টিপটিপ করে টিনের চালে কত শত বৃষ্টির ফোটা আছড়ে পড়ছে। নিচে পাত্র রাখা! একেকফোঁটা বৃষ্টিতে পূর্ন হবে পাত্র। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, এ যেন আমার শৈশব! এ যেন আমার ছেলেবেলা, আমার বেড়ে ওঠা! বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন মন ভোলানো সব গানের কালজয়ী সব শব্দ! ছেলেবেলায় বৃষ্টি ছিল প্রিয়তম ঋতু! কালবৈশাখী ঝড়ে যখন সবাই অবরুদ্ধ তখন আম কুঁড়াতে গিয়ে আমার দস্যিপনা! বৃষ্টি মানেই মাঠে ফুটবল নিয়ে ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি! দুই গোলকিপার বাদে বাকি সবার জায়গা ওই বহুল আকাঙ্খিত বলের কাছে! যে যেভাবে পারে লাথি দেয়! একবার কাঁদায় পড়ে গেলেই হলো, ব্যাস! মিনিট পাঁচেক ওখানেই চলবে যুদ্ধ, এই যুদ্ধ একটিবারের জন্য বল কেড়ে নেওয়ার, একটিবারের জন্য বলে পা ছোঁয়ানোর! এই ফুটবল কিন্তু বাইরের কোনো নিয়ম মেনে হয় না, এই ফুটবলেরও নিজেস্বতা আছে। এখানে তিন কাঠির পোস্ট থাকে না, পা মেপে কখনো জুতো দিয়া গোলপোস্ট তৈরি করা হয়, কখনও বা থাকে ইট! খেলোয়াড় কম হলে আবার দুটো ইটের বদলে হয়ে যায় একটা ইট, সেই ইটকে খাড়া করিয়ে রেখে চলে ছুটোছুটি, একবার ইটে বল ছোয়াতে পারলেই শোনা যায় চিৎকার, “গোল! গোল!” অন্যদিকে শোনা যায় প্রতিপক্ষের নানান অজুহাত, যেভাবেই হোক গোলকে বানচাল করতেই হবে! কখনো কখনো তারা সফল হয়, কখনো হয় না। এখানে থাকেনা কোনো প্লেয়ার লিমিট, কোনোদিন প্রতি দলে থাকে পনেরজন করে, কোনোদিন পাঁচজন। থাকে না কোনো সময়সীমা, যতক্ষন বৃষ্টি চলবে খেলাও চলবে!
সেই ছেলেবেলার স্কুলবিল্ডিং! সারাবছর ধরে অপেক্ষা গরমের ছুটির কিংবা কোনো সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টিধারার! স্কুল ফাঁকি দিয়ে খোলা আকাশের নিচে লাগামছাড়া দৌড়, কিংবা কার গাছের আম বড়, কার গাছের পেয়ারা মিষ্টি এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা। সারাদিনের অপেক্ষা সন্ধ্যায় এক মুহূর্তের লোডশেডিংয়ের।ছেলেবেলায় রোজ স্কুলে টিফিনের জন্য পেতাম পাঁচ টাকা, কোনোদিন একটু বেশি পেতাম, কোনোদিন একেবারে পেতামই না। সেই পাঁচ টাকা দিয়েই রোজ হাজার হাজার স্বপ্ন কিনতাম। বাচ্চুর দোকানের দুইটাকার বিরিয়ানি চানাচুর কিংবা রিয়াজ ভাইয়ের কাছে পাঁচ টাকার খিচুরী! এসবেই পেতাম অমৃতের স্বাদ! ছেলেবেলার অপেক্ষা ছিল আসরের আজানের। আসরের আজান আমাকে লাইসেন্স দিত বাসা থেকে বের হবার। শুক্রবার আর অন্য কোনো ছুটিতে সেই সময় ছিল সকাল দশটা। মাঝেমধ্যে মায়ের ঘুমের সুযোগে বের হয়ে যেতাম আসরের আজানের আগেই। সেই আলতো করে দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে। ক্যারামের সময় একটা গুটি বোর্ড থেকে পকেটে ফেলা কিন্তু প্রতিপক্ষের গুটি পকেট থেকে উঠিয়ে বোর্ডে রাখা ছিল আমাদের বা-হাতের খেল!
