সুন্দরবনের ভ্রমণ কাহিনী

সুন্দরবনের ভ্রমণ কাহিনী
সুন্দরবনের ভ্রমণ কাহিনী

প্রদীপ দে 

সুন্দরবন ঢুকছি টুরিস্ট ব্যুরোর বড় লঞ্চে। দেখতে একটা ছোট জাহাজ। ম্যাংগ্রোভের জঙ্গলের পাশ দিয়ে, উজানে তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছি। একবার ডেকের মাথায় চড়ি তো একবার নিচের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই আন্ডারগ্রাউন্ড কেবিনে। ছোট মেয়ে আনন্দ পেয়ে বসেছে, বড় লঞ্চটাকে জাহাজ ভেবে লাফালাফি করছে। খাবার আয়োজনে খামতি নেই, পরপরই তার পরিবেশন চলছে। ডেকের ছাদে গরম গরম কাটলেট ভাজছে বিজলী গ্রীল। খেয়েদেয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস – খুব আমেজ আনে,  যখন চারিদিক জল আর মাথায় পরিস্কার নীলাকাশ ঘীরে ধরেছে। বলতে গেলে সরকারি পরিচালনাধীন ভ্রমন। কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হয়ও নি। ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ উইথ দেম আন্ডার টোটালি সেফ। প্রত্যেকেই আনন্দ উপভোগ করছে। লঞ্চ যাওয়ার সময় ডেকের সামনে ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে থাকলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ। হু হু বাতাসকে কাটিয়ে এগিয়ে চলা চুল এলোমেলো করা আর নীচে জলকে দুভাগে চিড়ে এগানো। উপরে নীল, নিচে নীল,  নীল দিগন্তময়।

প্রথম দিন প্রথম জলাজঙ্গলে নিজেকে হারিয়ে ফেলা, এক সুখানুভূতি। সারাদিন নেমে উঠে ঘুরেফিরে খেয়েদেয়ে কেটে গেল। ছোট ডিঙ্গি নৌকার সাহায্যে পাড়ে যাওয়া, রাইফেল সঙ্গে উর্দিধারীর বেষ্টনীতে যতটা সম্ভব ভিতরে প্রবেশ করা, ভয়ের কথা ভুলে নিজেকে একজন বড় দামী কেউ ভাবার এক এক বড় সুযোগ পাওয়া। জঙ্গল ঘুরে, বড় জোর পঁনেরো মিনিট পরে আবার ফিরে কাদায় পা ঢুকিয়ে, নৌকায় চড়া আর লঞ্চে এসে ওঠা। কিছু না দেখতে পাওয়ার মনোক্ষোভ রয়ে যাওয়া -পয়সা উশুল না হওয়ায়। সন্ধ্যায় নাচ গান সিনেমার ব্যবস্থা, দামী টিফিন। লঞ্চের চারদিকে আগুন জ্বলে ওঠে সুরক্ষার বেষ্টনীর জালে। ফোরেষ্ট অফিসার এসে খোঁজ খবর নেয় –সবই সরকারি ব্যবস্থার সুফল।

এই নিয়েই কথা হচ্ছিল, অফিসারের সঙ্গে,  জানা গেল এ স্থান মোটেই নিরাপদ নয়,পদে পদে বিপদ আছে। যারা খুবই সাধারণ ভাবে যায় আসে,তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নজর দেওয়া উচিৎ। রাত দশটার পরে চেঁচামেচি শুনে কেবিনের বারান্দায় গিয়ে বহুদূরে ,অস্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান হল কোন জন্তুর গতিবিধি। মনে হল তীব্র বেগে কেউ জলে সাঁতার কেটে পাড়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। হইচই পরে গেল। সেকেন্ডের মধ্যে সে পগারপার। ওটা নাকি বাঘ!

