Chalk n Duster ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার এক উদ্বেগজনক অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে বলিউডে নির্মিত একটি হিন্দি ড্রামা ধাঁচের সিনেমা।২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটির পরিচালক জয়ন্ত গিলাতার। সিনেমার শ্রেষ্ঠাংশে জুহি চাওলা ,শাবানা আজমি ,দিব্যা দত্ত, রিচা চাড্ডা, জারিনা ওয়াহাব প্রমূখ খ্যাতিমান তারকার অভিনয় দর্শকদের যারপরনাই মুগ্ধ করবে।ভারতের একটি বেসরকারি স্কুল (কান্তাবেহেন স্কুল) কর্তৃপক্ষের স্বার্থান্বেষী ভূমিকা ,মুনাফালোভী সিদ্ধান্ত ও রূঢ় আচরণের পাশাপাশি বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে শিক্ষার পণ্যায়নের একটি ‘ক্ষুদ্র’ অথচ ‘বাস্তব’ অংশ উঠে এসেছে সিনেমার চিত্রনাট্যে। স্কুল বোর্ড অফ ট্রাস্টি এবং ক্ষমতাধর পুঁজিপতি নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত স্কুল পরিচালনা পর্ষদের নীরব অর্থনৈতিক দুর্নীতি, শর্টকাটে খ্যাতি লাভ, প্রতিবেশী স্কুলের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহার, শিক্ষাদানের তুলনায় ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রাধান্য লাভ ইত্যাদি বিষয়গুলো সিনেমার মুখ্য উপাদান হয়ে ধরা দিয়েছে। শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব বিবেচনায় ভারত সরকার দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে সিনেমাটিকে কর আওতামুক্ত ঘোষণা করে ।
প্লট : [*স্পয়লার এলার্ট]
স্কুলের পুরনো প্রিন্সিপাল ইন্দু শাস্ত্রীকে হটিয়ে কর্তৃপক্ষের ‘কাছ ঘেঁষা’ কামিনী গুপ্তা নতুন প্রিন্সিপাল পদে অধিষ্ঠিত হলে কান্তাবেহেন স্কুলের হালচাল সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। পুরাতন এবং অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষকেরা একের পর এক ‘বিস্ময়’ উপহার পেতে থাকে নতুন প্রিন্সিপাল ও তাঁর দোসর স্কুল কমিটির কাছ থেকে। পুরানো ও নতুন শিক্ষকদের উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা- গঞ্জনা,তিলকে তাল করে নানা ধরনের ত্রুটি – বিচ্যুতি উপস্থাপন, কথায় কথায় অহেতুক চাকুরীচ্যুতির ভয় এমনকি ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবদেরও অতিরিক্ত ফি’র বোঝা চাপানো ইত্যাদি গর্হিত কর্মকাণ্ডে কান্তাবেহেন স্কুলের সুনাম ও গতিশীলতা স্থবির হয়ে যায়। মারাত্মক প্রভাব পড়তে থাকে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মনোদৈহিক জগতে।এ প্রভাব আরও বিরূপ হয়ে ওঠে যখন অনৈতিকভাবে নতুন প্রিন্সিপাল কর্তৃক চাকরীচ্যুত মিষ্টভাষী, মানবদরদী ও তুখোড় সিনিয়র শিক্ষিকা,বিদ্যা শোকাগ্রস্থ হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন।স্কুলের অপর প্রতিশ্রুতিশীল,জনপ্রিয় শিক্ষিকা,জ্যোতিও নতুন প্রিন্সিপালের কড়া সমালোচনা ও অন্যায় কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেন। স্কুলের অন্যান্য সহকারী শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরাও এ অবস্থায় নীরব ঘৃণা ও প্রতিবাদের ঝড় তোলে।
বেগতিক দেখে নতুন প্রিন্সিপাল ও সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ স্কুল কর্তৃপক্ষ জ্যোতি ও বিদ্যাকে চাকরিচ্যুতির যথার্থতা প্রমাণ করতে টেলিভিশন চ্যানেলে জাতির সামনে ‘পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের’ এক সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষায় অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ করে। যে পরীক্ষায় অণুত্তীর্ণ হলে দুজন শিক্ষিকাকেই চিরবিদায় জানাতে হবে শিক্ষকতাকে
আর উর্ত্তীর্ণ হলে সসম্মানে চাকরি ফেরতসহ আছে ‘পাঁচ কোটি টাকা’ পুরস্কার!
-তো কেমন ছিল সেই শিক্ষকতার পরীক্ষা?
-কি কি প্রশ্ন করা হয়েছিল সেই পরীক্ষায় তাতে?
– তাঁরা দুজন কি উর্ত্তীর্ণ হয়েছিলেন?
