অণুগল্পগল্পথ্রিলার সংকলনপ্রথম পাতারহস্যসর্বশেষ

হালিম: A Little Love Story

তানভীর আহমেদ সৃজন

 

বাটি থেকে গরম এক চামচ হালিম তুলে নিয়ে নিজের মুখে পুরে নিলো সৌরভ। সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড তৃপ্তিতে দু’চোখ বুজে এলো তার। হ্যাঁ, তার রান্না করা হালিমের স্বাদটা ঠিক আজ থেকে নয় বছর আগে খাওয়া সেই হালিমের মতই হয়েছে!

  হালিম জিনিসটা সাধারণত যত ঝাল হয়, খেতে ততই ভালো লাগে। কিন্তু সৌরভের পছন্দ মিষ্টি হালিম! এর পেছনে অবশ্য বিশেষ একটা কারণ আছে।

  নয় বছর আগের কথা। দিনটা ছিলো ঈদের দিন। সেদিন-ই প্রথমবারের মত বন্যাদের বাসায় গিয়েছিলো সৌরভ। বন্যা সেদিন সৌরভের প্রিয় খাবারগুলো খুব যত্ন করে রান্না করেছিলো। ক্যারামেল পুডিং, ডালের হালুয়া, আর…… আরেকটা কী, সেটা সৌরভ কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না। তবে জিনিসটা যেহেতু ঘন এবং মিষ্টি, তাই সৌরভ ধরেই নিয়েছিলো যে ওটাও হয়ত কোনো হালুয়া। কিন্তু কীসের হালুয়া? আর হালুয়ার ভেতরে মাংসই বা কেন?! এই প্রশ্ন সে যখন বন্যাকে করেছিলো, বন্যা একদম বাচ্চাদের মত ঠোট উল্টে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলেছিলো, “ওটা হালুয়া না, হালিম!”

  পরে জানা গেলো, বন্যা পাশাপাশি দু’টো চুলোয় একই সময়ে হালিম এবং জর্দা রান্না করছিলো। রান্না করতে করতে এক পর্যায়ে সে জর্দায় চিনি দিতে গিয়ে ভুলবশত হালিমে চিনি দিয়ে ফেলেছিলো। পুরো ঘটনাটা শুনে হেসে কুটিকুটি হয়ে গিয়েছিলো সৌরভ! তার কাছে একই সঙ্গে দু’টো প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো- হালুয়ার ভেতরে মাংস কেন এবং জর্দায় মিষ্টি কম কেন?!

  এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন পরই আবার বন্যার কাছ থেকে একটা এসএমএস এসেছিলো তার কাছে। বন্যা তার সাথে দেখা করতে চায়। কবে এবং কখন, সেটা মেসেজে লেখা থাকলেও কোথায়, সেটা লেখা ছিলো না। কারণ তাদের দেখা করার জায়গা একটাই ছিলো।

  সৌরভ নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে তাদের দেখা করার জায়গায় গিয়ে হাজির হয়। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই বন্যাও চলে আসে। বন্যার হাতে একটা ছোট টিফিন বাটি। সৌরভের জন্যে হালিম রান্না করে এনেছিলো সে। বলেছিলো, “খেয়ে দ্যাখো। আজকের হালিমটা কিন্তু একদম পারফেক্ট হয়েছে!” জবাবে সৌরভ হেসে বলেছিলো, “কিন্তু আমার যে তোমার সেই মিষ্টি হালিমটাই বেশি পছন্দ!”

  এরপর একটা গাছের মোটা শিকড়ের ওপর বসে তারা দু’জন যখন টিফিন বাটি থেকে হালিম খাচ্ছিলো, তখন খানিকটা দূরে দাড়িয়ে তাদের দু’জনকে দেখছিলো অনন্ত সরকারের পা চাটা এক ছাত্র। অনন্ত সরকার, পেশায় শিক্ষক হলেও তাকে শিক্ষক বলা মানে গোটা শিক্ষক জাতিকে অপমান করা। বন্যার বাবার বয়সী তিনি। কিন্তু একটা অনুষ্ঠানে বন্যাকে তিনি যেদিন প্রথমবারের মত সৌরভের সঙ্গে দেখেছিলেন, সেদিনের পর থেকেই তিনি ক্রমাগত সৌরভের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন মেয়েটার নাম, ঠিকানা, কোথায় থাকে, কোথায় পড়াশোনা করে ইত্যাদি তথ্যের জন্যে। নিজের এই শিক্ষকের মতলব ভালো ঠেকছিলো না সৌরভের কাছে। তাই সে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেছিলো, “সরি স্যার, মেয়েটার সঙ্গে আমার ঐদিন ঐ অনুষ্ঠানেই প্রথম এবং শেষবারের মত দেখা এবং কথা হয়েছিলো আমার। ওর সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না!” সৌরভ যে মিথ্যা বলছিলো, সেটা বুঝতে অনন্ত সরকারের বুঝতে দু’মিনিট সময়ও লাগে নি। তাই সেদিনের পর থেকেই সৌরভের সঙ্গে রীতিমতো শত্রুভাবাপন্ন আচরণ শুরু করেছিলেন সেই ‘ভদ্রলোক’। শুধু তাই না, পুরো এলাকা জুড়ে সৌরভের সঙ্গে একটা অজ্ঞাত মেয়েকে জড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো নানান রকমের নোংরা সব গুজব। মফস্বল এলাকার মানুষেরাও প্রচণ্ড তৃপ্তি সহকারে খেয়ে যাচ্ছিলো সেসব গুজব, যেন খুবই মুখরোচক কোনো খাবার! এমন একটা দিনও যায় নি, যেদিন সৌরভকে এলাকাবাসীদের কাছে লাঞ্ছিত হতে হয় নি সেই গুজবের কারণে! তবুও একটিবারের জন্যেও মেয়েটার নাম সামনে আসতে দেয় নি সে। কারণ একটা মফস্বল এলাকায় একটা ছেলের নামে বদনাম রটানো হলে এলাকাবাসী কয়েকদিন সেটা নিয়ে লম্ফঝম্প করে,তারপর ভুলে যায়। কিন্তু একটা মেয়ের নামে বদনাম রটানো হলে তারা সেই মেয়েকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে না দেওয়া পর্যন্ত কিছুই ভোলে না!

