প্রথম পাতাসর্বশেষসাপ্তাহিক সংখ্যা

সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় ; মনের বিকাশের বড় একটি  মৌলিক উপাদান

মিরাজুল হক

 

ভাষা যদিও একটি মাধ্যম । তবুও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা সিনেমা নাটক   এবং  বাঙালীর একটি বিশেষ বিশিষ্টতা আছে —  সৃষ্টিশীলতা । মানব সম্পদের উন্নয়নে এই সৃজনশীল কাজকর্মের  বড় অবদান ।   তা মানবজাতির গঠন ও বিকাশে বড় উপকরণ । মৌলিক উপাদান । যা ভালো ফলাফল বয়ে আনে । যা ‘ রসগোল্লা ’ র মতো ‘ রস ‘ ( আনান্দ , তৃপ্তি ) এবং ‘ গোল ‘ ( লক্ষ্য , উদ্দেশ্য ) – দুটোই প্রদান করে ।

মানুষ তো মননশীল জীব । অন্যান্য প্রাণীদের মত সে শুধুই খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে না । বাঁচার জন্য তার মননশীলতার চর্চার প্রয়োজন । এই মননশীলতার চর্চার করতে গিয়েই সে সৃষ্টি করেছে সাহিত্য , বিজ্ঞান , শিল্পচর্চা  প্রভৃতি বিষয় ।

সাহিত্যচর্চা সিনেমা নাটকের  অনুশীলন হল ‘ চিন্তা – ভঙ্গী ‘ এবং ‘ দৃষ্টি ভঙ্গী ‘ গঠনের একটি উপাদান । বড় অবদান ।   সু – অভ্যাসও  । এই মানব সমাজ ও পৃথিবীকে যে ভাবে দেখব  , ঠিক সেই ভাবে আমাদের মনে  প্রকাশিত হবে  এই বিপুল পৃথিবী ও মনুষ্য সমাজ । একটি মৃতদেহ শকুনের কাছে নিয়ে আসে খাবারের নিশ্চয়তা । আবার একজন সহৃদয় ব্যাক্তির কাছে নিয়ে আসে শোক । পরিবারের বুকে নিয়ে আসে স্তব্ধতা । আবার  হত্যাকারীর কাছে নিয়ে আসে উল্লাস । তাই জগতকে আমারা যেভাবে দেখব , জগত ঠিক সে রকম ভাবে আমাদের কাছে প্রকাশিত হবে  ।এই রকম দৃষ্টিকোণ থেকে কি সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় কে  বিশ্লেষন করা যেতে পারে ? সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের কি মৌলিক অবদান আছে  — বাংলা ও বাঙালীর মনের বিকাশে ! তা কি ভাবে মানবজাতির উন্নয়নে কোন কিছু ঘটাতে সাহায্য করে ? আমাদের মননশীলতার চর্চার ক্ষত্রে তিনি কি সত্যিই একটি মৌলিক উপাদান । আমরা  জগতকে কি ভাবে জানবো , দেখবো – সেই প্রেক্ষিতে সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের প্রভাব আছে …… ? 

