সেকেন্দার আলি সেখ
রহমত নগরের বাদশা মীর জুমলা সভাসদদের ডেকে একটা ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলেন -‘বলো তো, তামাম দুনিয়ার মধ্যে সব চেয়ে সুখী কে?’
বাদশাহের এমন প্রশ্ন শুনে সভাসদরা তো হেসে কুটি -কুটি । উজির সাহেব নওশাদ জুমলা তো কোনো রকমে হাসি থামিয়ে বাদশাহের দিকে মাথাটা নত করে বললেন -‘এটা একটা প্রশ্নই নয়। পৃথিবীর সব লোক জানে সবচেয়ে সুখী কে?
বাদশাহের প্রধান সেনাপতি ইয়াসিন জুমলাও বললেন-‘সামান্য এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনাকে সভাসদদের বৈঠক ডাকার কী প্রয়োজন ছিল জানি না! আপনি এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে জানতে চাইবার আগে, আপনার তখত-তাউসের সদর গেটের বাইরে ধুলোয় পড়ে থাকা প্রায় নগ্ন সেই ফকির-দরবেশকে জিজ্ঞাসা করেই তো জেনে নিতে পারেন l’
সভাসদদের আরও দু’একজন —- ‘বাদশাহ আলমগীর! গোস্তাকি আমাদের মাফ করবেন। উজির সাহেবই যথার্থ বলেছেন, এটা একটা প্রশ্ন হতে পারে না। সামান্য এই প্রশ্নের জন্য আমাদের না ডাকলেই হতো। পথের সামান্য বালক এই প্রশ্নের উত্তর জানে।’ কোষাগারের জিম্মাদার গোলাম গউস জুমলা সভাসদদের বক্তব্য মেনে নিতে পারলেন না। তিনি বললেন -‘বাদশাহ, আমার মতো সামান্য গোলামের নাফরমানি মাফ করবেন। আমি বলি কী, আপনার রাজসভায় উপস্থিত উজির সাহেব, প্রধান সেনাপতি আর অন্যান্য সভাসদস্যদের বক্তব্য আমার মত অধমের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’
উজির সাহেব মাথার পাগড়িতে সামান্য চাপ দিয়ে গর্জে ওঠেন -‘তুমি সামান্য একটা জিম্মাদার হয়ে আমাদের বিরুদ্ধাচারণ করছো? জানো, এর ফল কী হতে পারে ?’
‘তা জানিনে, বাদশাহ আমাদের বিচার করবেন। আমি বলি কী, বাদশাহের এই প্রশ্নটি সামান্য নয়। পৃথিবীর সব চাইতে এটাই কঠিন প্রশ্ন -তামাম দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সুখী কে?’
প্রধান সেনাপতি ইয়াসিন জুমলা চোখটা রক্তবর্ণ করে, কোমর থেকে তরবারি বার করে বলেন -‘জিম্মাদার! তুমি কী আমাদের জ্ঞান দিতে এসেছো? মস্করা করছো আমাদের নিয়ে? বেশী পন্ডিতি দেখাতে যাবে না। তাহলে এই ছোরা দিয়ে তোমার মুন্ডুটা।
-‘খামোশ! খামোশ! ইয়াসিন অস্ত্র নামাও। তোমার তো সাহস কম নয়? সামান্য বিতর্কের সূত্রপাত হতে না হতেই তোমার এমন উদ্ভত আচরণ করা মোটেই শোভন হয়নি? তুমি তো জানো -তোমাদের এই বাদশাহ মীর জুমলা প্রত্যেকের বাক -স্বাধীনতাকে সম্মান দেয়।’
উজির সাহেব হা হা করে হেসে বাদশাহের দিকে তাকিয়ে বলেন -‘পৃথিবীর সব চাইতে সুখী লোক আপনি। এ নিয়ে আর কোনও বিতর্ক থাকতেই পারে না ! আপনি সব চাইতে সুখী মানুষ l’
-‘আমি সব চেয়ে সুখী? কী বলছো উজির সাহেব?
