম তখনই ট্রেন থেকে নেমে জয়দেবপুর স্টেশনে আরাফকে পাই। ছেলেটা স্টেশনের এক কোণা থেকে অন্য কোণায় ছোটাছুটি করছিল আর কি সব আবোল তাবোল বকছিল। কাছে এসে আরাফের ধ্যান ভাঙাতেই দেখি দাদু, দাদু বলে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর আর কোন কথা বলেনি। সোজা আমার কোলে ঢলে পড়েছে। এমন একটা স্টেশনে আরাফ একা একা কি করতে এসেছিল? কোথা থেকেই বা ছেলেটা এখনে এল? আর পাগলের মত দাদু, দাদু বলেই বা চিৎকার করছে কেন? এসব উত্তর এখনও অজানা। হয়ত আরাফ সুস্থ হলেই জানতে পারব সব। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে যত দ্রুত সম্ভব স্টেশনের পাশেই পারভেজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তারপর বাড়িতে খবর পৌঁছাই। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে সফল হলেও বর্তমান অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছ আকবর।’
অস্থির হয়ে আকবর বলল, ‘আমরা দেরি করছি কেন বাবা? চলেন আরাফকে নিয়ে শহরের ভালো কোন ডাক্তারকে দেখাই।’- বাবা আর দেরি করল না।
সবমিলিয়ে আরও চারদিন লেগে গেল। আরাফ এখন মোটামুটি সুস্থ। ডাক্তারের কাছ থেকে ছুটি পেয়ে সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু আরাফের চেহারায় কষ্টের কিছু ছাপমূর্তি কিন্তু কিছুতেই সরল না। সে সবসময় হন্য হয়ে কাকে যেন চারদিকে খুঁজে বেড়ায়। বাবার দিকে তাকিয়ে আরাফ বলল, ‘তুমি কি সেই শালিক পাখিটিকে কোথাও দেখেছিলে বাবা?’
‘শালিক পাখি!’- অবাক হয়ে চোখ কপালে তুলল আরাফের বাবা।
‘হ্যাঁ, শালিক পাখি। আমার দাদুর শালিক পাখি। যে আমাকে জঙ্গলে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল।’
আরাফের ভাইয়া তখন বলল, ‘তুমি কোন শালিক পাখির কথা বলছ, আরাফ? আমাদের দাদু যে পাখিটাকে পোষ মানিয়েছিল সেটা তো মরে গেছে তোমার জন্মের আগেই।’
‘না, মরে নি।’- প্রতিবাদ করে বলল আরাফ।
‘আচ্ছা ধরে নিলাম মরে নি। কিন্তু আগে বল তো কেন তুমি ঐ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলে?’- বলল আকবর।
‘আমার দাদু আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।’
‘তোমার দাদু নিয়ে গিয়েছিল? এটা কিভাবে সম্ভব? আরাফ, তুমি ভালো করেই জানো, তোমার দাদু তোমাকে ছোট রেখেই অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।’- বলল আরাফের মা।
‘না, দাদু অসুস্থ হয়ে মারা যায় নি। তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে, মা। দাদুকে হত্যা করা হয়েছিল। ভাওয়াল গড়ের পাশের জঙ্গলে ভিনদেশি কতগুলো ডাকাত আমার দাদুকে হত্যা করেছিল। আর এটা করিয়েছে একটা নোংরা শয়তান। ও পাড়ার রোকন আঙ্কেল। দাদু আমাকে সব কথা বলেছে। দাদুর টিয়ে পাখিটা এখনও ঐ জঙ্গলেই থাকে এবং সেই আমাকে দাদুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল।’