–নাকি ভেঙে দিয়েছিলেন টেলিভিশনের সামনে ‘শিক্ষা ও জ্ঞানের বিজয়ের জন্য’ অপেক্ষারত হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক, সহকর্মী দর্শক ও শুভাকাংখীর হৃদয়?
-হিংসুক, অসভ্য প্রিন্সিপাল এবং কর্তৃপক্ষেরই বা ভূমিকা কি ছিল শেষ পর্যন্ত?
পুরো বিষয়গুলোর আদ্যপান্ত জানতে হলে সিনেমাটি দেখে ফেলতে হবে আপনাকে।
ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ :
উত্তরাধুনিক যুগে ‘পুঁজিবাদ’ মানুষের সকল মৌলিক চাহিদায় ভৌতিকভাবে হানা দিয়েছে। অর্থনৈতিক ফায়দাহীন সকল কর্মকান্ড হারাচ্ছে গুরুত্ব,কমে যাচ্ছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সারাবিশ্বে শিক্ষাও এই পুঁজিবাদের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত নয়।একশ্রেণীর মুনাফালোভী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় শিক্ষার ভোগবাদী দিক ও পন্যায়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে এর মূল উদ্দেশ্য যেখানে শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য প্রকৃত জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ মানবিকতা সৃষ্টি। এমতাবস্থায়, শিক্ষাব্যবস্থার একটা ক্ষুদ্র অংশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে Chalk n Duster সিনেমাটি।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মননশীলতা, প্রকৃত শিক্ষার নিশ্চয়তা ও এর মাধ্যমে সমৃদ্ধি আহরণের ব্যাপারে সচেতন দর্শকদের জন্য Chalk n Duster তাই একটি যুতসই সিনেমা হতে পারে। সিনেমাটি দর্শকদের কাছে শিক্ষকতার ইতিবাচক দিক, সম্মান, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রকৃত অবস্থান, নিম্ন বেতন, উপেক্ষিত প্রাপ্য সম্মান, শিক্ষকদের মনোদৈহিক অবস্থার সাথে ছাত্রছাত্রীর সম্পর্ক, শিক্ষার ভোগবাদী ও মুনাফা সংশ্লিষ্ট দিক এবং সরাসরি অর্থনৈতিক মুনাফা বিবর্জিত পেশাটি ‘ততোধিক মূল্যবান’ বিবেচিত না হওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করবে যা একই সাথে অনুপ্রেরণা ও চিন্তার খোরাক হয়ে উঠবে।
উল্লেখযোগ্য ব্যবসাসফল, উচ্চ রেটিং,চমকপ্রদ বা রোমাঞ্চকর কাহিনী সম্বলিত না হওয়ায় আমার ভাষ্যে
Chalk n Duster সিনেমাটি কারও কাছে ‘ওভাররেটেড’ মনে হলেও ব্যক্তিগতভাবে তা মনে করছি না। কারণ, সেলুলয়েডের ফিতায় হলেও শিক্ষকদের বিশেষ করে স্কুল শিক্ষকদের অসম্মান,অপ্রাপ্তি ও নীরব নিপীড়নের চিত্র কিছুটা হলেও ফুটে উঠেছে যা বাস্তব জীবনে অনেক সময়ই নীরবে নিভৃতে হারিয়ে যায়।এই লকডাউনের সময় ছাড়াও চারপাশে খুঁজলে এমন হাজার-শত শিক্ষক পাওয়া যাবে যারা প্রতিনিয়ত চাকরিহারা, বেতনহারা,অভুক্ত,আধপেটা অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করছেন কেবল ‘মানুষ গড়ার কারিগর’, ‘সম্মানজনক পেশা’ ইত্যাদি মৌখিক ‘সান্ত্বনাসূচক’ স্বীকৃতিকে সাথি করে। তবে হ্যাঁ, Chalk n Duster সিনেমাটি স্পষ্টভাবে এই ইঙ্গিতও দেয় যে, দিনশেষে ‘জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণই’ শিক্ষকদের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রাপ্তিতে যার কোন বিকল্প নেই। একই সাথে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিকরণ ও শিক্ষকদের যথাযথ আর্থিক ও সামাজিক মূল্যায়ন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই কাঙ্খিত জাতিগঠণ সম্ভব-এ সত্যটিও সিনেমার মাধ্যমে দর্শকরা উপলব্ধি করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
সিনেমাটির ইন্টারন্যাশনাল মুভি ডাটাবেজ (IMDB) রেটিং ১০ এর ভেতর ৬.৫। আমার ব্যক্তিগত রেটিং অবশ্য একটু বেশি- ৭.৫/১০।আপনিও আপনার রেটিং ঠিক করে নিতে পারেন সিনেমাটি দেখার পর।
[সিনেমা পর্যালোচক- আদনান সহিদ ]