-জি বাদশাহ আলমগীর; আপনিই সবচেয়ে সুখী। আপনার তো কোনো অভাব নেই। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, কোষাগারে সোনা-দানা, হিরে জহরৎ , দামি- দামি মণি -মাণিক্য! আপনি ইচ্ছা করলে যে কোনো প্রজার গদ্দান নিতে পারেন, ইচ্ছা করলে সোনার পালঙ্কে ঘুমোতে পারেন…., তাই তাই আপনিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যাক্তি।’
উজির সাহেবের যুক্তি শুনে বাদশাহ মীর জুমলা হো হো করে হেসে ওঠেন। হাসি থামিয়ে বলেন -‘বাদশাহের এই মুখের হাসি দেখেই কী তুমি আমাকে সুখী আদমি ভাবলে? তুমি জানো না উজির সাহেব, এই বাদশাহ মীর জুমলার হৃদয়ে কত ব্যাথা কত দুঃখ আছে ! আমি তো মনে করি, পৃথিবীর মধ্যে আমি সব চেয়ে অসুখী মানুষ।’
বাদশাহের প্রধান সেনাপতি ইয়াসিন জুমলা বললেন-বাদশাহ আলমগীর.! সুখ- দুঃখ অনুভূতির ব্যাপার ! এটা আপনার মানসিক দুর্বলতা। আপনি নিজেকে শুধু -শুধু দুর্বল ভবছেন!
-না সেনাপতি না। আল্লাহ পাক জানে,আমি কত অসুখী।সত্যি সত্যিই দিনে রাতে আমার মনে সামান্য তম সুখ নেই। তা তোমরা কেউ জানো না l’
-আপনার এ প্রস্তাব মেনে নিতে পারছিনা বাদশাহ আলমগীর।আপনি ঐশর্যশালী আদমি। আল্লাহ সমস্ত ধন দৌলত আপনার ভোগের জন্য রাজদরবারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ পার্শবর্তী রাজা নগেন্দ্র প্রসাদ দেববর্মাও জানেন,আপনার কোষাগারে যে ধন দৌলত মজুত আছে, তা দিয়ে আপনি কয়েক কোটি মানুষকে দশ বছর খানা খাওয়াতে পারেন।’
কোষাগারের জিম্মাদার গোলাম গউস জুমলা প্রধান সেনাপতির মন্তব্য শুনে গর্জে ওঠেন — এই সেনাপতি! এই বাত আমি মানতে পারবো না।আমি জানি ধন -দৌলত কোনো দিন সুখের ঠিকানা হতে পারে না।’
-কেন হতে পারে না গোলাম গাউস? সেনাপতি জিজ্ঞাসা করেন। রাগে রাগে কাঁপতে থাকেন l
-হতে পারে না! তার কারণ আমার মতো সামান্য আদমি সুদীর্ঘ দশ বৎসর কোষাগার পাহারা দিছে। যে কোষাগারে আছে বিপুল ঐশর্য। আমি সেই বিপুল ঐশর্য প্রতিদিনই থরে-বিথরে সাজিয়ে রাখার জন্য নাড়াচাড়া করেও মনে শান্তি পাচ্ছি না। তাই বিপুল ধন-দৌলত কোনদিন সুখের ঠিকানা হতে পারে না।’
উজির সাহেব বলেন – ‘ জিম্মাদার! তুমি তো কোষাগারের সামান্য একজন জিম্মাদার বলেই তোমার মনে শান্তি নেই। কারণ ওই ঐশর্য ভোগ করার ক্ষমতা নেই তোমার। তুমি তো অতি সামান্য একজন কর্মচারী মাত্র। এক্ষেত্রে বাদশাহ আলমগীর এই কোষাগারের মালিক, ইনিই পারেন সব ঐশর্য ভোগ করতে। তাই ,বাদশাহ আলমগীর তামাম দুনিয়ার সব চেয়ে ধনী আদমি। সব চেয়ে সুখী l ‘
বাদশাহ মীর জুমলা নিজের বুকে হাত রেখে আর্তনাদ করে বলেন -‘তোমরা কেউ জানোনা আমার বুকে কত ব্যথা। দিনে রাতে সামান্য সর্ষে পরিমান সুখ আমার বুকে নেই ! যাই হোক কাজী সাহেব কে ডাকো, কাজী কী বলে তা জানা দরকার।’ কাজী ইতমতউদ্দুল্লা জুমলা ইয়া বড়ো পাগড়ি আর জরির পোশাক পরে বাদশাহ সমীপে তাশরিফ রাখলেন।বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন – ‘কাজী সাহেব, তামাম দুনিয়ার মধ্যে সব চেয়ে সুখী ব্যক্তি কে?’
