কবিতাপ্রথম পাতাসর্বশেষসাপ্তাহিক সংখ্যা

কাজল কৌটা

অর্না খান

সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।উঠানে আশেপাশের ছেলে-মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিঁজে লাফালাফি করে উঠান কাঁদায় মেখে ফেলেছে।রেশমা বারান্দার বসে আছে।বৃষ্টিতে পা ভিঁজে যাচ্ছে। বাচ্চাদের লাফালাফি, ছুটোছুটি দেখতে ভালো লাগে।নিজেকেও ওদের মতোই লাগে।অবশ্য রহিমা বানু টের পেলে এখনি তেড়ে এসে সব ভাগাবে।রেশমার শাশুড়ির বোধহয় এসব ভালো লাগেনা। তার শৈশব ছিল খুব করুণ। একবেলা খাবারের জন্য সবাই বসে থাকতো।খেলাধুলোর সময় কই? যার শৈশবে যা ছিল না সে তা বর্তমানে দেখেও মজা পায় না।

রেশমা হাতের ইশারায় ওদের কাছে ডাকল।সব বাচ্চাদের লাফালাফি বন্ধ হয়ে গেল।এখন সবাই তাঁকিয়ে আছে রেশমার দিকে।রেশমা আবারো ডাকল,

“এই দিকে আয় তোরা।”

সবাই কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল এরপর একছুটে বাড়ি ছাড়ল।কেবল একজন দৌড় লাগাতে গিয়েও আবার ফিরে এল গুটিগুটি পায়ে।

“ডাক দিলেই দৌড় পারোস ক্যান? মোয়া খাবি?”

ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে না করল।

“খাবিনা তো দাঁড়াইলি ক্যান?”

ছেলেটি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। হয়তো এমন কিছু সে আশা করেনি। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলল,

“আম্মায় কইছে আফনের কাছে না যাইতে।আফনের মাইয়া পোলা মইরা যায়,আফনে অপয়া।”

ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল। রেশমা তাকিয়েই রইল।যতদূর অবধি ছেলেটিকে দেখা যায় সে দেখতে লাগল।প্রথম প্রথম কেউ তাকে অপয়া বললে রেশমা কাঁদত। এখন গায়ে লাগেনা। পাঁচ বছরে তিনটা বাচ্চাই মরা জন্ম দিলে তাকে যে কেউ ভালো বলে না তা রেশমা জানে। তাও ওই ছেলের কথায় রেশমার মন খারাপ হলো।

রহিমা বানু একটা ঝাড়ু নিয়ে এসে উঠান ঝাড় দিতে লাগলেন।বৃষ্টি এখন নেই।উঠানে পানি জমেছে।ছোটছোট ওই ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বললেন,

“জানোয়ারের বাচ্চাগুলান আবার আইস বাড়ির ভিতরে।ঠ্যাং না ভাঙলে নাম পাল্ডামু আমি।”

এই কথা ছেলেগুলোর কানে গেল না তাও রহিমা বানু আরো কিছু গালি দিয়ে থামলেন। রেশমা তখনো বসা। রহিমা বানু বৌয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

“ঘরে যা রেশু।ঠান্ডা লাগাইতাছোস ক্যান? বাচ্চাডার ঠান্ডা লাগবো।জামা কাপড় পালডা যা।

“মা প্যাটের ভেতরে ব্যাথা করে।পানি লাগলে ভাল্লাগে।”

রেশমা হাসল মিটমিট। রহিমা বানু ঝাড়ু ফেলে এসে রেশমার পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“ভেতরে গিয়া নামাজ পড় যা।আল্লাহরে ডাক গিয়া।”

রেশমা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।পেটে হাত বুলিয়ে মনে মনে বলল,”আম্মারে একবার দেইখা যাইও সোনা। একনজর মায়রে দেইখা মইরো।” রেশমার চোখে পানি চিকচিক করছে। এই দুনিয়ার কোথাও শান্তির বাতাস নেই।

আজকের সারাদিনের বৃষ্টিতে কার কী ক্ষতি হলো রশিদ জানেনা। কিন্তু তার খুব লাভ হয়েছে।ফসলে এই সময় পানির খুব দরকার পড়ে।বাড়ি যেতে যেতে আজ রাত হবে।কাজ শেষ করে একবার মেলার দিকে যেতে হবে।মফিজ মাতবর রশিদকে দেখে দূর থেকেই ডাকল।ওনার স্বভাব হচ্ছে সবাইকে খোঁচা মেরে কথা বলা।রশিদের তেমন পছন্দ না।

“আরে রশিদ মিয়া কী খবর আছো কেমন?”

