ছোটগল্প – শ্যাওড়া গাছের বেদনা

ছোটগল্প - শ্যাওড়া গাছের বেদনা

আশিক মাহমুদ রিয়াদ

মধ্যদুপুরে উঠানের শ্যাওলা পড়া গাছটার বাদাম দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চোখে মুখে ঘুমের আবির্ভাব। বার বার হাই তুলতে হচ্ছে। হাত থেকে মাছের গন্ধ আসছে। দুপুরে ট্যাঙরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছি, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরেও গন্ধ যায়নি।খাবারের টেবিলে আরো আয়োজন ছিলো-ঢেঁকি শাক, আমড়া ভর্তা,কলা ভর্তা,থানকুনি পাতার ভর্তা। শুধু মাছটা না থাকলে আজকে নিরামিষ মধাহ্ন ভোঁজ চালিয়ে নেয়া যেতো

ইলেক্ট্রিসিটি নেই বলে দোতালার বারান্দায় এসে বসেছি। মাথার চুল শুকায়নি। ছপছপে হয়ে আছে। মা গতকাল চুলে নাড়িকেল তেল দিয়ে দিয়েছে। সারারাত মাথা ভার হয়ে ছিলো। কেমন বিতৃষ্ণা শরীর জুড়ে৷অসহ্য ভ্যাপসা গরম!

চোখ বুজে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম ইজি চেয়ারটাতে। হঠাৎ করে চোখ দুটো আপনা আপনি খুলে গেলো। সামনের পেয়ার গাছে দেখলাম ছোট্ট এক কিশোর মুখে পেয়ার গুজে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

গলা উঁচিয়ে বললাম-কে রে ওখানে? ছেলেটির মুখে পেয়ার বলে কিছু বললো না।মুখ থেকে পেয়ারাটি সরিয়ে নিয়ে বলল,’দাদাবাবু আমি বিতু। ‘
আমি গলা ভার করে বললাম,’ওখানে কি করছিস রে? ‘ বিতু থতমত খেয়ে বলল,’আপনার জন্য পেয়ারা পারছি দাদাবাবু। মাসিমা বলেছেন পেয়ারা পাড়তে। ‘
আমি উপদেশের সুরে বললাম,’এই ভরদুপুরে বেলায় গাছে চড়তে হবে না, নেমে আয়। ‘

বিতু গাছ থেকে নেমে এক দৌড়ে আমার কাছে এসে পড়লো। সে পেয়ারা গুলো ধুয়ে এনেছে আমার জন্য। আমি বিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম- কোন ক্লাসে পড়ে।

বিতুর সাথে ক্ষানিক কথা হওয়ার পরে আমি আবার চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলাম ইজি চেয়ারে।

২.
বিকেল বেলায় গায়ের পথে হাটছি। আমার সঙ্গে হাটছে বিতু।বিতু বিড়বিড় করে কি যেন বলছে আর থেমে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম আমার সাথে এনে বোধয় বেচারাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি।
বিতুকে জিজ্ঞেস করলাম,’এই বিতু! এরকম কি করছিস?’
বিতু বলল,’খেলছি দাদাবাবু! ‘ এই খেলার নাম- ছুপছাপ খেলা।” আপনি খেলবেন দাদাবাবু?
আমি বললাম,’এই খেলার তো কখনো নামই শুনিনি। এ আবার কেমন খেলা?’
বিতু তার খেলার বিবারণ দিলো-
দম বন্ধ করে খানিক হাটতে হবে। দম ছেড়ে দিলে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে মাথায় যে সংখ্যাটি আসবে সেই সংখ্যা অনুযায়ী সে ক’টা লাফ দিতে হবে দম বন্ধ করে। কিন্তু এই সংখ্যা হতে হবে- শূন্য থেকে নয়ের ভেতরে৷

আমি ক্ষানিক তাকিয়ে রইলাম বিতুর দিকে। বেশ বুদ্ধিমান ছেলে।

বিতুর বাবা নেই। বিতুর মা আমাদের বাড়িতে কাজ করে। বিতুরা থাকে আমাদের বাড়ির পেছনের একটি কাঠের ঘরে। বিতুর বাবা মারা যায় বিতুর বয়স তখন পাঁচ বছর। বিতুর বাবা একটি স-মিল এ কাজ করতেন। একদিন গাছ কাঁটতে গিয়ে গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় বিতুর বাবা।

