আমি অশ্বত্থ বলছি
এই যে আমাকে দেখছো তোমরা আজ, কেমন জীর্ণ অসহায় বুড়োর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। এটা আমার একমাত্র রূপ নয়। তোমাদের মনুষ্য জীবনে তোমরা যেমন শৈশব – কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে উন্মত্ত হও, আমার জীবনেও তেমনি কাল আসে পালাক্রমে। আমি বৈশাখের খরতাপে পুড়ি, শ্রাবণের জলে শিরশির করে কাঁপি, মাঘের কামড়ে সব খুইয়ে ফেলে উলঙ্গ পড়ে থাকি। আমার ঝরে যাওয়া হলুদ পাতারা দেখো এখনো পড়ে আছে আমারই পায়ের কাছে। ওদের কিছু উড়ে যাবে দমকা বাতাসের সাথে। কিছু কুড়িয়ে নেবে পাতাকুড়ানির মেয়েগুলো এসে। কিছু পাতা খুব অভিমানী; ওরা নিজেরাই পায়ে হেঁটে ওপারের ওই পাকা রাস্তায় প্রাণ দেবে নির্মম চাকার তলে। আর এই যে দেখছো পাতাগুলো কালচে হয়ে গেছে: ওরা আসলে আবেগী-পত্র। একদিন সবুজ ছিল ওদের গায়ের রং, তারপর হলুদ হয়ে ঝরে পড়েছে মাটিতে। ওরা কোথাও যাবে না আমাকে ছেড়ে। আমার পায়ের তলার মাটির সাথে মিশে গিয়ে ওরা উর্বর করবে আমার বেঁচে থাকাকে।
আমি একটি অশ্বত্থ গাছ। আমার পূর্বপুরুষদের নানারকম অবদান মিশে আছে তোমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে। তাই আমাকে তোমরা কিছুটা অহংকারীও বলতে পারো। আমার ছোট্ট সবুজ পাতাগুলো আর তার নিচের সরু লেজ নাড়িয়ে আমি যখন ঝমঝম আওয়াজে চারপাশের সব্বাইকে পুলকিত করি তখন তোমরা আমাকে তোমাদের বন্ধু বলেই মনে করো, আমি জানি।
সেই কতোকাল আগে ভারতের বিহারে মহামানুষ গৌতম বুদ্ধ আমার পূর্ব পুরুষের তলায় বসে ধ্যান করার সময় বোধি (জ্ঞান) লাভ করেছিলেন। আমার পূর্বপুরুষের একটি গোত্র তাই বোধিবৃক্ষ নামে পরিচিত। বৌদ্ধ ধর্মের মতো হিন্দু ধর্মেও আমাদের বিশেষ অবস্থান রয়েছে। সাধু-সন্ন্যাসীরা পবিত্রস্থান মনে করে আমাদের চরণে বসে ধ্যান করেন।
আমি কিন্তু আমি বোধিবৃক্ষ নই। আমি একটি অশ্বত্থ। তোমরা আমার পেছনে বাচ্চাদের একটি স্কুল দেখতে পাচ্ছো, এই স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা টিফিনের সময় দৌড়ে সবার আগে আমার কাছে আসে। ওরা আমাকে পিপল নাম ডাকে। পিপল নামটি উচ্চারণ করতে সহজ ওদের জন্য। দু` চারটি বাচ্চা হুড়মুড় করে আমার গায়ে লাফিয়ে উঠে, যেন আমি ওদের দাদা ভাই হই। ওরা কেউ আমার পাতা কয়টি ছিড়ে নিয়ে শব্দ করে বাঁশি বাজায়। পাতার বাঁশিতে শব্দ তুলতে না পারলে অনেকে এমনিতেই দাঁত দিয়ে কাটে। একটি কথা বলি তোমাদের কানে কানে। ক্লাস ফাইভের ছোট্ট মেয়ে সুনয়নাকে চেনো তো, খুব অভাব ওদের সংসারে। সুনয়না প্রায়দিন খুব সকালে উঠে এসে শুকনো ডালা আর পাতা কুড়িয়ে নিয়ে যায়। আমার শুকনো ডালে আর পাতার আগুনে ওদের চুলোতে আলু সিদ্ধ হয়। তাই খেয়ে বেঁচে থাকে ওদের পরিবারের আটটি মানুষ।
বেচারি মেয়েটির জন্য আমার খুব মায়া হয় জানো। নিজের হাতে নিজেকে ছিড়তে পারলে ওকে আমি সাহায্য করতাম। কিন্তু আমি তো গাছ। তোমাদের মতো নিজেকে আমি অন্যের প্রয়োজনে নিজ হাতে খন্ড খন্ড করে ভেঙে দিতে পারি না। তাই আমি অপেক্ষায় থাকি। তোমরা নিজেরাই এসে ভেঙে নিয়ে যাও আমার হাত, নাক, কান, আমার আঙ্গুল, আমার …..
