শরতের বৃষ্টিস্নাত সকাল । ঘুমের জন্য যুতসই একটা আবহাওয়া । অন্যদিন সকাল ছয়-সাতটা নাগাদ রোদ উঠে যায় । রোদের তেজও থাকে গা জ্বালানো । প্রজাপতি পরিবহনে জানালার পাশের সিটে বসেছে অয়ন ।
গাড়ি চলছে হেলেদুলে, হক্কর ঝক্কর শব্দে ।
বৃষ্টির ঝাপটা লেগে জানালার কাঁচগুলো আবছা হয়ে আছে । বৃষ্টি কমে আসতেই জানালার কাঁচ সরিয়ে একটু সতেজ বাতাস নিতে চায় সে । পরীক্ষার জন্য তার এই কয়েকটা দিন কেটেছে চরম ব্যস্ততায় ।
রোড ডি-ভাইডারে লাগানো কাঠগোলাপের গাছগুলো যেন সবুজের দ্যুতি ছড়াচ্ছে ।
অন্য সময় ধুলোয় ধূসর হয়ে থাকা সবুজ পাতাগুলো ।
কতগুলো আকাশচূড়া ফুল রাস্তায় পড়ছে আর যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে । অয়নের মনে হয় ; শরতের বৃষ্টির তাল, লয়, ছন্দ বর্ষার বৃষ্টির চেয়ে যেন ভিন্ন । হঠাৎ ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ির দঙ্গল আটকে যায় । বৃষ্টি আবার পড়তে শুরু করে । জানালটা ভিজিয়ে দেয় অয়ন ।
অবছা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, তার বাসের গা ঘেঁষেই একটা বাস দাঁড়িয়ে । পাশের বাসটার জানালার কাছে বসা এক রূপসী তরুণী । জানালা খুলে হাত বাড়ালেই ধরা যাবে এমন কাছাকাছি মেয়েটা । অস্বচ্ছ জানালা দিয়ে তাকিয়েই মেয়েটির একটা মোহনীয় রূপ এঁকে ফেলে অয়ন । গাঢ় নীল শাড়ি পরা, ঠোঁটে কড়া লাল লিপিস্টক, খোলতাই গঠন । আহা ! নীল পরী আমার ।
অয়ন মেয়েটার মায়ায় পরে যায় । এই একটা সমস্যা ইদানিং জ্বালাচ্ছে অয়নকে । কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলেই প্রেমে হাবুডুবু খায় । আবেগ উছলে উঠে ।
আবার ঘোর কাটতেও বেশিক্ষণ সময় লাগে না তার । এবার সিগন্যাল ছাড়ে । গাড়িগুলোর ঘোঁ… ঘোঁ… পি… পি… শব্দ করে এগোয় ।
অয়ন থাকে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে । কয়েকজন বন্ধু মিলে ফ্লাট ভাড়া নিয়ে ।
অয়নের গন্তব্যে বসিলা । তার চাচাতো ভাই থাকে সেখানে । কয়েদিন ধরেই আসবো আসবো করে আসা হয়নি তার ।
অয়নের ফোনের রিংটন বেজে
উঠে । স্কিনে লেখা ইনকামিল কল । বাবা।
রিসিভ করেই সালাম জানায় অয়ন ।
ওপাশ থেকে কৌতূহলী কন্ঠে অয়নের বাবা প্রশ্ন করে–
: কিরে ব্যটা, তোর মামা’ক দেখবা যাঁচি নাকি, বাপ ?
: হ, যাঁচু আব্বা ৷ এই তো বাসত আঁছু ।
: ঠিক ছে । যা তাহলে পরে ফোন দিম । ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেয় অয়নের বাবা ।
হেডফোনটা কানে গুঁজে এফ এম রেডিও অন করে অয়ন । সুকন্ঠী আরজের কন্ঠ ;
Hi dear listener . চলুন শুনি আসি এই বৃষ্টিস্নাত শরতের রোমান্টিক সকালে রবীন্দ্রনাথের একটি চমৎকার গান । সাথেই থাকুন । ফিরছি একটু পরেই ।
বেজে ওঠে গান —
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর… ।,,
বসিলা বাসস্ট্যান্ড থেকে দুই তিন মিনিট হাঁটার পথ ৷ বাস থেকে নেমেই কাঁদা-পানি এড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকে ।
দরজার কাছে এসে কলিংবেল চাপ দিতই ভাতিজি তিতলীদরজা খুলে দেয় । অয়নকে দেখেই সে এক চিৎকার দিয়ে জানান দেয় অয়নচ্চু এসেছে….!
মা মা, বাবা বাবা, নানী অয়নচ্চু এসেছে ।
আহ্লাদিত গলায় কথার খই ফুটে ৫ বছর বয়সী তিতলীর ।
তার চাচাতো ভাই কামাল তাকে বসতে দিয়ে বলল : বাব্বাঃ, তুই ওসলো তাহলে । এত্তেদিন পর । কেমন ছুয়া তি রে হা !