৩.
বিতু ক্লাস সেভেনে পড়ে। দারুণ চটপটে আর দুরন্তপনায় ভরপুর ছেলেটি।ওর মায়ের কাছে শুনেছি ও লেখাপড়ায় ভালো। তবে দারুণ ফাঁকিবাজ। স্কুল পালায়। এ বয়সে ছেলেরা স্কুল পালাবেই। স্কুল না পালালে পরবর্তী জীবনে গল্প করার মতো কোন বিষয় পাওয়া যাবে না। স্কুল পালানো আহামরি ব্যাপার নয়। তবে ভাবনার বিষয় হচ্ছে পুরো ক্লাসের সব শিক্ষার্থী সহ স্কুল পালানো বিষয়টি। এই কাজ করেছে বিতু।

বিতু আমাকে এসে এই গল্প শুনিয়েছে। সেদিন নাকি স্কুল হাফছুটি হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। ফোর্থ পিরিয়ডে শেষ দুয়েকমিনিট। স্যার পড়া শেষ করার আগেই সবাই বই ব্যাগে গুজে বসে আছে। সবার চোখেমুখে আনন্দ। বিজ্ঞানের সতীশ স্যার কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। ঘন্টা পড়লো। সবাই কান পেতে শুনলো। বেঞ্চ থেকে ধড়মড়িয়ে ওঠার শব্দ। তিনটে ঘন্টা পড়তেই সবাই ছুটলো। সতীশ স্যার আগে বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হতে না হতেই দেখলেন ছাত্ররা সবাই ছুটছে। ক্লাস সেভেনের এ কর্মকান্ড দেখে বাকি ক্লাসের ছেলেপেলেরাও ক্লাস থেকে বেড়িয়ে দৌড়। হেড মাস্টার তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে হকচকিয়ে দেখলেন। এদিকে ঘন্টা পিটানো দপ্তরির চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। এই বুঝি গেল তার চাকরী।

সবাইকে যখন পাকড়াও করার চেষ্টা চলছে ততক্ষণে সবাই মাঠ ছেড়ে রাস্তায় চলে গিয়েছে। হেডস্যার এমন অবস্থা দেখেই ছুটিই দিয়ে দিলেন৷

বিতু আমাকে এই ঘটনা শোনানোর পরে আমি হো হো করে হাসলাম।

৪.
আমার হলে ফেরার সময় হয়ে এলো। বিতু বেশ কয়েকদিন আমার ধারে কাছে ফিরলো না। ওকে খু্ঁজে পেলাম না। সেদিন শুক্রবার সকালে ওর মা আমাদের বাসায় থালাবাসন পরিস্কার করছে। বিতু ওর মায়ের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করছে।

বিতুর মা বিতুকে ধমক দিচ্ছে। আমি বারান্দা থেকে শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ করে গ্লাস ভাঙার আওয়াজ। আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম। বারান্দা থেকে দেখলেম বিতু দৌড়ে পালাচ্ছে। মা বিতুর মাকে ধমক দিচ্ছে। বিতুর মা কান্নাকাটি করে বলছে- ছেলেটা হয়েছে এক বেয়াড়া! আমার কাছে সাইকেল চায়। আমি সাইকেল দেবো কোত্থুকে? একটা সাইকেল কিনতে তো অনেক পয়সা । ওর বাপটা মারা গেল অকালে। আমার কাছে দিয়ে গেল বোঝা। এই বোঝার ভার আমি সইতে পারবো। বিতুর মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমারো মন খারাপ হয়ে গেল কেমন যেন।