চলচ্চিত্রের ডিরেক্টর যে  ভাবনা ও বক্তব্য জনমানসে পোঁছে দিতে চান , তার অনেকটাই নির্ভর করে চলচ্চিত্রের  শিল্পী ও কলাকুশলীদের উপর । অভিনয় দক্ষতা , পারদর্শিতার নিরিখে নির্ভর করে চলচ্চিত্রের অবদান ও জনমানসে তার প্রভাব । সেই দৃষ্টিকোণ থেকে  সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের  মৌলিক অবদান  অপরিসীম । এই সৃজনশীলতার ক্ষত্রে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র , নাটকের , কবিতার , আবৃত্তির  বড় প্রভাব পড়েছে । মানুষের জীবনে ‘ রোমান্টিকতা বা রমান্টিজিম  ‘ একটা বড় প্রেক্ষাপট । কল্পনা , স্বতঃস্ফূর্ততা , আবেগ , চেতন – অবচেতন — মনের সাদা খাতার মতো  । মনে যা আসে তা লেখা যায় । ‘ অপুর সংসারে ‘র সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের   ‘ রোমান্টিকতা বা রমান্টিজিম ‘ —  একটি বড় মাইলস্টোন । অপর্ণাকে বিয়ে করতে আসা বর মানসিক ভারসাম্যহীন । তাই বিয়েটা ভেঙ্গে যায় । সেই মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে একরাশ দুশিন্তা । বন্ধু প্লুর অনুরোধে অপু রাজি হয়ে যায় । সেই থেকে শুরু হয় তাদের ছোট সংসার । ভালোবাসার প্রতীক । জীবনকে যাপন করা একটা আর্ট । সেটাই অপুর সংসার – যাপনের জীবন ।  

 

‘ কে তুমি নন্দিনী ‘দের দৃষ্টি স্থির করে দিয়েছেন তিনি । তাঁর ভুরু কোঁচকানো চোখের চাহনি , ছিপছিপে লম্বা চেহারা মুখের সারল্য হাসি  – একটি আইকন । এই রকম মনজয় করা সিনেমার ‘ নায়ক ‘ তিনি ।‘ ফেলুদা ‘ আর একটি বড়  মাইলস্টোন । ছোটদের মনের ছোট ছোট প্রশ্ন , রহস্যময় জগত , অজানা পৃথিবীকে  কে জানার আকাঙ্খা কল্পনার জগতের ছবি । সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ সম্পর্কে , সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে , ছোটদের জন্য তিনি সত্যিই কিছু করতে পেরেছেন ।  এই ফেলুদা চরিত্রে তিনি একদমই  এখনকার ফুটবলের মেসির মতো ।  তাঁর চোখে মুখে বুদ্ধিচর্চার প্রতিফলন । অনন্য , অনবদ্য ।  সত্যজিৎ রায় নিজে স্বীকার করেছেন  যে তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ  ( সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ )   করতে পারতেন না । শুধু সিনেমার পর্দায় নয় । সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজ বইয়ের প্রচ্ছদেও  সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় । 

 

স্বৈরাচারী রাজার দেশে যখন সময়টা বদলাতে থাকে দ্রুত  দুঃসময়ের দিকে  । দেশে একনায়কতন্ত্রের শাসন ।   দুঃখ  , অস্থিরতা , বেঁচে থাকার আকুতি , চাতক পাখির মতো করুন কান্নার আবেদন যেন চারপাশে , সবদিকে  ।  এবং একই সংগে ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে  বিদ্বেষ হিংস্রার  প্রবৃত্তি ।   মানবজীবনের বিভিন্ন পরিসরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে । সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তার লাভ করছে ব্যাক্তি জীবন থেকে পাড়া সমাজে , এমন কি দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে । যেন ঘন ‘ সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে , সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া ‘ । তখন হীরক রাজার দেশে মানুষের ভাবনাচিন্তা বদলের জন্য খুব জরুরী  — পড়াশোনার বিকাশ ও উদয়ন পণ্ডিত । সৌমিত্র সেই  রাজার অরাজকতার দেশে আলোর বার্তাবাহক । ভাবনা ও বক্তব্য জনমানসে পোঁছে দেওয়ার নিরিখে সৌমিত্র অসাধারন ও অনন্য ।   

তখন তিনি বয়সে প্রবীণ । মে – ২০১৫ । ‘ বেলাশেষে ‘ চলচ্চিত্রের মুক্তি । নগর কলকাতায় , পত্র পত্রিকাতে   সিনেমাটির প্রচার বা প্রমোশানের  কেন্দ্রবিন্দুতে একজনই । সিনেমার কাহিনীতেও সেই একজন । সিনেমায় অভিনয় শৈলীর মুগ্ধতার কারন তিনিই ।  কোনি ‘ সিনেমার ‘ ফাইট কোনি ফাইট ‘ বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনে একটি বড় মটিভেশান  । বিশেষ জনপ্রিয় । তিনি নিজেও তাঁর বার্ধক্যজনিত অবসাদ কাটিয়ে উঠতে ও অনেক প্রতিকুল অবস্থায় এই বিশেষ কথাটি উচ্চারন করতেন । 

