প্রেমের গল্প – রুদ্র মোস্তফা
কাঠ-কয়লা পোড়া সময় । উঠোন ভিজছে বৃহন্নলা বৃষ্টিতে । প্রবল বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন আর বাস্তবতা । বৃষ্টি থেমে যাবে । তখন শুরু হবে দীর্ঘ এক অমাবস্যা। নিভে যাওয়া নক্ষত্রের তলে তিলোত্তমাকে সংকুচিত হতে হবে, অথবা অসংখ্য অন্ধকারকে সাথে করে ছাড়তে হবে এ সংসার । তের বছরের সংসার একেবারে কম সময় নয় । তিলোত্তমা কখনো ভাবেনি আনিস এমনটা করবে। মা-বাবা,শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই বিষয়টি নিয়ে বসেছিলো। সব ঠিকঠাক ছিলো । কিন্তু আনিস যে এমনটি করবে তা কি তিলোত্তমা জানতো ?
স্বপ্ন তিলোত্তমা দেখেনি। তবু স্বপ্ন পেয়েছিলো রক্ত-মাংসের শরীর । সে স্বপ্ন এখন জর্জরিত সর্পগ্রাহকের বাক্সবন্দি বাসনায়।
তিলোত্তমা ওর পিতৃ প্রদত্ত নাম নয় । ওটা আনিসের দেয়া নাম। মা-বাবার দেয়া নাম বীণা । বিয়ের ক বছরের মাথায় নামটি বিলীন হয়ে গেছে । তিলোত্তমার বিয়ে হয় তের বছর বয়সে । ও তখন ক্লাস সেভেনে পড়তো । মজার ব্যাপার হচ্ছে ওর রোলও ছিলো তখন তেরো ।
ওর বিয়ের আগে ওদের বাড়িতে এসেছিলো এক সাপুড়ে । সাপের খেলা দেখিয়েছিলো । যাবার আগে ওর মাকে বলেছিলো তের সংখ্যা থিকে আপনার মেয়েরে সাবধানে রাইখেন। ওর জীবনে তের অশুভ সংখ্যা।
ওর মাথায় হাত রেখে সাপুড়ে বলেছিলো, মাগো আন্ধার রাইখা জীবন চলে না। তয় আন্ধারের ভেতরও আন্ধার থাকে । সে আন্ধার বড় রহস্যময় । জীবন জুড়েই সে আন্ধারের খেলা চলে । বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়া সে আন্ধাররে কাটাইতে হয় । তেরো সংখ্যা থিকা সাবধান থাইকো ।
সাবধান-অসাবধান হওয়ার জন্য একটা পরিষ্কার ধারণা থাকতে হয় । সে ধারণা ওদের কারোও ছিলো না । থাকার কথাও নয় ।
তের বছর বয়সে ভালো ঘর থেকে ওর বিয়ের প্রস্তাব আসে । অনেকেই তখন বলেছিলো এমন চমৎকার একটা মেয়ে! এত অল্প বয়েসে বিয়ে দিবেন ? বিয়ের ও কী বোঝে ? বীণার কিন্তু তখন মনে মনে প্রচণ্ড রাগ হতো । বলতে ইচ্ছে করতো আমি সব বুঝি । কিন্তু বলা হয়ে উঠতো না। কেউ কিছু বলে দেয়নি তবু বিয়ে নিয়ে ওর নিজস্ব একটা ভাবনা ছিলো । ওর কাছে বিয়ে মানে হচ্ছে কোল জুড়ে ফুটফুটে একটা বাচ্চা । শরীর জুড়ে অন্যরকম এক অনুভূতি । যে অনুভূতির স্বাদ ওকে দিয়েছিলো পাশের বাড়ির হারু কাকা। ও হারু কাকার বাড়িতে টিভি দেখতে যেতো । টিভি দেখার খুব নেশা ছিলো ওর । একা পেলে হারু কাকা প্রায় ওকে জাপটে ধরতো । অন্যরকম এক অনুভূতি হতো । হারু কাকা কলেজে পড়তো । মুখচোরা স্বভাবের মানুষ । সেই কি না এমন করতো ! মাঝে মাঝে মনে হতো মাকে ও সব বলে দিবে । কিন্তু কেন জানি বলতে পারেনি । এসব বলতে নেই । এসব বলার বিষয় নয় । বলে কী হবে ? শুধু শুধু কলঙ্ক হবে আর হবে টিভি দেখা বন্ধ । মাঝে মাঝে ওর মনে হতো হারু কাকা ওর বর হলে মন্দ হয় না । দুঃসম্পর্কের চাচা । এ রকম কত সম্পর্ক তো হয়-ই ।
