রহমতুল্লাহ লিখন
“ক্ষুধার রাজ্যে পথিবী গদ্যময় :
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ।।”
লাইন দুটি দেখা বা শোনা মাত্রই প্রতিটি সচেতন , অর্ধসচেতন বাঙালির মনে আসে সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম। নিষ্ঠুর শৃঙ্খল হাতে বিস্ময় জাগা এক দুর্ভিক্ষের কবির নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য । নিপীড়িত জনতার বুকে আটকানো কথার প্রতীক ছিল সুকান্ত। সেই নিপীড়ন এখনো চলছেই। হয়ত অন্য নামে, অন্যভাবে সামাজিক অভিনয়ের আড়ালে। কেননা সুকান্তকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বাঙালি সমাজ। একটু জেনে বুঝে নেই সুকান্ত কিভাবে কবি হয়ে উঠল। তাঁর সামসময়িক সমাজে সর্বব্য়াপি মানবিক বিপর্যয় কিশোর সুকান্তের মনে প্রভাব ফেলেছিল। সেই প্রভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখের ভাষা। শুধুমাত্র যে চারপাশের দুঃখ, শোক, নির্যাতনকে অবলোকন করে তিনি কবি হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর মনন এ বিপ্লব দানা বেঁধেছিল তা কিন্তু নয়। বরং নিজ জীবনের নানা দুর্দশা তাঁকে অত্যাচারিত মানুষের মনের ভাব বুঝতে সহায়তা করেছিল। সুকান্তের বন্ধুর মা সরলা বসু যিনি সুকান্তকে কাছে দেখেছিলেন সুকান্তের মা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি তাঁর জবানেই বলে গেছেন সুকান্ত নিজ দুঃখের ভিতর দিয়েই কবি হয়ে উঠেছে।
মাও সেতুং বলেছিলেন, ” জনগণই হবে সাহিত্যের উৎস। কিন্তু জনজীবনের প্রতিফলই সাহিত্য পদবাচ্য হতে পারে না। জনগন শিল্প সাহিত্যের কাছ থেকে নিজেদের জীবনের হুবহু প্রতিলিপি ছাড়াও বেশি কিছু প্রত্যাশা করেন।“ সুকান্তের কবিতা এই কথাকেই যেন বৃহৎ আকারে আমাদের সামনে নিয়ে আসে।
সুকান্তের কবিতায় বিপ্লব ধরা দিয়েছে নানা ভাবে। প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সব ভাবেই তিনি বিপ্লবী। একজন প্রকৃত বিপ্লবীর মত তিনি শুধু তাঁর সময় বা সমাজকে নিয়ে ভাবেন নাই। তিনি অনাগত ভবিষ্যৎ কে নিয়ে ভাবতেন ব্যপকভাবে। সাথে এই জরাজীর্ণ সমাজের বৈষম্য়ের শিকল তাঁকে চিন্তায় ফেলে দিত। “ছাড়পত্র” কবিতায় আমরা তাঁর এই ভাবনা চিন্তার সম্পূর্ণ দেখা পাই। তিনি কেমন সমাজ চান তাঁর কথা বারবার বলে গেছেন তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতার ভাষাই ছিল তাঁর দাবি নির্যাতিত জনতার পক্ষে। একতা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থাকে অন্তরে লালন করতেন তিনি আমৃত্যু। তিনি সমাজের গ্লানি ও জঞ্জাল মুছে ফেলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। নবজাতকের কাছে তাঁর অঙ্গীকার ছিল এই পৃথিবীকে তাদের বসবাসের যোগ্য করে রেখে যাওয়ার। যক্ষ্মার জীবাণু তাঁকে সেই সুযোগ দেয় নাই। কিন্তু তাঁর এই অঙ্গীকারকে বহন করার দায়িত্ব ছিল যারা তাকে ধারণ করতে চেয়েছেন তাদের উপর, যারা তাঁকে নিয়ে চর্চা করেন তাদের উপর। প্রশ্ন আসে তারা কি সুকান্তের আমরণ যে স্লোগান ছিল বৈষম্য়হীন সমাজের তাঁর কথা বলেন ? সমাজের শোষিত শ্রেণীর জন্য তাদের গলার রগ ফুটিয়া তোলেন? এখানেই আমাদের ব্যর্থতা। আমাদের ব্যর্থতা আমরা সুকান্তকে লালন করার অভিনয় করে যাচ্ছি। অনাগত প্রজন্মের জন্য সুকান্তের প্রতিজ্ঞা অবেগবহুল মমতাবিলাস নয়, প্রখর দায়িত্ববোধ থেকে উদ্ভুত। এই দায়িত্ববোধ নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত উপহাস করে যাচ্ছি তাঁকে শুধু বিপ্লবী সাহিত্যিকের পদমর্যাদা দেবার ভিতর দিয়ে।
বাঙ্গালির ব্যর্থতা এখানেই যে আমরা সুকান্ত ও তাঁর কর্মকে শুধুমাত্র সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে চর্চা করেই ক্ষান্ত। সুকান্ত তাঁর কবিতাকে শুধু কবিতা করে রেখে যান নাই। তাঁর কবিতাকে রেখে গিয়েছেন নিপীড়িত , শসিত, নির্যাতিত মানুষের ইস্তেহার করে। তাঁর পরবর্তী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হল এই ইস্তেহার সাথে লাগসই কর্মসম্পাদনা বজায় রাখা। আমাদের সমাজের যারা বিবেক বলে খ্যাত তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই তারা কি সেই কর্ম সম্পাদনার প্রয়াস বা কর্ম করার পরিকল্পনা হাতে নিতে পেরেছেন? আমাদের সুশীল সমাজ বলেযারা মুখে ফেনা ছুটিয়ে সুবিধা ভোগ করেন তারা কি সুকান্তের কাব্য দর্শনের সামাজিক বিস্তার ঘটিয়েছেন বা ঘটানোর কোন উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেছেন? নাকি শুধুমাত্র জন্ম ও মত্যুবার্ষিকীতে নানা প্রবন্ধ, আলোচনা, কবিতা সভার মাধ্যমে সুকান্তের বিপ্লবী সত্তার সাথে প্রহসন করে চলেছেন।
সুকান্তকে দিবসে দিবসে স্মরণ করা বা তাঁকে নিয়ে লেখাই তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর মাধ্যম হতে পারে না। তাঁর অন্তরে লালন করা বৈষম্যের বেড়াজালহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের নিজ নিজ পদক্ষেপই হতে পারত তাঁর প্রতি অসীম সম্মান জানানোর নিদর্শন। তাঁকে প্রকৃতরূপে সম্মান না জানিয়ে তাঁর কবিতাকে শুধু আবত্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ করে রাখাই হল বাঙ্গালির চরম ব্যর্থতা।
রাজশাহী,বাংলাদেশ।