সবাই বেশ রোমাঞ্চকর কথাবার্তা বলে চুপ মেরে গেল। অনেকে আবার ভয় পেয়ে ‘ এখানে বেড়াতে আসা উচিৎ নয় ‘মন্তব্য করে ফেললো। সবাই শেষে মেনে নিল এই স্থান সুরক্ষিত,  ভয়ের কিছু নেই। পরের দিন লঞ্চ এগিয়ে চললো। কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান পরিদর্শন করাবে সংস্থা।  যখন সজনেখালি  গিয়ে পৌঁছুলাম তখন মধ্যাহ্ন। ছোট ডিঙি নৌকায় ভেসে গেলাম পাড়ে। রাইফেলদারীরা এগিয়ে  ঘিরে নিয়ে চললা আমাদের। আমরা কুমীর প্রকল্পটি ঘুরে দেখলাম। ফেরার একটু বাকি। সবাই একটু ঘুরছে,  বসে গল্প করছে, অনেকে টাওয়ারের উপর থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করছে। আমি একা থাকছি দেখে ডিঙি নৌকার এক মাঝি কাছে এসে কথা বললে — বাবু – কি কলকাইতা থাইকা?

আমি ঘাড় নাড়লাম।

এহানে সুবিধা লাই

আমি ওকে দেখলাম ভালো করে।

ও কি বুঝলো জানি না। ক্ষয়ে যাওয়া, কালো দাঁত বার করে জানালো –হামি মারুত মুর্মু। পাসে বস্তি আচে। কাল রেতে হামার ভায়ের ছোট ছা’টারে বাঘে লে গেছে। বড় কষ্টে আছে উহারা।

অন্যমনস্ক ছিলাম। কথাগুলো যেন আমাকে নাড়িয়ে দিল। বড় বড় চোখ নিয়ে মারুত মুর্মুকে দেখলাম — কি বললে — কাল রাতে ?

মেলাবার চেষ্টা করলাম –কাল রাতে একটা বাঘ দেখা গেছিল — তাহলে কি সেটাই?

— যাইবেন?  হামার সাথ?

– এখন? সে কি? সময় কোথায়?

— অসুবিধা হবেক লাই। যাবে আর ফিরবে। ইখানে ঘন্টাভর বিরাম। হামি তো আছিই। অন্য ডিঙির মাঝিরাও ইখান থিকা ওইখান গিয়া ভিরেছে। সব নিজজন না! বিপদে আপদে পাইশ্যা না পাইলে চলে?

ব্যাপারটা বুঝলাম। এখন স্থানীয় সকলেই ওখানে।

তালে অসুবিধার কিছু নেই।

কাদামাটি মারিয়ে ভয়ার্ত বুকে জংগলের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লাম ছোট্ট লোকালয়ে। পাঁচটি পরিবারের বাস। কুটির জঙ্গলে। কান্নার রোল উৎসারিত অঞ্চলটির পরিবেশ কে বেদনাবিধুর করে তুলেছে। উঠোনে চোখ চলে গেল, রক্তমাখা একটি দলাপাকানো শিশুর মৃতদেহ ঘিরে ক্রন্দন রোল উঠছে। শক্তপোক্ত আধিবাসীরা গিয়ে শিশুটির মৃতদেহটি তুলে এনেছে, বাঘের মুখ থেকে। রাতে অনুসন্ধান করতে পারেনি,না হলে শিশুটিকে বাঁচানো যেত- এই যুক্তি ওই দুর্ধর্ষ লোকেদের দাবী। ষন্ডমার্কা চেহারার লোকগুলি নাকি বাঘের সঙ্গে লড়াই করেই এই জঙ্গলে টিকে আছে। এখানে নাকি পদে পদে ভয়। জলে কুমীর আর  ডাঙায় বাঘ। এই দুই জন্তুর মোকাবিলা করেই তাদের দিন শেষ হয়ে যায়।

