প্রথম পাতাপ্রবন্ধসর্বশেষ

দু’ বাংলার চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত

সুবীর মন্ডল

 

রবীন্দ্রপ্রতিভা মহাসমুদ্রের মতোতাঁর বিস্তার গভীরতা বিস্ময়কর আমার মতো অতি সাধারণ এক সাদামাটা রবীন্দ্রসাহিত্যানুরাগীর পক্ষে  সেই সৃষ্টি  আনন্দপারাপারের প্রতি লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় কি? কোনো একদিন হঠাৎ  মনে হয়েছিল ওই মহাসমুদ্রের কিছু স্বরকল্লোল যদি আহরণ করে নিই তবে কেমন হয়? সেই একান্ত অনুভব আকাঙ্ক্ষা থেকে এই নিবন্ধটির জন্মএকটাই উদ্দেশ্য রবীন্দ্রসংগীতের স্বস্তি শান্তিদায়ক এবং সুখকর আবহাওয়ায় প্রতিপালিত দুবাংলার সংগীতপ্রেমি বাঙালি বিশ্ববাসী যাতে   তাঁর চিরশাশ্বত, কালজয়ী    সঙ্গীতের  সঙ্গে সহজে একাত্ম হতে পারেন

 অনুভবে, অনুপ্রেরণায় আমাদের হৃদয়ের মানচিত্রে হিমালয়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন কবিগুরুমর্ত্য পৃথিবীতে তার কর্মকৃতিত্ব প্রশ্নাতীত শুধুই যদি গান লিখে যেতেন তাহলেও  তিনি অমরত্ব লাভ করতেন, এবিষয়ে কোন সন্দেহই নেই রবীন্দ্রনাথের গান, আমাদের প্রত্যেকের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জীবনের গান আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের উপলব্ধি গুলোকে যদি ভাষাকথা আর সুরের জাদুতে মূর্তিমন্ত করে তুলতে চাই, তার জন্য রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ,একা এবং অনন্য হয়ে আমাদের সুখের কথায়,শোকের ব্যথায়,উচ্ছল ক্ষণে ,উদাস মনেসমস্ত সময়েরই অনিবার্য একান্ত কাছের মানুষ তিনিই আমাদের গানের ভাষায়, প্রেমের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন যেনএক অমলিন চিরকালীন বন্ধন বেরিয়ে আসা আদোও সম্ভব  কোন দিন! উৎসবের অঙ্গনে,বিদায়ের বিচ্ছেদে,আহ্বানের  আনন্দেসর্বময়,সর্বন্ধর যিনিতিনি সুরেরসাগরগীতিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানের ভুবন ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী আজ রবীন্দ্রনাথ  সঙ্গীতের

কোন ভৌগোলিক সীমানা নেই  বিশ্বব্যাপী মোহময়  দুঃসময়ে  রবীন্দ্র সঙ্গীতের গভীরে অবগাহন করতেই হবে, শুধুমাত্র মানসিক চাপ    দুঃখ জয়ের  এবং অপার   শান্তির জন্য এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের গান জীবনদায়ী ঔষধের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধু কন্ঠে ধারণের গান নয় একে গ্রহনকরতে হবে                   হৃদয়ে গান আমাদের জীবনের সঙ্গী,চলার পথের দিশা, লড়াইয়ের অব্যর্থ শানিত হাতিয়ার গান আত্মরক্ষার বর্ম, গভীরতর দুঃখের দিনে সান্ত্বনার স্নিগ্ধ প্রলেপ         খুব সহজ ভাষায়  চলচ্চিত্র বলতে আমরা বুঝি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে গভীর ভাবে আচ্ছন্ন প্রতিফলিত করছে,এমন একটা মায়াচুম্বক চলমান ছবি তাঁর সহযোগী রয়েছে শব্দযন্ত্র,তার সাহায্যে আমরা চরিত্রগুলোর কথোপকথন শুনতে পাই সুতরাং চলচ্চিত্র বলতে একটা শ্রুতিদৃষ্টি সহায়ক গনমাধ্যম(অডিওভিশুয়াল এইড)সহজ কথায় আমাদের বাস্তব জীবনটাই উঠে আসে পর্দায়, কাহিনী বিন্যাসের মাধ্যমে, বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে এবং অন্যান্য সহায়ক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন  গীতিকার যখন গান লেখেন, তাতে তাঁর জীবনদর্শনটি সম্যকভাবে প্রতিফলিত হয় কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন প্রমুখ গীতিকার জীবন সমকালীন জগৎ সম্পর্কে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে গিয়েছেন তাঁদের গানে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের কালজয়ী কবিতাকে তখন গীতিরূপ  দিয়েছেন সলিল চৌধুরী,সে আর এক জীবনচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।। তেমনি চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানসে এক আলাদা ধরনের বর্ণময় জীবনচিত্র নিঃসন্দেহে আমরা অকপটে বলতেই পারি, তাঁর গানের ভুবনের স্বরূপটি হল, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই  তাঁর গান প্রযোজ্য   অপরিহার্যসুখেদুঃখেশোকেবেদনায় এবং আনন্দউৎসবে তাঁর গান অর্থাৎ তাঁর গানগুলো শুধুমাত্র রোমান্টিক গান নয় এগুলো মধ্যে রয়েছে কাদামাখা বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি একান্ত হৃদয়ের  অনুভবের বিষয় সেই কারণে    চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভুবন ভোলানো গানের  একটা স্বভাবসিদ্ধ অমোঘ বন্ধন রয়েছে, যেহেতু চলচ্চিত্রও     বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি, রবীন্দ্রনাথের গানেও তাই সময়়ের দাবিতে বাংলা  গানের কবিতায়   