বয়সে প্রায় দশবছরের বড় অয়নের চাচাতো ভাই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে । একটা মেয়ে নিয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসার । ড্রয়িং রুমে উঁকি দিয়ে দেখে ছোটখাট একটা মিটিং বসেছে । মিটিংয়ের মধ্যমণি যে ছোট মামি তা দেখেই আন্দাজ করা যায় ।
ছোট মামী অয়নের চাসতো মামি । ঠাকুরগাঁওয়ের যৌথ পরিবারগুলোতে চাচাতো মামি – খালা-ফুফু সবাই মিলে এক পরিবার ! আত্মীয়তার একেকটা মহীরুহ উদাহরণ ঠাকুরগাঁও জেলার যৌথ পরিবারগুলো । এখনো এমন অনেক পরিবার দেখা যায় ।
অয়ন লক্ষ করে, সবার মুখে বিষাদের ছায়া । তিতলী ছাড়া সবার মুখে চিন্তার আশঙ্কার কালো মেঘ । সোফায় বসতেই নাস্তার পিরিচটা দেখে প্রথম বারের মত সঙ্কোচে পড়ে অয়ন । পিরিচে আপেল, কমলা, নাসপাতি । তাই দেখে তার মনে হল — রোগী দেখতে এসেছি, কিছু ফলমূল নিয়ে আসা তো উচিত ছিল ! যদিও রোগী আহমদ বাসির মামা বর্তমানে খাবার গ্রহনের মত পরিস্থিতিতে নেই । তবুও নিয়ে আসাই তো সৌজন্যতা ।
মাইমুনা মামি । যাকে ওরা সবাই ছোট মামি বলে ডাকে , তার দিকে তাকিয়ে অয়নের মনটাও কেমন খারাপ হয়ে যায় মুহুর্তে ।
ঈদের ছুটিতে যখন অয়ন বাড়ি গিয়েছিল তখনকার দেখা সেই প্রাণবন্ত, রসিক, হাস্যোজ্জ্বল ছোট মামি যেন কতকাল হাসেননি । আরেক কাজিনের বিয়েতে গীত গেয়ে কি আসর’ই না মাতিয়েছিলেন তিনি —
” কেনে কান্দিচেন কইনাগে, হামার ভিতি দেখে
ছোট হাতে কইছিনু কইনাগে, নবাবের চাকিরি
সেইখানে রাখিছিনু কইনাগে, বক বক দাড়ি ।
দিনাজপুর শহরে কইনাগে, নাপিত মাংগাইম,
কামায়ে ফেলাম কইনাগে, হাউসের দাড়ি…।
ঠাকুরগাঁওয়ের লোকজ ভাষার গীত, প্রবাদ, ছড়া ছোট মামীর ঠোঁটস্থ ! রানীশংকৈল বন্দরের প্রতিবেশী কারোর বিয়ে কিংবা আত্মীয় স্বজনের বিয়েতে গীত গাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননা তিনি ।
হেলেদুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে কয়কজন সমবয়সী মহিলার ঘাড় ধরে সেই কি গীত !
সেই ছোট মামির আজ কি পান্ডুর আর রুক্ষ রূপ ।
কান্নার আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরে পায় অয়ন । মামি কেমন শুর করে ছন্দে ছন্দে কাঁদছে —
“সব শেষ হয়ে গেইল গে বাবু….।
মোক পানি’ত ভাসাহেনে তি মরবা বসিয়ি গে যাদু…।,,
কামাল ভাইয়ের হায়েজে করে সবাই পান্থপথের স্কোয়ার হাসপাতালে পৌঁছায় তারা । অয়ন আই.সি.ইউতে থাকা বাসির মামাকে দেখতে কাঁচের জানালার পাশে দাঁড়ায় । ডাক্তার আগেই বলে দিয়েছিল অবস্থা সিরিয়াস । হার্টের অপারেশনের পর রোগী বাঁচতেও পারে নাও বাঁচতে পারে ।
রিস্ক আছে । কাল জানিয়েছ রোগীর হার্টরেট কমছে ৷ মানে আস্তে আস্তে করে মারা যাচ্ছা মামা । কি ভয়ংকর একটা অবস্থা !
অয়ন লক্ষ করে মামার মুখে অক্সিজেন মাউস লাগানো, কতগুলো নল বুকে, পিঠে লাগানো । আর দেখতে পারে না সে ৷ আই. সি.ইউর সামনে বসানো সারি সারি চেয়ারের শেষের একটাতে বসে অয়ন ।
চেয়ারে বসে কতক্ষণ ফেইসবুকিং করে ।
হেডফোনটা কানে গুঁজে পিঠ এলিয়ে দেয় । এসির বাতাসে তন্দ্রা এসে যায় তার ।
অয়ন দেখে — সে ছোট মামির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে । বাসির মামা স্বভাবসুলভ একগাল হেসে বলছে– এতদিন পরে আসলেন বারে ? তোমার বাড়িত সবাই ভাল ছে ত না । তোমার আব্বা আম্মার কি খবর ? মামার কন্ঠস্বর মিউট হয়ে যায় ।
মামার পিছনে গাড় নীল শাড়ি পড়া কে যেন মৃদু পা’য়ে হেঁটে আসে । কেমন মোহনীয় পরাবস্তব আবয়ব মেয়েটার । অনেকটা ছোট মামির মত দেখতে । কেমন চেনা চেনা মনে হয় । মাথাটা যেন হাজার মন ভারি ।
হঠাৎ আর্তনাদ শুনে তন্দ্রা ভাঙে অয়নের ।
এইটুক ঝিমুনিতেই যেন কতবছর কাটিয়ে আসে অয়ন । অদ্ভুত । এফ এমে এখনো ঐ গানটা বাজছে—
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর ।,,
এদিকে ছোট মামির কান্নার গমক বাড়তে থাকে । স্ট্রেচার কাপড় আবৃত কার লাশ নিয়ে যাচ্ছে নার্সরা ?
কেমন যেন একা একা লাগছে অয়নের ।
হে শূন্য মন্দির মোর ।