আরাফের কথা শুনে বাড়ির সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল। আরাফ কিন্তু মিথ্যা বলছে না। রোকনের সাথে তাদের শত্রুতা আদিকাল থেকেই। বরং সত্য বলার পাশাপাশি আরাফ অজানা অনেক গোপন তথ্যও গড়গড় করে বলে চলেছে। আরাফের বাবা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় আরাফ তার হাতের আঙ্গুলে পড়া ঝকঝকে রুপার একটা আংটি সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়ে বলল, ‘এটা আমাকে আমার দাদু দিয়েছে।’
এবার আর কারও বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো না যে আরাফ কি বলতে চাচ্ছে। এই আংটিটা ছিল আরাফের দাদুর। কৌতুহলে বাড়ির সবাই আরাফকে ঘিরে ফেলেছে। তাই আরাফও সবাইকে শুনিয়ে তার গল্প প্রথম থেকে শুরু করল।
সোমবার সকালে আরাফ যখন স্কুলের দিকে রওনা দেয় তখনি একটা শালিক পাখিকে দেখতে পায়। স্কুলের পথ বাড়ি থেকে প্রায় পনের মিনিট। পাখিটা বারবার আরাফের মাথার উপরে চক্কর দিচ্ছিল আর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আরাফ ব্যাপারটা ধরতে না পেরে কখন যেন পাখিটাকে অনুসরণ করতে শুরু করে তা সে বলতে পারে না। অজান্তেই আরাফ স্কুল ছাড়িয়ে দূরের রেল স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। স্কুল ও রেল স্টেশনের মাঝখানে এই জঙ্গলের ব্যপ্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দিগন্তের শেষ অবধি। জঙ্গলের ঠিক মাঝখান দিয়ে শাঁ শাঁ করে বাতাসের বেগে রেল ছুটে যায়। আরাফ জঙ্গলের সেই পথ বরাবরই হাঁটতে থাকে। সে জানে না তার গন্তব্য কোথায়! অদ্ভুত এক ধ্যানের শক্তি তাকে পাখিটার পিছু পিছু নিয়ে যায়। এমন সময় পেছন থেকে ঝড়ের বেগে ছুটে আসে কোথাকার এক দুরন্ত ট্রেন। কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানে কে যেন আরাফকে ধাক্কা দিয়ে রেল লাইন থেকে ছিটকে বের করে দেয়। ট্রেন চলে গেলে আরাফের ধ্যান ভাঙ্গে। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পায় দু’কদম ফাকেই একজন বৃদ্ধ লোক লাঠি হাতে ভর করে দাড়িয়ে আছে। চুলগুলো কাশফুলের মত শাদা, দাড়িগুলো বাতাসে ঢেউ খেলাচ্ছে আর গায়ে শাদা পাঞ্জাবি সজ্জিত। লোকটির কাঁধে বসে আছে সেই শালিক পাখিটি। বৃদ্ধের মুখের দিকে অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আরাফ। তারপর আষাঢ়ের দিনের মত কোথা থেকে যেন তার চোখে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি খেলা করে উঠল। ‘দাদু’- কথাটা বলেই এক দৌড়ে বৃদ্ধকে সে জড়িয়ে ধরল।
সকাল পেরিয়ে দুপুরের আয়োজন শেষ হতে চলেছে। জঙ্গলে অন্ধকার নেমে আসে দিনের আলোতেই। ঝোঁপ-ঝাড়ের ভয়াবহতা সমগ্র বিস্তৃত। এ জঙ্গলে তিনটি প্রাণীর আনাগোনা ব্যতিত আরও কত যে প্রাণী ঝোঁপে-ঝাড়ে লুকিয়ে আছে তা অজানা। কিন্তু আরাফের কোন ভয় লাগছে না। সে তার দাদুকে পেয়ে যেন এক টুকরো জান্নাত খুঁজে পেয়েছে। দাদুকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে একের পর এক।
‘তুমি এখানে কিভাবে এলে? বাড়ি কেন যাও না? তোমাকে বাড়ির সবাই খোঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু তুমি কেন এর গুরুত্ব দাও না? সবাই বলেছে তুমি নাকি মরে গেছো? তোমার লাশ নাকি রোকন আঙ্কেল এই জঙ্গলেই কাঠ কাটতে এসে কুড়িয়ে পেয়েছে। দাদু, ও দাদু..। কথা বলো না কেন?’