মননশীলতার চর্চার আর একটি একটি বড় মাধ্যম – নাটক । সেখানেও তিনি অসাধারন । নাটকে হাতে খড়ি শিশির ভাদুড়ীর কাছে । তাঁর অভিনীত ও নির্দেশিত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম কিং লিয়ার , ফেরা , নীলকণ্ঠ , ঘটক বিদায় ইত্যাদি । তিনি নিজে নাট্যকারও । সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের নাটক সমগ্র –  ১ ( ২০১৫ ) এবং নাটক সমগ্র – ২ ( ২০১৭ ) । মানবজীবনে কবিতার একটা ভিন্ন আবেদন আছে । কবিতার লাইন আবেদন করে । কাউকে কাউকে নয় । সবাই কে । তাই তিনি কবিতা লিখেছেন । সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা ( ১৯৯৩ ) , কবিতা সমগ্র ( ২০১৪ ) । সিনেমার ভিড়ে কবি সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় চাপা বা ডাকা পড়েছেন । 

 

“ …… আততায়ী অত্যাচারী কিনা 

  এইসব পড়ন্ত ছায়ার মধ্যে সন্ধান করেছিলাম 

 ল্যাংচাতে  ল্যাংচাতে যে সামনে এসে দাঁড়াল 

সে আমার এতগুলো বছরের নিঃসঙ্গতা 

হাস্যকর ভাঁড়ের পোষাকে । “ 

 ( পড়ন্ত ছায়ার মধ্যে — সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়  ) 

 

 ‘ আবৃত্তি ‘ আমাদের মনকে কাঁদিয়ে দেয় , আবেগে বেদনায় । তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের  ‘ হঠাৎ দেখা ‘ শুনে চোখের কোনে জল আসে নি , এমন কম লোকই আছেন । তাঁর  ‘ আবৃত্তি ‘তে  আট থেকে আশি – সবাই মুগ্ধ ।  মহানগর কলকাতার রাস্তায় খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে ( ১৯৬৬ ) , শিরদাঁড়া হিম করা স্বৈরচারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর জোরালো প্রতিবাদ – আমাদের মনের জোর । আমাদের  প্রতিরোধ শক্তি । দেশের রাজার অমানবিক শাসনের বিরুদ্ধে  সোচ্চার হওয়ার কারনে তাঁর নামে FIR তো সাম্প্রতিক ঘটনা ।     

‘ সৃজনশীলতা ‘র  অবদান ও মৌলিক উপাদানের নিরিখে সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় বহুমাত্রিক । ভালো- মন্দ , সুখ – দুঃখ , পতন – উত্থান ইত্যাদি নানান বিপরীতমুখী বিষয়ের মধ্যে  লড়াই – সংঘাত নিয়ে আমাদের জীবন যাপনের দিনলিপি ।  প্রতিদিনের ঘটনা  । এই নিত্যনৈমিত্তিক সংঘাতে  মানব জীবনের ‘ সার ‘ টুকু  লুকিয়ে আছে ।  এই পরিবর্তনশীল ( Dynamic ) চিন্তাধারা সাহিত্যে সিনেমা নাটকে  ধরা পড়ে । তাঁর এই বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার  এই চর্চা এবং  অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের মনের অনেক ‘ বন্ধ চোখের আগল ‘ ঠেলে রঙের ঝিলিক ঝলমলে দেখিয়ে দেয় । তা অবশ্যই আমাদের মননের বিকাশে মৌলিক উপাদান । 

 

 

লেখক মিরাজুল হক 

  হাওড়া,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত ।        

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]