পুরো শীত-গ্রীষ্ম জুড়ে চলত আমাদের ক্রিকেট খেলা। কখনো সাজিদদের বাসার সামনের রাস্তায় দেয়ালে ইট দিয়ে স্ট্যাম্প একে কখনওবা শুভ্রদের উঠোনে ইটের উপর ইট গেঁথে! বিশ টাকার এরোপ্লেন বল আর বারো টাকার ওসাকা টেপের কম্বিনেশনে চলত খেলা। টেপ পেঁচিয়ে মাঝখানে দেয়া হতো বিট, মাঝেমধ্যে এই বিট হতো অন্য কালারের টেপ দিয়ে। দেয়ালে উড়ে লাগলে ছয়, গড়িয়ে পড়লে চার আর বাইরে গেলে আউট ছিল সাধারণ নিয়ম। এখানে মানা হতো না আইসিসির কোনো নিয়ম, যেন আমরাই আইসিসি! প্রথম বলে আউট হলেই সেটা হতো টেস্ট বল! পিছনের দেওয়ালে উড়ে গেলে হতো স্নিক আউট। ডোবায় পড়া বল উঠাবে ব্যাটসম্যান! এগুলো ছিল সব কমন নিয়ম। ব্যাটিং দলের খেলোয়াড় থাকবে আম্পায়ার, ব্যাটিং দলের রান চুরি ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। যার ব্যাট সে শুরুতে আউট হয়ে গেলেই বাধত বিপত্তি! খেলা চালু রাখতে তাকে আবার ব্যাটিং দিতে হতো!
আহা,আহা!
আমার শৈশব, আমার ছেলেবেলা,আমার বেড়ে ওঠা! আমার ভালো লাগা, আমার ছুটোছুটি করা দুপুর-বিকেল। আমার হারিয়ে যাওয়ার অন্য নেশা, আমার অদ্ভূত আনন্দময় সেই সব প্রহর! “আহা, আহা!” সময়ের পরিবর্তনে মানুষ তাঁর খোলস পাল্টায়। চলে নতুন রঙে জীবনকে ঢেলে সাজানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এর নামই বোধহয় জীবন, বাস্তবিক জীবন। যে জীবনে বাস্তবতা কেড়ে নেয় মুঠোভরা অনেক স্বপ্ন। প্রচন্ড ভালো লাগার কাজগুলো হঠাৎ করে যেদিন ছেলেমানুষী মনে হয়েছিল সেদিন ছিল আমার শৈশবের বিদায়। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল বিচ্ছিন্ন আবেগ নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে আনার প্রচেষ্টা। সেদিনই ছিল কৈশোরের শুরু, আমার প্রচন্ড ভালোলাগার ছেলেবেলার বিদায়। স্কুল পালিয়ে শেষবার যেদিন বন্ধুরা মিলে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলেছিলাম সেদিনও জানতাম না শৈশব আমাকে চিরবিদায় জানাচ্ছে। সেদিনও আমার শৈশব আমার সাথেই ছিল। শুধু মাঠ দিয়ে বের হয়ে আমি বাসায় চলে গেলাম, আর আমার সেই শৈশব একা একা বৃষ্টিতে ভিজতেছিল। শৈশবকে চিরতরে ফেলে রেখে এসেও মাঝেমধ্যে শিশুর মত আহ্লাদ করে বোঝাতে চাই- আমার শৈশব এখনো বিরাজমান! এখনো যখনই মাঠের পাশের ওই রাস্তা দিয়ে হেটে যাই, আমার শৈশবকে একা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, এ যে আমার শৈশব, একান্তই আমার শৈশব!
তথাকথিত ব্যস্ততার ভিড়ে সবকিছুই যেন এখন স্মৃতির অ্যালবাম । আর আমাদের স্মৃতিরা যখন অজান্তেই হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকে, আনমনে কেমন জানি চোখ ভিজে আসে। কেউ যদি ডাকপিয়ন হয়ে বিলি করে যেত শৈশবের চিঠি। ইশ! আরেকবার যদি ফিরে পেতাম আমার শৈশব, আমার ছেলেবেলা! হ্যাঁ আমার শৈশব!