যদিও আমি বাচ্চাদের কথা বলছি অনেকক্ষণ ধরে, তাই বলে ভেবো না আমি বাচ্চাদের বয়সী। আমার কিন্তু অনেক বয়স। কত জানতে চাও? তা কম করে হলেও নয় শত কিংবা ছয় শত বছর তো হবোই। আশ্চর্য হয়ো না। আমাদের বংশে অন্যরা হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকে। আমার আদি পুরুষদের ভেতর সবচেয়ে বেশি দীর্ঘজীবী অশ্বত্থ গাছটি বর্তমানে শ্রীলংকার অনুরাধাপুরে রয়েছে। তার বয়স ২২৫০ বছরের বেশি।
আমাদের সম্পর্কে একটি মজার কথা বলি। আমার গাছে তোমরা ফল দেখলেও ফুল কিন্তু দেখতে পাবে না সহজে। কারণ আমার ফুল লুকিয়ে থাকে ফলের ভেতর। ফুলের ঔজ্জ্বল্য পাওনা না বলে আবার রাগ করোনি তো! ফুলের শোভন কান্তি না দেখালেও আমরা মানুষের অনেক উপকার করি। এই যেমন ধরো, মানুষের শরীরকে ছায়ায় আর বাতাসে জুড়িয়ে থাকি। আবার আমার ব্যবহার আছে তোমাদের চিকিৎসার প্রয়োজনেও। ডায়াবেটিস, ডায়রিয়া, মৃগীরোগ, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, প্রদাহজনক রোগ, সংক্রামক রোগ সহ প্রায় ৫০ ধরনের রোগের জন্য আমাকে তোমরা ব্যবহার করো। তোমাদের ভালোবাসায় ধন্য আমার অনেক সন্তানেরা বনসাই হয়ে তোমাদের ঘরে আভিজাত্যের শোভা বর্ধন করে যাচ্ছে দিনের পর দিন ধরে।
তোমরা মানুষ আর আমরা গাছ। আমরা একই পৃথিবীতে বসবাস করি। কিন্তু একটু ভেবে দেখো, তোমরা মানুষেরা পৃথিবীকে যেভাবে ব্যবহার করো আমরা গাছের ঠিক তার উল্টোটা করি। আমরা চেষ্টা করি পৃথিবীটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। আর তোমাদের ভেতর বেশিরভাগই কেবল ক্ষয় আর ধ্বংস করে যাচ্ছ দিনের পর দিন। তোমাদের পাপ আমরা নিজেদের সবুজ পাতায় ঢেকে রাখি যতটা সম্ভব। ভাবছো বানিয়ে বললাম? আমার পায়ের কাছে ডান দিকে লতাগুলোর নিচে দুই হাত মাটি খুঁড়ে দেখো। সুনয়না ঘুমিয়ে আছে ওখানে। গতকাল রাতে খারাপ ছেলেগুলো মেয়েটাকে মেরে খুব ভোরে এসে আমার কাছে জমা রেখে গিয়েছে। আমি যদি কথা বলতে পারতাম, আমি তোমাদেরকে সবগুলো খারাপ ছেলেদের নাম বলে দিতাম।
আচ্ছা, আমি আজ যাই। সুনয়নার জন্য আমার খুব মন খারাপ। আমার ঝরে পড়া হলুদ পাতারা আজ সারাদিন গুনগুনিয়ে কাঁদছে বাচ্চা মেয়েটির জন্য। আমি জানি তোমরা কোরোনাকে নিয়ে আতঙ্কে আছো খুব। কোরোনাও কিন্তু ভয় ঢোকাতে পারেনি ওই দুষ্ট মানুষগুলোর বুকে। এতো পাষান কেন হয় কিছু মানুষ! পৃথিবী জোড়া সব্বাই কেন গাছ হলো না আমার মতন। ঋতুতে ঋতুতে বদল হতো কিন্তু ক্ষতি করতোনা কোনদিন এই পৃথিবীর!