স্বপ্নটা বেশি দূর এগোয়নি । আনোয়ারের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায় । বিয়ের দিন ও এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি । তখন মনে হয়েছিলো কেন যে মেয়েরা কাঁদে! দিনটি কেটেছিলো স্বপ্ন আর হুল্লোড়ে।
তারপর এলো রাত। ওর বরের বয়স ছিলো ত্রিশ । ওর তেরো । অসম সম্পর্কের শয্যায় ও কিন্তু বেশ এক্সাইটেড ছিলো । হারু কাকার শিহরণ স্বপ্ন হয়ে চুয়ে পড়ছিলো ওর বরের শরীর থেকে । ফুলতোলা বিছানায় যতটুকু সম্ভব ও নিজেকে ফুল করে তুলতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফুলের পরিণতির কোন অভিজ্ঞতাই ওর ছিলো না। তাই স্বপ্ন আর শিহরণ বিদ্ধ হয়েছিলো পৌরুষ-দণ্ডে । সেটা ছিলো বীণার জীবনের ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা। দুর্বিষহ এক চন্দ্রগ্রস্ত রাত। রাতভর জরায়ু জুড়ে জন্মেছে রক্তজবা। বীণার মনে সে রাতে জন্মেছিলো গভীর ঘৃণা । স্বামীর উপর নয় । হারু কাকার উপর । রক্তিম বিছানায় মুছে গিয়েছিলো বীণার স্বপ্ন-শিহরণ-চন্দ্রমল্লিকার রাত।
বীণার বর দেশে ছিলো তিন মাস তের দিন । অবশ্য ও আরো কিছু দিন থাকতে চেয়েছিলো । বীণা থাকতে দেয়নি। বীণার চিৎকারে ভারী হয়ে উঠতো রাতের পরিবেশ। অবশ্য সে চিৎকারের শব্দ ঘর থেকে বের হতো না। বীণার চোখের জলের কোন মূল্য ছিলো না আনোয়ারের কাছে । বরং সে খুশিই হতো । কেন সে খুশি হতো বীণা তা বুঝতে পারতো না। বীণা শুনেছিলো আনোয়ার যেন কাকে বলছে , আরে না না …বৌ আমার ইনটেক । প্রতি রাতেই কান্নাকাটি করে । বিয়ের দিন বীণা কাঁদেনি । সে অনুশোচনায় অনেক রাত সে কেঁদেছে ।
আনোয়ার চলে যাওয়ার পরপরই বীণা বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে । বীণা কিন্তু আনন্দিত হতে পারেনি । কেমন এক অজানা ভয় তাকে ঘিরে ধরেছিলো । মনে হতো বাচ্চা হতে গিয়ে ও মারা যাবে । আনিস তখন ওকে অনেক সাহস দিতো । আনিস ওর দেবর । বীণার থেকে সাত বছরের বড় । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো । নানাভাবে সে বীণাকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করতো । তবু বীণার ভয় যেন কাটতো না। বীণার সে বাচ্চা টিকেনি। তের দিনের মাথায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় । বাচ্চা মারা যাওয়ার পর ভয়ংকর এক বিষণ্ণতা বীণাকে গ্রাস করেছিলো । তীব্র দুঃসময়ে ভিন্ন সমীকরণ নিয়ে আনিস ওর সামনে দাঁড়ায় । হাতে বিষের কৌটো আর ঠোঁটে চন্দ্রমল্লিকা রেখে বলেছিলো, প্রেম আর মরণ দুটোই তোমার সামনে । বলো, তুমি কী চাও ? তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না।