-বাদশাহ আলমগীর,আপনিই সেই সুখী আদমি।কাজী সাহেব উত্তর দেন।
-কিভাবে জানলে, আমি সব চেয়ে সুখী আদমি
কাজী ইতমতউদ্দুল্লা জুমলা এবার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাদশাহ কে কুর্নিশ করলেন। কুর্নিশ করার পর বললেন -‘ আমি কুর্নিশ করলাম ব্যাক্তি হিসাবে আপনাকে নয়। ব্যাক্তি হিসাবে কুর্নিশ করলে দরবারে উপস্থিত উজির সাহেব,প্রধান সেনাপতি, কোষাগার- রক্ষক থেকে শুরু করে আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে যে আদমি আপনাকে পাখার বাতাস করছে, তাকেও কুর্নিশ করতে হত l’
‘ তাহলে শুধুমাত্র বাদশাহ আলমগীরকে কুর্নিশ করলেন কেন ?’ উজির নওশাদ জুমলা সরাসরি প্রশ্ন করলেন কাজী সাহেবকে।
কাজী সাহেব মৃদু হেসে ফরমান দেন – ‘আমি কুর্নিশ করলাম ব্যক্তিকে নয়। বাদশাহ আলমগীরের তখত-তাউসকে। কুর্নিশ করলাম মহান বাদশাহ আলমগীরের বাদশাহী পাগড়িকে, আপনার ওই স্বর্ণখচিত পাগড়িকে। ওই পাগড়ির মধ্যে আমি সুখ দেখতে পেয়েছি।’
বাদশাহ প্রশ্ন করলেন -‘ এই পাগড়ির মধ্যে কোথায় কিভাবে আপনি সুখ দেখতে পেলেন?’
-হাজার হাজার প্রজা ওই স্বর্ণখচিত পাগড়ি দেখে আপনাকেই তো সবচেয়ে সুখী মনে করে। প্রজারা রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে ভাবে, বাদশাহ আলমগীর রহমত নগরের সুখী বাদশা বলেই পালকি চড়ে বিদেশ সফরে যান। আপনাকে তো ভিখারি থেকে শুরু করে রাজত্বের সমস্ত প্রজা সেলাম জানায়,এটাও কী কম সুখের?’
-না কাজীসাহেব এটা সুখের নয়,এটা ভক্তিরও নয়। প্রজারা হয়তো গর্দান যাবার ভয়েই আমাকে সেলাম জানায়, কুর্নিশ করে। আমার মনে হয় বাদশাহ হয়েও আমি এমন একজন আদমি, যাকে দেখে প্রজারা হিংস পশুর মতো ভয় পায়।’
কাজী সাহেব আমতা আমতা করে বলেন – বাদশাহ আলমগীর,আপনাকে বোঝাবার মতো জ্ঞান আমার নেই। আমি আপনাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতেও পারবো না। তবে আমার শেষ কথা,আপনিই তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী আদমি।’
বাদশাহ মীর জুমলা কাজী সাহেবের বক্তব্য শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন, তারপর নিজের মনে বললেন – ‘আল্লাহ জানে সব চেয়ে সুখী কে !’
কোষাগারের জিম্মাদার গোলাম গউস জুমলা বলেন- যদি কিছু মনে না করেন বাদ্শাহ আলমগীর,তাহলে আমি একটা কথা বলতে পারি?
-নির্ভয়ে বলো
-আপনি সুখী কী অসুখী,সে প্রশ্ন আমাদের না করাই ভালো l কারণ আমরা আপনার অনুগ্রহে রাজদরবারে চাকরি করছি আপনার দেওয়া অন্ন ভোগ করে জীবনধারণ করছি l তাই হয়তো কেউ কেউ আপনাকে খুশি করার জন্য,আপনাকে তোষামোদ করতে পারেন l
কোষাগারের জিম্মাদারের মুখে এমন কথা শুনে উজির সাহেব ভীষণ রেগে যান l প্রধান সেনাপতি রাগ সংবরণ করতে না পেরে বলেন -ঠিক আছে,রাজদরবারের বাইরে থেকে পথের কোনও এক বালককে ডেকে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হোক l
-তাই হোক প্রধান সেনাপতি l যাও পেয়াদা, এমন একজন পথের বালককে ডেকে আনো,যে আমার রাজদরবারে কোনদিন আসেনি,যে আমার সুখ কোনোদিন দেখেনি l তাকেই জিজ্ঞাসা করে সব উত্তর জেনে নেব l
পেয়াদা পথের এক বালককে ধরে আনে লতার পরনে সামান্য কাপড় ছাড়া কিছু নেই l আদুল গায়ে বাদশাহের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে রাজদরবারের এককোণে l
বাদ্শাহ মীর জুমলা প্রশ্ন করেন -বলো তো বালক,এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কে সুখী?
