প্রথম পাতাসর্বশেষসাপ্তাহিক সংখ্যা

গল্প: অহর্নিশ

নাজিফা আক্তার শারিকা 

সকাল থেকেই মশলাপাতি বেটে তৈরী করেছেন রহিমা বেগম। সাথে তার ছোট মেয়ে তন্বীও সঙ্গ দিচ্ছিল। মতি মিয়াও ঘরেই আছেন। মতি মিয়া হলো তন্বীর হতভাগা বাবা। হঠাৎ করে তন্বী উঠে বাবার কাছে গেল। “আব্বা, ও আব্বা  তুমি গোশত আনতে যাবা না। আমার খিদা লাগছে অনেক। আইজ আমি গোশত দিয়া মজা কইরা ভাত খামু। “বিরহ মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল মতি মিয়া। আজ ঈদুল আযহা। মুসলমানদের ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হওয়ার দিন। এদিন মুসলিম জনগোষ্ঠী পশু জবেহ করে মহান আল্লাহর নিকট  নিজেকে নিবেদন করে। কিন্তু অভাব নামক বিশেষণ পিছনে থাকার কারনে ছোট্ট নিষ্পাপ মেয়ের আবদার পূরনে ব্যার্থ মতি মিয়া। তবুও সকল কষ্ট গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল মতি মিয়া।শার্টটা নিতে নিতে মেয়েকে বলল,”হ মা, যামু তো। এহনি যাইতাছি আমি। আমার মায় গোশত খাইব আর আমি না যাইয়া পারি।”এই বলে মেয়েকে চুমু খেয়ে বেরিয়ে পরল মতি মিয়া। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। কে জানে এখন কারও কাছে তার মতো অভাবীর জন্য গোশত আছে কিনা। যাই হোক প্রথমে গেল এলাকার স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হারুন সাহেবের বাড়ি। মস্ত বড় বাড়ি তার।অঢেল সম্পত্তি আর টাকাপয়সার মালিক। এবার চারটে গরু দিয়ে কুরবানী দিয়েছে। গেটের কাছে দাঁড়ালো মতি মিয়া। এই করোনাকালে বাড়ির ভিতর বাইরের মানুষের প্রবেশ নিষেধ। মতি মিয়া ডাকলো,”মনজু ভাই, ও মনজু ভাই। একটু এদিকে শোনো না।”মনজু এ বাড়ির কাজের লোক। মতি মিয়া বলল,ও মনজু ভাই বড় সাহেবরে একটু কবা আমারে কিছু গোশত দিতে।মাইয়াডায় সকাল থেকে গোশত খাইব বইলা বইয়া রইছে। “মনজু মিয়া ভিতরে চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। কিন্তু তার হাত খালি। মুহূর্তের মধ্যেই তার উজ্জ্বল চোখদুটো নিষ্প্রভ হয়ে গেল। মনজু মিয়া বলল,মতি ভাই, তুমি চইলা যাও। বড় সাহেব বলছে সে বাইরের মানুষগো গোশত দিতে পারব না। তার মধ্যে এই করোনা। বুঝলা মতি ভাই এ হইল বড়লোকের সম্পদের খেলা। বোঝার দায় কি আমাগো আছে! “মাথা নিচু করে ফিরে চলল মতি মিয়া। বুকে একরাশ কষ্ট আর পাথর দানা বেধেছে। যেন  বুকের ভিতরটা ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার ছোট্ট মা যে তার পথ চেয়ে বসে আছে। তার আবদার আজ যে রকম  করেই হোক পূরণ করতে হবে। এরপর আরও কয়েক জায়গায় গেল সে। কিন্তু সবখানেই একই দৃশ্য। তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। এই শেষ আশা। এবার গেল  খলিল সাহেবের বাড়ি। বাইরে দাড়িয়ে ডাক দিল,” খলিল সাহেব আমারে কিছু গোশত দিবেন। “খলিল সাহেব বলল, এখন আসছো তুমি গোশত নিতে। কে তোমার জন্য এখন গোশত রেখে  দিছে। ” এই বলে সে ভিতরে গেল আর একটা পলিথিনে কিছু গোশত নিয়ে আসল।খুশিতে আত্মহারা হয়ে ঘরে ফিরলো মতি মিয়া। পলিথিনটা নিয়ে রহিমার কাছে দিল। রহিমা খুলে দেখল এতে কয়েক টুকরা চর্বি ছাড়া আর কিছুই নাই। মতি মিয়া আর রহিমা দুজনের মনই পাষাণ ভার হয়ে উঠল। তাদের দু’জন কে দেখে হঠাৎ মনে হলো আকাশে কোনো চাঁদের আলো নেই, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে পুরো চাঁদটা!

মতি মিয়ার চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এরই নাম কি মানুষ? এরই নাম কি সম্পদশালী? কথায় তো বলে মানুষ মানুষের জন্য। এই কি সেই মনুষ্যত্বের প্রমান।

তাদের যখন এই অবস্থা তখন তন্বী এসে তার গাল দুটো মুছিয়ে দিয়ে বলল,”আব্বা তুমি কাইন্দো না। আমি গোশত খামু নাহ। তুমি আমারে পেয়াজ আর মরিচ দিয়া মাইখ্যা ভাত খাওয়াইয়া দাও। এতেই আমি গোশতোর স্বাদ পামু। “মেয়ের কথা শুনে মেয়েকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিলেন মতি মিয়া আর হু হু করে কাঁদতে লাগলেন।রহিমাকে বলল,ও রহিমা তুমি ভাত বাড়ো। আমি আমার তন্বী মারে ভাত খাওয়াইয়া দিমু। “রহিমা ভাত বেড়ে দিল। তিনজনই খেতে বসল। মতি মিয়া বলল,মারে তুই হইলি গিয়া অভাবী রাজ্যের রাজকন্যা। তুই বড় অভাবীর ঘরে জন্মাইছো। তোর বাবা তোর কোনো শখ মিটাইতে পারে  না। “তখন তন্বী বলল,আহ! আব্বা তুমি চুপ থাকো তো। আমাগোও একদিন টাকা হইব। অনেক টাকা! তখন আমরাও কোরবানি দিমু আর আমাগো মতো যারা আছে তাগো প্রান ভইরা খাওয়াবো। তুমি কষ্ট পাইয়ো না। আমি কইলাম। “মতি মিয়া গভীরে আবেগে মেয়ের মুখে ভাত তুলে দেয়।আর তার দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়ায়। এভাবেই শেষ হয় এক অভাবি পিতার দুঃখ গাঁথা, এক ছোট্ট মেয়ের নিষ্পাপ স্বপ্নের বুনন। সেই সাথে প্রতীয়মান হয়, সমাজের সম্পদশালী, ধনিকশ্রেণির ক্ষমতার দৌরাত্ম আর নিষ্ঠুর আচরন।

.
দুমকি, পটুয়াখালী। 

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]