এলো নবজাগরণের জোয়ারসময়টা উনবিংশ শতাব্দীতেধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্যসবেতেই এলো একটা পরিবর্তিত চেহারা স্বভাবতই কবিতা তার রোমান্টিকতার খোলস ছেড়ে একটা বাস্তবমুখিতার পথে পা বাড়াতে শুরু করল আমরা পেলাম নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য,সত্যেন্দ্রনাথ  দত্ত, প্রমুখ কবি,যাঁরা কবিতার মধ্যে নিয়ে এলেন বাস্তব, কঠিন জীবনের একটা নতুন ভাবনাকবি সুকান্তের কথায়,’ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটিকবিতার মতোই চলচ্চিত্রেও  এর একটা পরিবর্তিত রূপ সমাজের বাস্তব চেহারা তুলে ধরে,বহু লেখকের উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হতে লাগলো সমাজের ছবিবিধৃত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস, দেশাত্মবোধে উদ্দীপিত  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস, গ্রামবাংলার অনবদ্য চিত্রসমন্বিত বিভূতিভূষণের উপন্যাস ইত্যাদি  জীবন বিষয়ক  বইয়ের চলচ্চিত্রে প্রয়োগ বাড়তে থাকলো , আমাদের খুঁজতে অন্বেষণ  করতে হবে  দুইবাংলার চলচ্চিত্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের ঐতিহাসিক যোগসূত্র টি আমাদের ভুললে চলবে না, রবীন্দ্রনাথের গান হলো জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের গানএই কথাটা  যত  বুঝতে শুরু করলাম আমরা,তত তাঁর গানের প্রয়োজনীতা অনুভূত হতে থাকলো আমাদের জীবনে এবং চলচ্চিত্রের প্রয়োগের সার্থকতা সম্পর্কে একটা চিন্তাধারণাভাবনা আমাদের মধ্যে ক্রমশ  বাড়তে লাগলোএর একটিই কারণ, রবীন্দ্রনাথের গানের বৈচিত্র্য ব্যাপ্তি তাঁর উৎস অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের যেতে হবে রবীন্দ্রদর্শন তথা সুমহান ভারতীয় দর্শনে রবীন্দ্রনাথের গানে অধ্যাত্ম বাস্তব

চেতনার একটা অনবদ্য সংমিশ্রণের রসায়ন আছে মানুষের জীবন তো, এই দুটোকেই  নিয়েইআর চলচ্চিত্রসে তো বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের সার্থক প্রয়োগের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক ভাবে,যা আমরা কখনও অস্বীকার করতে পারিনাএই ভূমিকা পালনে বাংলা চলচ্চিত্র বহু বছর ধরেই একনিষ্ঠ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেঅত্যন্ত