“আছি ভালাই মাতবর সাব।আপনে কেমন?”

“এইতো আছি তোমারে একটা খবর দিতে ডাকলাম।”

গামছায় মুখ মুছতে মুছতে রশিদ বলল,

“জ্বী কন”

স্বর নামিয়ে মাতবর বলল,

“হুনছো এইবার মেলায় জমজমাট ব্যবস্থা।মাইয়া মাইনসের ব্যবস্থা।”

কপালকুঁচকে রশিদ বলল,

“বাইত যান মাতবর সাব।এইসব কথা আমারে কইতে আসবেন না।গেলাম আসসালামু আলাইকুম।”

রশিদ জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলো। একদলা থুথু পায়ের কাছে ফেলে মাতবর বলল,

“ঘরের বউয়ে বছর বছর মরা ছাওয়াল দেয়,ব্যাটার আবার কত গলার জোর।”

কথাটি রশিদের কানে পৌঁছাল কি না বোঝা গেল না।রশিদ হেঁটে দূরে চলে গেছে।

হারিকেন ধরাতে ধরাতে রহিমা বানু নিম্নস্বরে কলেমা পড়তে লাগলেন। ঘরের মধ্যে রেশমা শুয়ে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই।রহিমা বানুর গুনগুন শব্দে বাড়ি রহস্যময় লাগল।

“আম্মা কই আপনি? আম্মা?”

রহিমা বানু হারিকেন হাতে রেশমার ঘরে এল।

“কও মা,ডর লাগে?”

“পেটে ব্যথা উঠতাছে আম্মা।দাইরে খবর দেন,আফনের পোলারে খবর দেওন দরকার আম্মা।”

রহিমা জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগল।রেশমা শব্দ করে কাঁদছে।

রশিদ মেলায় ঢুকলো সন্ধ্যার আরো পড়ে। রেশমার জন্য চুরি আর একটা শাড়ি কেনা দরকার।এক জোড়া লাল চুড়ি হাতে নিয়ে রশিদ মিটিমিটি হাসল।এসব কিনতে তার সরম লাগে,তাও রেশমার জন্য কিছু না নিলে রাগ করবে।রশিদ কেনাকাটা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।একটা কাজলের কৌটা তার গামছায় বাধা।কাজলের কথা তাকে কেউ বলেনি।তাও কিনেছে, এই কাজল তার সন্তানের জন্য।রশিদ গামছা দিয়ে মুখ মুছে তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করল।বৃষ্টি আসবে হয়ত,গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছেও।

রহিমা বানু বারান্দায় বসে কোরান শরিফ পড়ছে।ঘরের মধ্যে রেশমা জোরে জোরে কাঁদছে। তার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।পাশের গ্রামের দাই এসেছে। বাহিরে ঝড় শুরু হয়েছে।সবমিলিয়ে এক রহস্যময় শব্দ।রহিমা বানুর চোখে পানি।চোখের পানির কারণে কোরান শরিফের অক্ষর দেখা যাচ্ছেনা।

রেশমা শক্ত করে দাইয়ের হাত ধরে আছে।

“আমারে বাঁচান লাগবো মা,আমার ছাওয়াল বাঁচাও চাচি।আমি পায়ে ধরি তোমার।”

দাই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,

“সময় হইয়া আইছে।আল্লাহরে ডাক,আল্লাহরে ডাক।”

রশিদ বাড়িতে পা দেয়া মাত্রই নতুন সন্তানের কান্নার স্বর কানে আসে। রহিমা বানু চিৎকার করে কাঁদেন।

“ও রশিদ বাপ আইছোস? তোর ঘরে মানিক আইছে বাপ।তোর ঘরে মানিক আইছে।”

বৃষ্টিতে নতুন শাড়ি ভিঁজে চুপসে রঙ বেরোচ্ছে। কাচের চুড়ির কাগজও  ভিঁজে শেষ।

রশিদ শক্ত করে কাজলের কৌটা হাতে চেপে ধরেছে। খুব শক্ত করে।

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]