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না বেরিয়ে বাইরে চলে এলাম। আনন্দ করতে এসে এই অভিজ্ঞতা হবে ভাবিনি। অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সম্পদ নিঃসন্দেহে তথাপি এই দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে নিজেকে মেনে নিতে পারলাম না। বহু অঞ্চল ঘুরে সেবার সুন্দরবন ভ্রমন শেষ করেছিলাম। ফেরার দিন কষ্ট বেড়ে গেল অনুভবে, ভাটার টানে, উজানের বিপরীতে, যখন আমাদের চিত্ররেখা লঞ্চ আমাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। আমরা দুর্গম স্থানে ভ্রমন করতে যাই আনন্দ আহরণে কিন্তু ওখানকার আদিবাসীরা যে লড়াই চালিয়ে বেঁচে থাকে,  এবং আমাদের আনন্দ বর্ধনের সহায়ক হন তা আমাদের গোচরে আসে না। জীবন সুখ দুঃখ মিলিয়ে। আনন্দ খুঁজতে গিয়ে দুঃখ নিয়ে ফিরতেও হয় — আনন্দ সীমা লঙঘন করলে তার পরিণাম সুখের নাও হতে পারে — এ শিক্ষা আমার পাওয়া হয়ে গেল।

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
'বলি' ওয়েবসিরিজ রিভিউ

‘বলি’ ওয়েবসিরিজ রিভিউ

আশিক মাহমুদ রিয়াদ  ওয়েবসিরিজ – ‘বলি’ পরিচালক – শঙ্খ দাসগুপ্ত সাগরের নোনাজলে ভেসে গেছে কত দেহ.. নোনাজলে চর জাগে..ভেসে আসে প্রাণ.. শুকায় চোখের জল পাপের ...
ছেলেদের ইসলামিক নাম (অর্থসহ) ৪০০০+ ইসলামিক নাম (২০২৪ সংকলন)

ছেলেদের ইসলামিক নাম (অর্থসহ) ৪০০০+ ইসলামিক নাম (২০২৪ সংকলন)

“অ” দিয়ে শিশুদের সুন্দর ইসলামিক নাম (২০২৪) অ দিয়ে ইসলামিক নাম ছেলেদের অর্থসহ ১. অজেদ/ওয়াজেদ —প্রাপ্য ২. অযীর — মন্ত্রী ৩. অয়েল/ওয়ায়েল — শরণার্থী ৪. ...
কবিতা : ধুয়ে গেছে জ্যৈষ্ঠের ক্ষত

কবিতা : ধুয়ে গেছে জ্যৈষ্ঠের ক্ষত

অনঞ্জন কী যে নিকষা কী নিকষ!শ্রাবণের কেন এত রূপ?মধ্যরাত্রিতে বর্ষার রূপমত্ত ঝংকারে দেখ-দস্যুর মতো বেপরোয়া দুর্দান্ত নারীরখোলা ওই রূপের বৈভব,উৎসব যেন, করে অসহায়।তারপর-ঘোর বৃষ্টিপাতে ধুয়ে ...
সাকিব হোসেন নাঈম এর কবিতা

সাকিব হোসেন নাঈম এর কবিতা

সাকিব হোসেন নাঈম তাফালবাড়ি ময়দানে একবার মাহফিল হইতে চলিল। খাদেম সাহেব বারেক মিয়াকে চান্দা তুলিতে বলিল। বারেক, সে যে অতিশয় বুড়ো হৃদরোগ আছে তার। এপর্যন্ত ...
নগর পিশাচ

নগর পিশাচ

ভুতের গল্প – নাঈমুর রহমান নাহিদ   শহরের মানুষ ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোন রিক্সা বা সিএনজি চোখে পড়লনা। এক দুটো ...
একটি অসময়

একটি অসময়

ফজলে রাব্বী দ্বীন   একটি সকাল পাখিদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায় তমসার উদ্যানে, নখের খোঁচায় ঠোঁট ফেটেছে এ সকালে শঙ্খচিলের।   একটি রাত নিস্তব্ধে যে ঘুমিয়ে ...
Scroll to Top