  আনন্দের সুখের   বিষয়বর্তমানে তা ধীরে  হলেও বেড়ে চলেছে চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারের প্রথম পর্বের শুভ সময় কাল দশ বছর (১৯৩২১৯৪১) কবির ৭০বছর পূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে তার শুভ সূচনা,কবির মহাপ্রয়াণে তার সমাপ্তিএই পর্বে ১৮টি চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয় ৯টি ছবির প্রযোজক নিউথিয়েটার্স ছবির পরিচালকের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে ছাড়াও শিশিরকুমার,নরেশ মিত্র, প্রফুল্ল রায়,নীতিন বসু,প্রমথেশ বড়ুয়া,সতুসেন, নিরঞ্জন পাল,প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রমুখ এঁরা শুধুমাত্র রবীন্দ্রঅনুরাগীই ছিলেন না রবীন্দ্রনাথের গানের মর্যাদা মূল্য সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন এঁদের পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলিতে মোট ৬৯টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয় তাঁর মধ্যে পঙ্কজ মল্লিক ৭টি,কানন দেবী  ৮টি, সায়গল সাহেব টি গান পরিবেশন করেন এঁরা কেউই প্রতিষ্ঠত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন না, তবুও এঁদের গানগুলি জনমানসে যথেষ্ট সমাদার লাভ করে রবীন্দ্র পরিমণ্ডলের বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনমুক্তি  ‘ছবিতে ব্যবহারের জন্য পঙ্কজ মল্লিক কবির,’ শেষখেয়াকবিতায়দিনের শেষে ঘুমের দেশেসুরারোপিত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন লাভ করেন১৯৩৮ সালের  একই তারিখে মুক্তি প্রাপ্ত দুটি ছবিগোরাচোখের বালিবিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্যগোরা‘  ছবিরসঙ্গীত

 

 

 

 পরিচালক ছিলেন নজরুল ইসলাম পরিচালক ছিলেন নরেশ মিত্র রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে যখন বাংলার সাংস্কৃতিক জগৎ মথিত, সেই চারের দশকে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেগেল– -()দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এশিয়ায় বিস্তার তার প্রত্যক্ষ প্রভাব ,(),৪২‘-এর ভারত ছাড়ো  

আন্দোলন‘(),৪৩এর দুর্ভিক্ষ,( )’৪৬এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ()’৪৭এর দেশবিভাগ স্বপ্নভঙ্গের স্বাধীনতা; তার প্রভাব ছিল সর্বব্যাপি অল্প দিনের মধ্যেই যুদ্ধের কালো টাকার বেনোজলের অনুপ্রবেশ ঘটে  বাংলার নবগঠিত  চলচ্চিত্র শিল্পে রুচিহীনতা  অজ্ঞতার দাপটের সেই   চরম সংকটের  মধ্যেও  বাংলা চলচ্চিত্রের  কিছু আদর্শ একনিষ্ঠ চলচ্চিত্র সেবক  সমাজমনস্কতা নিয়ে সনাতন মূল্যবোধকে  বাঁচাতে ব্রতী হন রবীন্দ্রনাথের গান তাঁদের কাছে শুধু এক হাতিয়ার   হয়ে ওঠে না, মুক্তির নিঃশ্বাস    জোগায়এই সময় থেকেই   রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পসম্মত ব্যবহার শুরু হয় বাংলা চলচ্চিত্রের অবক্ষয়ের পর্বে  মোট ৬৭৯টি ছবি মুক্তি পায়এই সময়বৃত্তের মধ্যেই  সত্যজিৎ রায়েরপথের পাঁ চালী‘, তপন সিংহেরকাবুলিওলা,’ ঋত্বিক ঘটকেরমেঘে ঢাকা তারা,’ মৃণাল সেনেরনীল আকাশের নীচে,’ আত্মপ্রকাশ আর একবার   প্রমাণ করে যে  অন্ধকার জীবনের শেষ কথা নয় চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগের দিক অন্বেষণে করলে, যে ছবিটি ভেসে ওঠে তা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জকডাক্তার

ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি পঙ্কজ কুমার মল্লিকের গানকী পাইনি তার হিসাব মেলাতে –‘ যখন ছবিটি আমরা দেখেছি এবং অভিনেতাশিল্পীর  পৌরুষদীপ্ত কন্ঠে শুনেছি, তখনই এই রবীন্দ্রসঙ্গীত একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছেআনন্দধারা বহিছে ভুবনেএকটি মনোমুগ্ধকর  জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত আমরা পাই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠেবিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনাচলচ্চিত্রেদাদার কীর্তি‘  ছবিতে  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠেচরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে ‘ ,  ‘কাঁচের স্বর্গছবিতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের  গাওয়াভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়‘, চলচ্চিত্রের কাহিনির পরিবেশের  সঙ্গে  সামঞ্জস্য বিধান করেই  কিন্তু গানটির পরিচালনা হয়েছে এবং তাতে কিন্তু গানটি কোনভাবেই মর্যাদা হারায়নি ‘ ‘ভালোবাসা ভালোবাসাছবিতে , শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে  ‘ এবার নীরব করে দাও হে–‘ কুহেলী‘  ছবিতে আশা ভোঁসলের কন্ঠে  ‘মেঅঘের কোলে রোদ হেসেছে,’   ‘ বৌ ঠাকুরানীর হাটছবিতে  লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে গান  ‘ শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা একটি  বাংলা চলচ্চিত্রতাতে রবীন্দ্রনাথের গান ভারতবর্ষের  অন্য এক প্রান্তের  দুই কিংবদন্তি শিল্পী —   লতা মঙ্গেশকর আশা ভোঁসলেএই জায়গাটাতে কিন্তু  চলচ্চিত্র একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে দুই অবাঙালি শিল্পীকে নিয়ে আসছে বাংলায়, আবার এক বাঙালিকে নিয়ে যাচ্ছে মুম্বাই এবং এইভাবেই ভারতবর্ষের মানুষকে প্রাদেশিকতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাচ্ছে শুধু তাই নয়, একটা জাতীয়তার চেতনা তৈরি করছে হিন্দি গানের কিংবদন্তি শিল্পী কিশোর কুমারের কন্ঠে  বাংলা চলচ্চিত্রে   ”আমি চিনি গো চিনি তোমারে‘   গানটি অন্য চেহারা মাত্রা পেয়েছে যখন  ‘ ওগো বিদেশিনী

 