বীণা জানতো এটা প্রেম নয় ,সম্ভোগের কৌশল । তবু এক অজানা শক্তির দুর্বীনিত মোহে আনিসকে বাধা দিতে পারছিলোনা। নিয়ন্ত্রণ হীন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, না তোমার মরণ আমি চাইনা। আনিস তখন বাড়িয়ে দিয়েছিলো তার হাত । তবে এসো রাত্রি চষে ফলিয়ে তুলি চন্দ্রমল্লিকা। জানতো, ‘সবচেয়ে নক্ষত্র-ঘাস-চন্দ্রমল্লিকার রাত ভাল ।’ আজ থেকে তুমি বীণা নও । তুমি আমার তিলোত্তমা। এর পর বীণা হারিয়ে যায় তিলোত্তমায় । আর তিলোত্তমার যাপিত জীবন জুড়ে রচিত হয় পতিতার সুখ আর সতীত্বের বহু বর্ণিল মানচিত্র । তবু সে মানচিত্র স্থির থাকেনি। কারণ সময় এবং ভালোবাসার ভূগোল দ্রাঘিমা-অক্ষাংশের সূত্র মানে না।
আনোয়ার প্রায় দেশে ফিরতে চাইতো । বীণা বলতো আর ক’টা বছর থেকে আসো । এসে আবার যাবে সেটা হবে না । দেশে আসলে আর যাতে যেতে না হয় সেভাবেই থেকে আসো । আট বছরের মাথায় আনোয়ার দেশে ফিরলো । তিলোত্তমা আর বীণা অস্তিত্বের কুঠুরিতে জড়িয়ে পড়লো মল্লযুদ্ধে ।
আনোয়ার ছ মাস দেশে ছিলো । আনিস তখন অন্য মানুষ । আনোয়ার চলে গেলে ওরা প্রবেশ করে ওদের নিজস্ব কুঠুরিতে । সেখানেই ফলিয়ে তুলে ওদের কাঙ্ক্ষিত ফসল । ওদের ছেলেটা দেখতে হুবহু আনিসের মতো হয় ।
এরপর আরো কিছু সময় কাটে । তখন শুরু হয় অন্য এক হিসেব । পরিবার থেকে আনিসের বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হয় । আনোয়ার জানায় সে একেবারে দেশে ফিরবে । আনিস বীণাকে বলে তুমি আনোয়ারকে মেনে নাও । তুমি তিলোত্তমা হয়ে সারা জীবন আমার হৃদয়েই থাকবে । কিন্তু সমাজকে অস্বীকার করে আমাকে তুমি চেনা।
বীণা আনিসের প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি । প্রেম-বিদ্বেষ-ঘৃণা অথবা সততায় সে আনোয়ারকে সব খুলে বলে । তারপর সে অপেক্ষা করে মহাপ্লাবনে ডুবে যাওয়ার জন্য ।
এই ভয়ংকর সত্যটি আনোয়ারের পক্ষে মেনে নেয়া সহজ হয় না। সে সুইসাইড করে । কাউকে কোন কারণ না জানিয়ে নীরবে চলে যায় সে । এর ঠিক চার মাস পর দু পরিবার উঠোনে বসে । তখন চলছে চৈত্রের তেরতম দিবস । দুই পরিবারের সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয় আনিসকে দিয়েই বীণাকে রেখে দেয়া হবে । বীণা ভেবেছিলো হয়তো কেউ আপত্তি তুলবে । কেউ আপত্তি তুললো না। বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটালো আনিস । সে বললো, বীণা আমার তিলোত্তমা ভাবী । এর বাইরে অন্য কিছু আমার পক্ষে ভাবা সম্ভব নয় ।