আজ ফিরে যাব শহরে। সকাল থেকে মা তোড় জোড় করছেন। নাড়িকেলের মোয়া, আচাড় আরো কত পদের খাবার যেন ব্যাগা ঢুকিয়েছেন। বাড়ি থেকে নামলাম খেয়া ঘাটের উদ্দ্যেশ্যে। বিতুর গলা শুনতে পেলাম। বিতুর মা বিতুকে মারছে। বেচারা হাউ মাউ করে কাঁদছে। আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা গলা উঁচিয়ে বলল-আহ! ছেলেটাকে অমন মারছো কেন, খুকু? অমন মারলে তো বেয়ারা হয়ে যাবে।

বিতুর মা কাঁদতে কাঁদতে বলছে- এমনিও তো বেয়ারা হয়ে আছে।আপদ জুটেছে আমার কপালে।

বাবা বিতুকে ধমক দিলেন। বিতু লাল চোখে তাকালো আমার দিকে। আমি বিতুর মাথায় হাত রেখে বললাম- যাই বিতু! আবার আসলে তোর জন্য উপহার নিয়ে আসব।

খেয়া ঘাটে বাবা আমাকে হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছেন। ততক্ষণে নৌকা ঘাট ছেড়ে হাত পাঁচেক দূরে সরে গিয়েছে। ততক্ষণাত আমাদের বাগানের মালি হরিকাকু ছুটে এলেন। সে দৌড়ে এসে বাবাকে বলল- “কর্তাবাবু! আমাদের সুরেশের ছাওয়ালডা গলা ফাস দিয়েছে। ” নৌকা তখন হাত দশেক দূরে। আমি হকচকিয়ে উঠলাম। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মাঝিকে বললাম, নৌকা ঘাটে নিয়ে যেতে।

ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে দেখলাম শ্যাওড়া গাছে ঝুলে আছে বিতুর নিথর দেহ। আমি ভেবে পেলাম না কি করবো। মাটিতে বসে পড়লাম। মাথা চক্কর দিলো।মানুষের কতটুক অভিমান হলে মানুষ আত্মহুতি দেয়?
আমার গাল বেয়ে জল গড়ালো!
আমি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলাম বিতুর ঝুলন্ত দেহের দিকে।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram

বিজ্ঞাপনে তোমায় দেখি

অমিত মজুমদার বিজ্ঞাপনে তোমায় দেখি নদীর থেকেও চতুর। দ্বিমত ছিলো তোমার জন্য কখন হবো ফতুর। রাজনীতিতে আমজনতার বাজেট কমে এলে মনের মতো ঝালাই করো লুডোর ...
ভিন্টেজ রেডিও

ভিন্টেজ রেডিও

আশিক মাহমুদ রিয়াদ গলির মাথায় তিনতলা বাড়ি! আকাশ থেকে নেমে আসা মেঘের ফালি। শহরের রাস্তাগুলোতে অন্ধকার কান্না করতে পারে না। ভেজা রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের আলোয় ...
অণুগল্প- হাত / অমিতা মজুমদার 

অণুগল্প- হাত / অমিতা মজুমদার 

  । অমিতা মজুমদার    বিলটু আর বলাই  ছুটির  দিনের  ভরদুপুরে ব্যতিব্যস্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পথে করিম মোল্লার সাথে দেখা,জানতে চাইলেন কোথায় যাচ্ছে। বিলটুর সরল উত্তর ...
মধ্যপ্রাচ্যের গল্প

মধ্যপ্রাচ্যের গল্প

রেজাউল ইসলাম হাসু   আমি যে ঘরে থাকি সেখানে কোনো দরজা নেই, জানালা নেই। আপনার ঘরের দরজা, জানালাগুলো আমার অনেকদিন মনে থাকবে। বিশ্বাস করেন, এভাবে ...
ঈদুল আজহার দুটি ছড়া 

ঈদুল আজহার দুটি ছড়া 

ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান  কোরবানি দাও মনের পশু কোরবানি দাও ভালো কথা একটু দেখো ভেবে মোটা তাজা কিনবে পশু কিসের টাকা জেবে? ঘুষের টাকায় পশু কিনে ...
দাম্পত্য জীবন

দাম্পত্য জীবন

জোবায়ের রাজু শিখার আজ বাসর রাত। সে চুপচাপ বাসর ঘরে বসে আছে। এখন রাত প্রায় বারটা। তার বর বাদল বারান্দায় কার সাথে যেন লম্বা আলাপ ...