উচ্চারণ করেছেন শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বার্থক প্রয়োগ ঘটেছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেঅগ্নীশ্বর ‘  ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে  ‘  ‘পুরানো  সেই দিনের কথা‘   ‘মেঘে ঢাকা তারাছবিতে  দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়াআকাশ ভরা সূর্য তারা‘  ‘আলোছবিতে  অরুন্ধতি মুখোপাধ্যায়েরকন্ঠেদাঁড়িয়ে আছে তুমি আমার‘ , ‘ শ্বেতপাথরের থালায় ‘ ,  ‘ভালোবাসি ভালোবাসি‘ , ‘শুভ মহরতছবিতে  মনোময় বন্দোপাধ্যায়েরকন্ঠে ,  ‘ জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে‘    ইত্যাদি  ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয়েছে অনবদ্য আঙ্গিকে এর ফলে বাংলা চলচ্চিত্রের গুনগতমান বৃদ্ধি পেয়েছেদর্শকচিত্তে সমাদার লাভ  করেছেতা সত্ত্বেও বেশ কিছু  প্রশ্ন   উঠে আসে আমাদের সচেতন মনেবাংলা চলচ্চিত্র  কি রবীন্দ্রনাথের গান দ্বারা সমৃদ্ধ নয়, অথবা রবীন্দ্রসঙ্গীত কি চলচ্চিত্রের দ্বারা উপকৃত নয়এই খানেই  এসে পড়ে চলচ্চিত্র   রবীন্দ্রসঙ্গীতের পারস্পরিক সাহচর্য অর্থাৎ একে অপরের পরিপূরক রবীন্দ্রনাথের গানে  আছে একটা সুসংবদ্ধ অধ্যাত্ম বাস্তব চেতনার রসায়ন।। এটাই হলো ভারতীয় সুমহান সনাতন শাশ্বত ঐতিহ্য সংস্কৃতি  আমাদের   প্রতিবেশী  বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে কবিগুরুর নাম কেবল রবীন্দ্র সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রে শুধু নয়, অন্য চলচ্চিত্রেও  বহু বার  ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত একথা সত্য, নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া  বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে রবীন্দ্র চর্চাকে আন্তরিক ভাবে  আজ   খুব উঁচু স্হানে  রাখা হলেও আজ পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক বাণিজ্য চলচ্চিত্রেই  রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয়েছে স্বমহিমায়(১৯৫৮১৯৭১)সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বাংলাদেশে কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা থেমে থাকেনি বর্তমান বাংলাদেশ সেই সময়  পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে  ছিল তা সত্ত্বেও প্রচেষ্টায় কোন খামতি ছিল না১৯৫৭সালে তৎকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে গিয়েআকাশ মাটিচলচ্চিত্রে প্রথম বারের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন করিম শরাফী১৯৫৮ সালেমাটির পাহাড়‘  চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয় আর একবার এই সময় চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ,’আগুনের পরশমণিচলচ্চিত্রেচাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছেরবীন্দ্র সংগীত টি  সুন্দর ভাবে ব্যবহার করেছিলেন অনেক লড়াইসংগ্রামের পর স্বাধীনতা লাভ করে ,বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়সে একটা বর্ণময় ইতিহাস১৯৭০সালের একটি চলচ্চিত্রআগুনেপুড়িতে আর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতআমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণব্যবহৃত হয়েছিল গানটিতৈ কন্ঠ দেন নিলুফার ইয়াসমিন অজিত রায় এরপর খান আতাউর রহমান তারজোয়ার ভাটাচলচ্চিত্রে ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক হিসেবে  ব্যবহার করেন    ‘গ্রাম ছাড়া রাঙামাটির পথ‘  গানটি সুর জহির রায়হানজীবন থেকে নেয়াতে  ব্যবহার করেন  ‘  আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি‘  বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই গান টি নেপথ্য  শিল্পী তিন ভাইবোন  , আনোয়ার হোসেন,রোজি সামাদ,সুচন্দ বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতের পাশে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেশের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করার একটি গান যে চলচ্চিত্রের মতো গনমানুষের কাছে  পৌঁছে যাওয়ার মাধ্যমে ব্যবহৃত হলো, তার সুদূর প্রসারী প্রভাব সবাই জানে দেশপ্রেম জাতীয়তাবোধ জাগরণের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রছিল এই গান

স্বাধীনতা  লাভের পর ,স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারআমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসিগানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষনা করেন এব্যাপারে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ  ,মাস জুড়ে এই গান মুক্তির মন্ত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল শুধু তাই নয়, এই গান প্রেরণা  যুগিয়ে গেছে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতাকামী মানুষকেআমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসিসেই সময় এই গানটি  গেয়েছিলেন এপার বাংলার অসাধারণ জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রএটাও একটা ইতিহাসপরে গানটি জনচেতনতার গানে পরিনত হলো ইতিহাস তার নীরব সাক্ষী বাংলাদেশের স্বাধীন  হওয়ার ক্ষেত্রে এই গানের একটা বৈপ্লবিক অপরিসীম গুরুত্ব ছিলএক বড় প্রাপ্তি বর্তমান বাংলাদেশের বহু চলচ্চিত্রকার  বিভিন্ন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারের তাগিদ অনুভব করছেন নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকার গন গভীর মনোযোগ সহকারে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ওপার বাংলার  চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যারা প্রাণের গভীরে লালন করে চলেছেন তাঁরা হলেন,রেজানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হক, সামিনা চৌধুরী,সাদি মহম্মদ,তপন মজুমদার,ইফাত আলি দেওয়ান,অদিতি মহসিন,কালিম শরাফী, ফাহমিদা নবী সহ আর অনেকলব্ধপ্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগীত  শিল্পী এপার বাংলার  চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নতুন ভাবনা দিয়ে নবরূপায়ন করেছেন পাঁচ জন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব,সত্যজিৎ রায়,ঋত্ত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার তপন সিংহ এঁদের মধ্যে অগ্রগন্য হলেন তরুণ মজুমদার তাঁর  নিজস্ব চলচ্চিত্রগুলিকে  নবরূপায়নের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত গুলি উপযোগীকার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছে সেই সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি ছবির কাহিনিকে  উৎকৃষ্ট উন্নততর শিল্প মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে ফলে এগুলি শিল্পমূল্য হিসেবে অসাধারণ হয়ে উঠেছে পাঁচ চলচ্চিত্রের মহারথীদের হাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাংলা চলচ্চিত্রকে  সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের  সযত্ন  সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগ তাঁদের পরিচালিত চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের সৃজনশীল নান্দনিকতার অপূর্ব প্রকাশ ঘটিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র সঙ্গীতকে  সমৃদ্ধ করে তুলেছেন তরুণ মজুমদারের একক ভাবে পরিচালিত চলচ্চিত্রেআলোর পিপাসা(১৯৬৫) থেকে শুরু করে কুহেলি, নিমন্ত্রণসজনী গো সজনী ,পথভোলা,পথ প্রাসাদ,অমরগীতি, ভালো