-আমার আব্বাজান l বালক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়
বালকের মুখে এমন উত্তর শুনে বাদ্শাহ সমেত সমস্ত সভাসদ চমকে ওঠেন l উজির সাহেব বলেন -কে তোমার আব্বাজান?কোথায় থাকে?
আমার আব্বাজান সামান্য এক ফকির l আব্বাজান নগরের পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়ায় l
বাদ্শাহ মীর জুমলা সিংহাসন থেকে উঠে এসে বালকের হাত ধরে বলেন -বালক,তুমি কী পারবে সেই সুখী আদমিটার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ করে দিতে?শুধু একবার,মউতের আগে শুধু একবার,চোখ ভরে তাকে আমি দেখতে চাই l
– এখন আমি আব্বাজান কে খুঁজে পাবো না দূর নগরে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছে আব্বাজানl সন্ধ্যা নামলে,আব্বাজান যখন আমার খোঁজে বেরিয়ে আসবে,তখনই দেখে নেবেন l
বালকের কথা শুনে সেদিনের মতো সভাসদের বিদায় দেন বাদ্শাহ l রাজ দরবার থেকে উজির সাহেব,প্রধান সেনাপতি,কোষাগারের জিম্মাদার একে একে বিদায় নেন l শুধুমাত্র বাদ্শাহ সিংহাসনে বসে ভাবতে থাকেন,কখন সন্ধ্যা নামবে l
দেখতে দেখতে সূর্যাস্তের পর রহমত নগরে অন্ধকার নেমে আসে l বাড়তে থাকে রাত্রি l আকাশে ছড়িয়ে পরে ফিটফিটে জোছনা lসেই জোছনাভরা আলো মাতাল হয়ে ওঠে ফুলের মিষ্টি গন্ধে l
বাদ্শাহ সুখী ব্যাক্তির সন্ধানে রাজদরবারের গোপন পথ দিয়ে ছদ্দবেশে নেমে আসেন পথের ধুলোয় l সামান্য একজন গরিব মানুষের মতো খালি পায়ে হাঁটতে থাকেন একা – একা l হাঁটতে হাঁটতে কাঁকর বিছানো পথ ধরে এগিয়ে চলেন জরাজীর্ণ একটা মাজারের দিকে l
ঠিক তখনই বাদ্শাহ শুনতে পেলেন গানের মিষ্টি সুর l সেই মূর্ছনায় ভেসে আসে গজলের ছন্দ যেমন আকুতি ভরা গান বাদ্শাহ তো কোনোদিন শোনেন নি! তাই পায়ে পায়ে এগিয়ে যান জোৎস্না -স্নাত পথ ধরে এক জরাজীর্ণ পীরের মাজারেl
গিয়ে দেখেন, একজন ফকির আপনমনে গজল গাইতে -গাইতে করুনাময় আল্লার নামে বন্দেগী করছে l দরবেশের মুখে-চোখে নেই কোনো ক্লান্তি,নেই কোনো দুঃখের ছোঁয়া l চাঁদের আলোয় মলিনবেশধারী সেই আদমিকে দেখে বাদ্শাহ মনে করলেন আসমান থেকে যেন কোনো মহামানব নেমে এসেছে পথের ধুলোয় l
বাদ্শাহ আলমগীর অদূরে দাঁড়িয়ে দেখেন,ফকির -দরবেশের জীর্ণ বেশবাস l মুখে ভর্তি দাড়ি,বড়ো বড়ো লম্বা চুল l খিদের জ্বালায় চোখ দুটো কোঠরাগত শীর্ণ বুঁকের পাঁজর গুলো জোছনাভরা চাঁদের আলোয় যেন পরিষ্কার গোনা যাচ্ছে l তবুও দরবেশের মুখে ছড়িয়ে আছে।
ছড়িয়ে আছে পরম প্রশান্তি l
দেরি না করেই বাদ্শাহ মীর জুমলা হাটু গেড়ে বসেন l পরম ভক্তির সঙ্গে শুনতে থাকেন আল্লাহ পাকের বন্দেগী l
অনেক্ষন পর গজল শেষ করে দরবেশ চোখ খোলে l চোখ খুলে দরবেশ অবাক হয়ে বলে -‘কে ভাই তুমি? তুমি ধুলোয় বসে কেন?’
