রবীন্দ্রনাথ বাঙালী মুসলমান সমাজ [পর্ব – ২ ]
পর্ব – ২ :
( রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি তে বাঙালী মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান )
এটা ঠিক যে রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল এক হিন্দু পরিবারে । জমিদার বাড়ীতে । সেই “ জমিদারির বেশীর ভাগটাই ছিল অধুনা বাংলাদেশে – যাঁদের অধিকাংশ মুসলমান । তবে তাঁর ভাবনা চিন্তার সংগে গভীর একাত্মতা বোধ করার পথে কোনও বাধা হয় নি । রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর নিজের বাঙালী পরিবারকে , ‘ হিন্দু , মুসলিম ও ব্রিটিশ – এই তিন সংস্কৃতির সঙ্গমের ফল বলে বর্ণনা করেছেন । “ ৬
জমিদারি দেখাশোনার সুত্রে তিনি মুসলমান প্রধান বাংলার বিস্তীর্ণ পল্লী -প্রকৃতি , জনজীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন । যেখানে বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া যায় এবং প্রকৃতি ও নিসর্গ অনাবিল সৌন্দর্যের পাশাপাশি , শিলাইদহ – পতিসর , শাহজাদপুরের দুঃস্থ গরীব মুসলমান মানুষের জীবন গাথাও সমানভাবে উজ্জ্বল ।
এই কর্ম সুত্রে তিনি বাঙালী মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান , যে গভীরতায় বিশ্লেষণ করেন , তা দেশের জাতীয় নেতারা উপলব্ধি করেন নি । চেষ্টাও করেন নি । কিংবা না – বোঝার চেষ্টা করে , এড়িয়ে গেছেন । রবীন্দ্রনাথ এই বাঙালী মুসলমান সমাজের সঠিক ব্যাখ্যা করেন । প্রকৃতই পর্যালোচনা ।
অবশ্যই যেহেতু কবি একজন মানুষ । চিরন্তন মানব । সেহেতু এই মানব সীমারেখা অতিক্রম করে কবি মনে উৎসারিত হয় , মানুষের চিরন্তন সুখ , চিরন্তন দুঃখ , চিরন্তন প্রেম , চিরন্তন অভয় । “ যেহেতু রবীন্দ্রনাথ কবি , এবং যেহেতু মুসলমান মানুষ , সেজন্য মুসলমান তার আজকের বিশেষ ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রভাবে বুঝুক আর নাই বুঝুক , রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই তার পরম বন্ধু ব্যতীত আর কিছু না । “ ৭
ইংরেজরা ‘ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তা ‘ দিয়ে জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি করে । ইংরেজ শাসনের সুবিধার জন্য এই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি । এরা ইংরেজদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে । মুসলমানদের প্রতি হিংসা ও নিন্দা করতে শিখল । সমাজ জীবনে ভেদনীতির চেতনা প্রবল হল । রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি হয় যে , এই জমিদারি ব্যবস্থার কারনে গরীব মুসলমানদের আর নীচে ঠেলে দেওয়া হয় । কিন্তু “ যারে তুমি নীচে ফেল , সে তোমায় বাঁধিবে যে নীচে । “
“ ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয় , হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয় । মানুষকে ঘৃণা করার যে দেশে ধর্মের নিয়ম , প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয় , পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে , পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নেই । ইংরেজ সমস্ত ভারতবর্ষের কাঁধে চাপিয়া বসিয়াছে , সে কি কেবল নিজের জোরে ? আমাদের পাপই ইংরেজের প্রধান বল ( ব্যাধি ও প্রতিকার , রবীন্দ্র রচনাবলী , দ্বাদশ খণ্ড ) । “
“ আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল , তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম । মুসলমানরা তাতে যোগ দেয় নি , বিরুদ্ধে ছিল । জননায়কের কেউ কেউ ক্রদ্ধ হয়েছিলেন , বলেছিলেন ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক ; কিন্তু কেন তার যোগ দেয় নি ? ( প্রবাসী ) “ ৮
এই ‘ কেন ‘ – র উত্তর তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর জমিদারির সেরেস্তায় । জমিদারির বৈঠকখানায় যে সব মুসলমান প্রজারা প্রবেশের অধিকার পায় , তাদের জন্য বসার আলাদা ব্যবস্থা । ‘ জাজিম ‘ খানিকটা তুলে রাখা হয় । বুঝিয়ে দিতে হয় , মুসলমান প্রজারা পৃথক । এই দূরত্বের ব্যবধান মুসলমান মেনে এসছে । হিন্দুরাও মেনে এসেছে ।