বাসা ভালোবাসা,আলো(২০০৩), ভালোবাসার অনেক নাম(২০০৬), চাঁদের বাড়ি (২০০৯),  ভালোবাসার  বাড়ি(১০১৮), ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে অসাধারণ ভাবে প্রয়োগ করেছেন ফলে  দর্শকদের কাছে অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ছবিগুলোদাদারকীর্তিচলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানচরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে‘,’আলোচলচ্চিত্রেতখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে ‘, ‘ভালোবাসার অনেক নামচলচ্চিত্রে‘, ‘  হঠাৎ হঠাৎ কি যে  হয়ে যায়‘, ‘চাঁদের বাড়ি‘  , ছবিতেচাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে‘,

 ‘ভালোবাসার বাড়ি‘  ছবিতে,’ ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়‘,  গানগুলো চলচ্চিত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সত্যজিৎ রায়ের,’ঘরে বাইরে তে  ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি‘  ‘ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনছবিতে   ‘ওদের বাঁধন  যতই হবে‘  , ‘সুভাষ চন্দ্রছবিতে,   ‘তোমার আসন শূন্য আজি‘    আর দুভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার লক্ষ করা যায় সত্যজিত রায়ের চলচ্চিত্রেপ্রথমটি ট্রানজিশান হিসাবে কাহিনির গতিকে ব্যাহত না করে তার ছন্দে গানকে ব্যবহার করে কাহিনির  অন্যসূত্রের উত্তরণ ঘটানোএর চমৎকার উদাহরণ  ‘তিনকন্যাছবিতে   ‘বাজে করুন সুরে‘  – ব্যবহার এছাড়া গানে মূল চরিত্রের  বিষাদের সুরটা ধরা পড়েআর দ্বিতীয়টি চলচ্চিত্রের অলংকার হিসাবেএমন ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রয়োগ দেখিয়েছেন তরুণ মজুমদার, ‘ শ্রীমান পৃথ্বীরাজ‘, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা‘,  ‘আলোছবিতেনিমন্ত্রণছবিতেদূরে কোথাও দূরেগানটির ব্যবহারে তার চিত্রকল্পনা করে অনবদ্য ব্যঞ্জনা  তৈরি করেআজ পর্যন্ত কত ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার হয়েছে তার হিসাব পাওয়া সত্যিই কঠিন দুষ্করতবে নানা তথ্য   গবেষণায়  মোটামুটি যে  তথ্য একটা হিসাব পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের প্রায় ২৫০ টির কাছাকাছি গান বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে চলচ্চিত্রের বিশেষ ক্ষেত্রে ভাব অনুযায়ীই রবীন্দ্রসঙ্গীতের  প্রয়োগ হয়  সাধারণত এই অসাধারণ প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের মধ্যে, ‘মেঘে ঢাকা তারাতে (যে রাত ভোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে), কিংবা সত্যজিৎ রায়ের ‘ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘  ‘  পরবাসে রবে কে), ‘  ‘জন অরণ্যতে,  ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে ‘  অথবা তপন সিংহের ,’ অতিথি‘  ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়‘ ,    ‘ হাটে বাজারেতে,  ‘নদী আপনবেগে পাগলপারা‘ , অজয়  করেরমাল্যদান‘ ‘ ঘরেতে ভ্রমর এলো  ‘–এমনি আরও  বেশ কিছু চলচ্চিত্রে চলচ্চিত্রের সময়কালেকে  বোঝানোর জন্য অনেক সময়েই বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছেযেমন পূর্নেন্দু পত্রী পরিচালিতস্ত্রীর পত্র‘  তে ,’ বাংলার মাটি বাংলার জল আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, চলচ্চিত্রে  রবীন্দ্রনাথের গানের এই বহুল ব্যবহারের কারণ  কি? আধুনিক বাংলা গানের বৈচিত্র্যে ভরা, বিশেষ করে চলচ্চিত্রের গানকত প্রতিভাধর সঙ্গীত পরিচালক বাংলা গানের ডালি ভরে দিয়েছেন,তবু বাঙালি  সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত আজ বিশিষ্ট স্হানে অধীশ্বরযতদিন  গেছে  উচ্চবিত্ত,মধ্যবিত্ত রূচিশীল শ্রোতার অঙ্গন ছাড়িয়ে সমাজের 

বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের গান আসলে প্রাচ্যপ্রাশ্চাত্য ইসলামীয় এই তিন মহতী ধারার ত্রিবেনী সঙ্গম ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের গানে এর ফলে হিন্দী সিনেমাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের  সুরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়যেমন — ‘আফসার‘  ছবিতে শচীন দেব বর্মন সৃষ্টনয়না দিওয়ানেগানটি  ‘ যেদিন দুজনেরঅনুপ্রেরণায়, সুজাতা ছবিতে,’ জ্বলতে ইয়ে জিয়াকে দিয়ে‘ ,’একদা তুমি প্রিয়ের ‘  অনুপ্রেরণায়যদি তারে নাই চিনিগোশচীন দেব বর্মণের প্রিয় গান তিনি হৃষিকেশ মুখার্জির সুপারহিট ছবির ,’ অভিমান এই সুরটিতেরে মেরে মিলন কি ইয়ে দেয়না‘ ,ব্যবহার করে জীবনের শেষপ্রান্তে এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন  ” তাঁর সৃষ্টির কিছু টিকে থাকুক বা না থাকুক, তাঁর গান বাঙালীর জীবনে চিরকাল থেকে যাবে বর্তমান ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রাদেশিক ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছেএর ফলে চলচ্চিত্রের গুনগতমান বৃদ্ধি পাচ্ছে দর্শকদের মন ভরে উঠছেএই প্রবনতা আশাপ্রদ শুধু তরুণ মজুমদার তার ,’আলোছবিতে এক সঙ্গে ৯টি রবীন্দ্রনাথের গান উপহার দিয়েছেনএই ধরনের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের একটি নান্দনিক রুচিশীল   দর্শকমণ্ডলী তৈরিতে রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পসম্মত বিকল্প আজ নেই বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাসমৃণাল সেন  তার  কোন চলচ্চিত্রে একটিও রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেন নিএটা সত্যিই অবাক  হওয়ার কথা এত বড় মাপের চলচ্চিত্রকারের কেন  রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারে এত অনীহা ? আমাকে গভীর ভাবে আচ্ছন্ন করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী ঘিরে বাংলা সংস্কৃতির অংশ হিসাবে বাংলা চলচ্চিত্রে হয়তো আনা যেত  নবজাগরণের ঢেউ অত্যন্ত বেদনার বিষয় হলো, আত্মঘাতী,হুজুগপ্রিয় বাঙালি সে পথে না গিয়ে বেছে নিল রবীন্দ্রপূজার সহজ,সরলপন্থা শতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অভূতপূর্ব প্রচার প্রসারের সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে পণ্যে পরিণত করার সর্বাত্মক চেষ্টা দেখা গেল ঋত্বিক ঘটক,সত্যজিৎ রায়,তপন সিংহ,অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ সেনগুপ্ত   কিছু নবীন পরিচালক সার্থকভাবে  চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগ করে যেমন  একদিকে বাংলা  চলচ্চিত্রের নতুন দিগন্ত উন্মোচন  প্রসারিত করলেন, অন্যদিকে যত্রতত্র  রুচিহীন রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগ  করতে লাগলেন কিছু জনতাদের সে প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও থমকে গেল বর্তমানে কিছু কিছু চলচ্চিত্রে এই প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছেএর থেকে বেরিয়ে আসার শুভ উদ্যোগ  নেওয়া উচিৎ নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের  সার্থক প্রয়োগের রূপকাররা হলেন, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়,তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার,নীতিশ মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ মুখার্জি পূর্ণেন্দু পত্রী চিত্রপরিচালক হিসাবে সত্যজিৎ রায় ৭টি ,তপন  সিংহ ১০টি, তরুণ মজুমদার টি, অরবিন্দ  মুখার্জি ৪টি, অগ্রগামী ৫টি, ঋত্বিক ঘটক ৩টি, পূর্ণেন্দু পত্রী ৩টি নীতিশ মুখোপাধ্যায় ৩টি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করে বিরল নজির সৃষ্টি করেছিলেন এছাড়াও রবিশঙ্কর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ৩টি করে এবং অনাদি দস্তিদার পঙ্কজ মল্লিক প্রত্যেকে ২টি করে রবীন্দ্রসঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত ছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করেন বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ খুবই উন্নত মানের চলচ্চিত্রের কাহিনিতে থাকে প্রেম,বিরহ, সংঘর্ষ, শান্তি ,বিচ্ছেদ,মিলন ইত্যাদি বিচিত্র পরিবেশ এই সমস্ত পরিবেশেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সার্থক প্রয়োগ সহ পরিবেশনা দর্শকচিত্তে বলিষ্ঠ প্রভাব নিয়ে আসে,যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ,( ) ‘শ্রাবণের ধারার মতো‘,  () ‘ জীবনেমরণের সীমানা ছাড়ায়ে মতো গানগুলি দর্শকের কর্ণকুহরের মাধ্যমে মরমে প্রবেশ করে এবং  শুধু মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে  হৃদয়ভূমিতে চলচ্চিত্র যেহেতু আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক জীবন,সমাজজীবন, রাষ্ট্রজীবনকে প্রতিফলিত করে, সেই কারণে রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পসম্মত যত  প্রয়োগ ব্যবহার  ঘটবে ততই সমাজের কল্যাণসাধন হবে, যা  আজকের  মোহময়   চরম দুঃসময়ে আমাদের সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখার জীয়নকাঠি স্বরূপ