  যাই হোক, সেদিন বন্যার রান্না করে আনা হালিম খেয়ে তার সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সৌরভ নিজের এলাকায় ফিরতে না ফিরতেই জানতে পারে, এলাকার হর্তাকর্তা গোছের কিছু মুরুব্বি দরবারে বসেছে, এবং সেখানে তার বাবা-মাও উপস্থিত আছে। দরবারের আলোচ্য বিষয়- বখাটে সৌরভ এবং তার বখাটেপনা(!)। সৌরভ খবরটা পেয়েই ছুটে যায় যেখানে দরবার চলছে সেখানে। এবং সেখানে পৌঁছানোর পর সর্বপ্রথম যেটা তার নজরে পড়ে সেটা হচ্ছে তার বাবা-মায়ের পেছনে দাঁড়ানো অনন্ত সরকারের মুখের ক্রুর হাসি!

  সেদিন অনেকেই অনেক রকম কথাবার্তা বলছিলো তাকে নিয়ে। সৌরভের নাকি একাধিক মেয়ের সঙ্গে নোংরা সম্পর্ক আছে, অন্য এলাকায় গিয়ে সে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে নোংরামি করে বেড়ায়, কত মেয়ের নাকি সর্বনাশ-ও করে এসেছে, বাবা-মায়েরা নাকি নিজেদের মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের হতে দিতেই সাহস পায় না সৌরভের মত বখাটেদের ভয়ে ইত্যাদি!

  প্রায় একঘণ্টা ধরে চললো এসমস্ত আলোচনা। আলোচনার শেষে একটা সিদ্ধান্তেও পৌঁছলো মুরুব্বিরা। কী সিদ্ধান্ত, তা এত বছর পরে আর মনে করতে চায় না সৌরভ। সেদিনের পর থেকে বন্যার সাথে আর কোনো কথাবার্তাই হয় নি তার। এমন নয় যে সে ভয় পেয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো। বরং সেই দরবারে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শাস্তি পাবার পরেও সে প্রাণপণে চেষ্টা করেই যাচ্ছিলো বন্যার সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু পারে নি। হয়ত বন্যাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু সমাজের গড়ে দেয়া এক অদৃশ্য দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে আর কখনোই যোগাযোগ হয়ে ওঠে নি তাদের দু’জনের মাঝে!

  দু’চোখ বুজে নয় বছর আগের সেই ঘটনাগুলো যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো সৌরভ। আরো দেখতো, যদি না তার ফোনটা বেজে উঠতো। হাতে ধরা চামচটা বাটিতে নামিয়ে রেখে ফোনটা রিসিভ করলো সে।

  “হ্যালো?”

  “হ্যাঁ সৌরভ, খবর জানিস নাকি?!”

  “কী খবর?”

  “আমাদের অনন্ত স্যার ছিলো না? গত পরশুদিন থেকে নাকি তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না!”

“বলিস কী?!”

  “ঠিকই বলছি! আচ্ছা, তোর সাথে পরে কথা বলি। আরো কয়েকজনকে খবরটা দিয়ে নিই আগে!”

“আচ্ছা।”

  লাইন কেটে দিয়ে ফোনটা পাশে রেখে দিলো সৌরভ। তারপর আবার হালিম খাওয়ায় মন দিলো। বাটি থেকে এক টুকরো মাংস সহ এক চামচ মিষ্টি হালিম তুলে নিয়ে মুখে পুরলো। তারপর তৃপ্তি সহকারে যেই না চিবোতে যাবে, ওমনি ধাতব কিছু একটা ঠেকলো তার মাড়ির দাঁতে। সামনে থেকে একটা খালি পিরিচ তুলে নিয়ে সেটা নিজের মুখের সামনে ধরলো সৌরভ। তারপর মুখ থেকে ধাতব জিনিসটা ফেললো পিরিচটার মধ্যে।

  জিনিসটা একটা স্বর্ণের আংটি। আংটিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সৌরভ। অনন্ত সরকারের মুখের সেই ক্রুর হাসিটা ছাড়াও আরো একটা জিনিস ছিলো বেশ চোখে পড়ার মত- তার ডানহাতের অনামিকায় বসানো এই গোবদা আংটিটা।

 

ঢাকা,বাংলাদেশ।  

  

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]