“ তারপর ওদের ডেকে একদিন বলেছি , ‘ আমরা ভাই , তোমাকেও আমার সংগে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে । কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে । তখন দেখি হঠাৎ অপর পক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ টুপি মাথায় দিয়ে বলে , আমারা পৃথক । আমারা বিস্মিত হয়ে বলি , রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায় ? বাধা ঐ ‘ জাজিম ‘ তোলা আসনে বহু দিনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে । ওটা ছোট নয় । ( প্রবাসী ) “ ৯
এই জমিদারির কাজের সুত্রে , যুবক রবীন্দ্রনাথের মানুষের সংগে মেলামেশা । তাই তাঁর লেখায় জীবনের প্রতিফলন । সাহিত্য তো আসমানি ফসল নয় । জমিদারির এই কর্মক্ষত্রে তিনি উপলব্ধি করেন সমাজে সম্পর্কের গভীরতা । হিন্দু মুসলিম প্রজাদের মনের পার্থক্য , তফাৎ । তাঁর বাস্তব এই বিশ্লেষণ শুধু সাহিত্য নয় । কেবল ‘ গোরা ‘ চরিত্রের অতি প্রয়োজনীয়তার দিক নির্দেশ নয় । তা বাস্তবিকই সমাজের আয়না। যেমন –
“ উভয়ে চলিতে চলিতে এক জায়গায় নদীর চরে এক মুসলমান পাড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইল । তখন রৌদ্র প্রখর হইয়াছে – বিস্তীর্ণ বালুচর , নদী বহুদূর । রমাপতি পিপাসায় ক্লিষ্ট হইয়া কহিল , ‘ হিন্দুর পানীয় জল পাই কোথায় ? “ ১০
একদা ‘ বন্দেমাতারম ‘ এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িকতা প্রকট হয় । তা রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করে । কবি জসীমুদ্দিনের কথায় ,
“ রবীন্দ্রনাথ আমাকে দেখলেই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা লইয়া আলোচনা করিতেন । তিনি বলতেন , দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই যে ঘরে আগুন লাগে , তার কারন সেই ঘরের মধ্যে বহুকাল আগুন সঞ্চিত ছিল । যারা বলতে চান , আমরা সবাই মিলেমিশে ছিলুম ভালো , ইংরেজ এসেই আমাদের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিল , তারা সমস্যাটিকে এড়িয়ে যেতে চান ।
একদিন বন্দেমাতারম গানটি লইয়া কবির সংগে আলোচনা হইল । কবি বলিলেন , ‘ বন্দেমাতারম গানটি যে ভাবে আছে , তোমরা মুসলমানেরা এ জন্য আপত্তি করতে পার । কারন এ গানে তোমাদের ধর্মমত ক্ষুন্ন হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে ।
এরপর বন্দেমাতারাম গান লইয়া হিন্দু মুসলমানের মধ্যে খুব বিরোধ চলিতেছিল । ইহার অল্পদিন পরে কলকাতায় যখন সর্বভারতীয় জাতীয় মহাসভার কার্যকরী সমিতির অধিবেশন বসে , তখন বন্দেমাতরম গান ত্মুল আন্দোলন হয় । সেই সময় জহরলাল নেহেরু গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠাইয়াছিলেন । কবির পরামর্শের ফলে এ গানে আপত্তিজনক অংশটি কংগ্রেসের কোন অনুষ্ঠানে আর গীত হইবে না । ( ঠাকুর বাড়ীর আঙিনায় এবং রবীন্দ্র জীবনী ) “ ১১
রবীন্দ্র-সাহিত্যের পাঠকের শ্রেনীভেদ আছে । দেশ কাল ও পরিবেশভেদে বিচিত্র পথে আবর্তিত হয় । বাস্তবিকই বাঙালী মুসলমানের গনজাগরণে উৎস রবীন্দ্রনাথ । চেতনা ও স্বাধীনতার প্রেরনা । ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতে উদযাপিত হয় । রবীন্দ্র সঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে , একদল সাহসী বাঙালী ১৯৬৭ সালের পয়লা বৈশাখ , ঢাকার রমনার বটমূলে ভোরের সূর্যালোকে রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়ে জাতীয় সংস্কৃতির উদ্বোধন করেন । এই আন্দলনের নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াহিদুল হক , জাহিদুর রহিম , সনজিদা খাতুন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ ।
অবশ্য মুসলমানের ধর্ম বা ধর্ম-প্রবর্তক সম্বন্ধে কোন বিস্তৃত আলোচনা তিনি করেন নি । কোন ধর্ম সম্পর্কেই করেন নি । তিনি যে কবি – জগতের প্রাত্যহিক জীবনের সাহচর্য এবং আত্মার অনুভূতি , তাঁর জীবনের রাজপথ ।
তথ্য সুত্র –
৬ । তর্কপ্রিয় ভারতীয় – অমর্ত্য সেন – পৃষ্ঠা ৮৮ ।
৭। বাংলার মুসলমানের কথা – কাজী আবদুল ওদুদ – পৃষ্ঠা ৬৩ ।
৮, ৯ । রবীন্দ্রনাথ মুসলমান চিন্তা – শামসুল আলম সাঈদ ( বাংলাদেশ ) পৃষ্ঠা -৭০ ।
১০ । হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক – নিত্যপ্রিয় ঘোষ – পৃষ্ঠা ১৯৮ ।
১১ । রবীন্দ্রনাথ মুসলমান চিন্তা – শামসুল আলম সাঈদ ( বাংলাদেশ ) পৃষ্ঠা -৮৩ ।
রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালী মুসলমান সমাজ [পর্ব-০১ ]