আরাফের এত্তগুলো প্রশ্ন শুনে দাদু শুধু মিটিমিটি হাসে।
‘দাদুভাই, তোমার রোকন আঙ্কেল কি এখনও বেঁচে আছে?’- দাদু আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল।
‘না তো। বেঁচে নেই। বাবা বলেছে কয়েকদিন আগে উনি নাকি এই জঙ্গলের মধ্যেই কাঠ কাটতে এসে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।’
‘তুমি জানো, সেই লোকটাই আমাকে হত্যা করেছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি খেলা দেখ, নিজের পাপের শাস্তি নিজেই সে পেয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।’- দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল দাদু।
‘কি সব বলছ তুমি, দাদু। এইতো তুমি আমার সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছ। আমার সাথে কথা বলছ। তাহলে তোমাকে হত্যা করা হল কিভাবে? আমার সাথে কিন্তু মজা করবে না। তুমি তো জানোই, আমি ছোট থেকেই এইসব পছন্দ করিনা।’- কথাটা বলেই দাদুর হাত চেপে ধরল আরাফ।
‘আমি জানি দাদুভাই। কিন্তু তোমাকে যে সত্যটা জানতে হবে। আমি তোমাকে এজন্যই এখানে নিয়ে এসেছি। আমি সবসময় সত্য কথা বলতাম। আমি আমার বাবার কাছ থেকে এই অভ্যাসটা পেয়েছি। তোমার স্কুলের পূর্ব পাশে আমগাছের যে বনটা দেখতে পাও সেটা তোমার রোকন আঙ্কেল আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল বহু বছর আগেই। পশ্চিম পাশের মোটা বটগাছটাকে নিজের বলে দাবি করায় আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম। তোমার বাবা অধমের মত শুধু ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকে। এই সব নজরে রাখে না। আমার প্রতিবাদে কর্কশ প্রকৃতির রোকন আরও ক্ষেপে যায়। সে নিজের সিদ্ধান্তে সরকারি জমিতে বেড়ে উঠা অজস্র বনের গাছপালাগুলো কেটে কেটে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার করত। শয়তান এই লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস কেউ রাখত না। তাই বলে তোমার দাদু কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকে নি। পুলিশের কাছে গিয়ে শয়তানটার নামে নালিশ করেছিলাম। তার পথের বাধা বলতে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। আমার পরিণাম কি হতে পারে তা হয়ত আগে থেকেই আন্তাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু মুহূর্তের জন্যও পিছু হটি নি। সিংহের মতো বেঁচে থাকাটাকেই তো জীবন বলে! একদিন তো সবাইকেই মরতে হবে। মৃত্যুর ভয় পেয়ে কি লাভ, বল দাদুভাই? পুলিশকে নালিশ করার অপরাধে শয়তনটা ডাকাতদেরকে টাকা দিয়ে লেলিয়ে দেয়। আর আমাকে জঙ্গলের মধ্যে ঐ ঝাউগাছটার তলায় কুঁপিয়ে হত্যা করে। আমার শালিক পাখিটা সব দেখেছিল। কথা বলতে পারেনা বলে মনের দুঃখে এই জঙ্গলের আশেপাশে পাগলের মত ঘুরে বেড়ায়।’
এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল আরাফ। কিন্তু তার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। আরাফ দাদুকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে ভেবে পেল না। হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন তারা স্টেশনের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে তা এতক্ষণে বোধগম্য হল আরাফের। নিঃসংকোচে দাদুর দিকে তাকিয়ে আরাফ বলল, ‘দাদু, ঐ তো স্টেশন। আর কোন চিন্তা নেই। চল, আমরা এবার স্টেশনের পথ ধরে বাড়ি ফিরে যাই।’
‘তুমি যাও, দাদুভাই। আমার জন্য চিন্তা করো না।’
‘তুমি যাবে না?’- আরাফের প্রশ্নে দাদুর চোখ ভিজে যায়। কৌতুহলে আরাফের গায়ে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে দাদু বলল, ‘আমি যে আর কোনদিনও ফিরব না। সবাইকে বিদায় জানিয়েছি অনেক আগেই। শুধু তুমি বাকি ছিলে। ঐ যে দূরে তাকিয়ে দেখো তোমার বাবা এদিকেই আসছে।’
আরাফ হতভম্ব হয়ে একটু সামনের দিকে এগিয়ে বিষয়টাকে খেয়াল করার চেষ্টা করে। সত্যিই তো! তার বাবা এই দিকেই আসছে। ‘কিন্তু দাদু..’- কথাটা বলেই আরাফ পেছনের দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু আর কাউকেই দেখতে পায় না।
ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রথম বর্ষ,
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)।