রবীন্দ্রনাথের গান চলচ্চিত্রের পারস্পরিক মেলবন্ধন উভয়কেই শ্রীমণ্ডিত করতে থাকুক আমরা সুস্থভাবে বাঁচতে শিখিচলচ্চিত্র   নিজস্ব ভাষার প্রয়োজনেই প্রয়োজন পড়ে স্বতন্ত্র চিত্রনাট্যের একথার সত্যতা কবি আর গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন

আধুনিকমনস্কতার ফলেই  রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে পৌঁছতে পেরেছিলেন এই জীবন সত্যে সাহিত্য নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রকে তবুও আমরা দেখতে পেয়েছি,তাঁর সাহিত্য নির্ভর করে দুবাংলায় বহু চলচ্চিত্র  নির্মাণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে নির্মিত হয়েছে হচ্ছে বহু চলচ্চিত্রএবং টেলিফ্লিম তাঁর গান   দুইবাংলার চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান সম্পদ রবীন্দ্রনাথআমাদের সৃষ্টির এমন কোনোপ্রান্তে  নেই যেখানে অনুপস্থিত তাঁর অস্তিত্ব বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে আমরা বারে বারে সেই সত্যের সন্ধান পেয়েছি লেখক পরিচিতি: সুবীর মণ্ডল,   বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ,ভারতলোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প ছোটগল্পকারভ্রমণকাহিনীর এবং স্মৃতিকথা   বিষয়ের লেখক 

তথ্যসূত্র-(-) বাংলা সংগীতমেলা১৪১৯, স্মরণিকা তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ পশ্চিমবঙ্গ সরকার

) রবীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্র তথ্য সংস্কৃতি বিভাগপশ্চিমবঙ্গ সরকার,মে ২০০৬

( ) রবীন্দ্রস্মরণ সংখ্যা তথ্য সংস্কৃতি বিভাগপশ্চিমবঙ্গ,১৪০৮

() সাহিত্য চলচ্চিত্র: : পবিত্র সরকার

) জীবনস্মৃতি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়,() চলচ্চিত্রের চালচিত্র: তপন সিংহ

 

পশ্চিমবঙ্গ,কলকাতা ,ভারত ।

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]