বাদ্শাহ আলমগীর নিজের পরিচয় না দিয়ে বলেন -‘আমি সামান্য একজন পথিক l পথ ভুল করে এখানে আসে পড়েছি l’
-‘তাতে অতো দুঃখ কীসের? আমি তো আছি ভাই l’
-‘আমি থাকবো কোথায়?খাবো কোথায়?’
-‘কেন ভাই,আমার কাছে থাকবে l এখানেই খাবে l আমার ঝোলায় এখনো একটা শুকনো রুটি আছে, তা তুমি খাবে l মেহমান কী কখনো অভুক্ত থাকে?’
বাদ্শাহ আলমগীর বলেন -‘তুমি না খেয়ে আমাকে খাওয়াতে চাইছো l যদিও জানি তুমি সত্যিই দুঃখী!আমি তো দেখছি , তোমার ঘর নেই, থাকার জায়গা নেই! আহার জোটাবার কোনও ব্যবস্থা নেই!’
-‘না ভাই, আমার সব আছে l আমি বেশ সুখী l’
-‘তোমার এই ভাঙা ঘরে সূর্যের প্রখর তেজ আর শ্রাবনের ধারা বয়ে যায় l সামান্য মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই তোমার! তাই তুমি যতই বলো,আমি জানি- তুমি ভীষণ দুঃখী l তোমার অনেক অভাব l’
ফকির দরবেশ সহজ -সরল শান্ত গলায় বলে -‘না ভাই আমার কোনও অভাব নেই l আমার কোনও দুঃখ নেই! শীত -বর্ষায় আমি আল্লার ধ্যানে বেশ সুখেই আছি l পরম শান্তিতে আছি l’
বাদশাহ আলমগীর ফকির দরবেশের দুহাত জড়িয়ে বলেন -‘সত্যিই তোমার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগলো l তবে আমার একটা অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে ভাই!’
-‘কী অনুরোধ?’
-‘তোমার সুখের জন্য একটা ঘর বেঁধে দিতে চাই l’
-‘না l আমার কোনও ঘরের দরকার নেই l’ দরবেশ স্মিত হেসে জবাব দেয় -‘তোমার খাওয়া পরার একটা ব্যবস্থা করে দিতে চাই l’
-‘না l আমার কোন অভাব নেই খাবার l আল্লাহ তো আমার রুটি-রুজি প্রতিদিনই জুটিয়ে দিচ্ছে l’
বাদশাহ আলমগীর দরবেশের কথা শুনে খুশি হন l দরবেশের সমস্ত অভাব দূর করার বাসনায় নিজের গলার মধ্যে লুকানো বহুমূল্যের হিরা বসানো হারটা দরবেশের হাতে দিয়ে বলেন -‘তোমার সুখের জন্য এই মূল্যবান হারটা তোমাকেই দিতে চাই l এই হার বিক্রি করে তুমি সুখী হতে পারবে l’
ফকির দরবেশ সেই হারটা নিয়ে একবার মুচকি হাসে l তারপর হারটা পথের ধুলোয় ফেলে দিয়ে বলে -‘ভাই আমি সুখী আছি, আমার কোনও অভাব নেই,আমার কোন দুঃখ নেই,আমার কোন কষ্ট নেই l আল্লাহ আমাকে সব দিয়েছে,আমার সব আছে l’ বলতে বলতে ফকির দরবেশ রাতের অন্ধকারে মিশে যায় l
বাদশা মীর জুমলা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকেন ফকির দরবেশের দিকে l দরবেশের কণ্ঠে তখনও প্রতিধ্বনিত হতে থাকে আল্লাহ পাকের বন্দেগী l বিস্তীর্ণ নির্জন প্রান্তরে ধুলোতে বসে বাদশাহ মীর জুমলা আপন মনে অবাক হয়ে বলেন -‘ সত্যিই!দরবেশ নির্লোভ বলেই তামাম জাহানের সবচেয়ে সুখী আদমি হয়ে উঠেছেন
পশ্চিমবঙ্গ,কলকাতা,ভারত।