ভাষা যদিও একটি মাধ্যম । তবুও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা সিনেমা নাটক এবং বাঙালীর একটি বিশেষ বিশিষ্টতা আছে — সৃষ্টিশীলতা । মানব সম্পদের উন্নয়নে এই সৃজনশীল কাজকর্মের বড় অবদান । তা মানবজাতির গঠন ও বিকাশে বড় উপকরণ । মৌলিক উপাদান । যা ভালো ফলাফল বয়ে আনে । যা ‘ রসগোল্লা ’ র মতো ‘ রস ‘ ( আনান্দ , তৃপ্তি ) এবং ‘ গোল ‘ ( লক্ষ্য , উদ্দেশ্য ) – দুটোই প্রদান করে ।
মানুষ তো মননশীল জীব । অন্যান্য প্রাণীদের মত সে শুধুই খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে না । বাঁচার জন্য তার মননশীলতার চর্চার প্রয়োজন । এই মননশীলতার চর্চার করতে গিয়েই সে সৃষ্টি করেছে সাহিত্য , বিজ্ঞান , শিল্পচর্চা প্রভৃতি বিষয় ।
সাহিত্যচর্চা সিনেমা নাটকের অনুশীলন হল ‘ চিন্তা – ভঙ্গী ‘ এবং ‘ দৃষ্টি ভঙ্গী ‘ গঠনের একটি উপাদান । বড় অবদান । সু – অভ্যাসও । এই মানব সমাজ ও পৃথিবীকে যে ভাবে দেখব , ঠিক সেই ভাবে আমাদের মনে প্রকাশিত হবে এই বিপুল পৃথিবী ও মনুষ্য সমাজ । একটি মৃতদেহ শকুনের কাছে নিয়ে আসে খাবারের নিশ্চয়তা । আবার একজন সহৃদয় ব্যাক্তির কাছে নিয়ে আসে শোক । পরিবারের বুকে নিয়ে আসে স্তব্ধতা । আবার হত্যাকারীর কাছে নিয়ে আসে উল্লাস । তাই জগতকে আমারা যেভাবে দেখব , জগত ঠিক সে রকম ভাবে আমাদের কাছে প্রকাশিত হবে ।এই রকম দৃষ্টিকোণ থেকে কি সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় কে বিশ্লেষন করা যেতে পারে ? সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের কি মৌলিক অবদান আছে — বাংলা ও বাঙালীর মনের বিকাশে ! তা কি ভাবে মানবজাতির উন্নয়নে কোন কিছু ঘটাতে সাহায্য করে ? আমাদের মননশীলতার চর্চার ক্ষত্রে তিনি কি সত্যিই একটি মৌলিক উপাদান । আমরা জগতকে কি ভাবে জানবো , দেখবো – সেই প্রেক্ষিতে সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের প্রভাব আছে …… ?
চলচ্চিত্রের ডিরেক্টর যে ভাবনা ও বক্তব্য জনমানসে পোঁছে দিতে চান , তার অনেকটাই নির্ভর করে চলচ্চিত্রের শিল্পী ও কলাকুশলীদের উপর । অভিনয় দক্ষতা , পারদর্শিতার নিরিখে নির্ভর করে চলচ্চিত্রের অবদান ও জনমানসে তার প্রভাব । সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের মৌলিক অবদান অপরিসীম । এই সৃজনশীলতার ক্ষত্রে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র , নাটকের , কবিতার , আবৃত্তির বড় প্রভাব পড়েছে । মানুষের জীবনে ‘ রোমান্টিকতা বা রমান্টিজিম ‘ একটা বড় প্রেক্ষাপট । কল্পনা , স্বতঃস্ফূর্ততা , আবেগ , চেতন – অবচেতন — মনের সাদা খাতার মতো । মনে যা আসে তা লেখা যায় । ‘ অপুর সংসারে ‘র সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের ‘ রোমান্টিকতা বা রমান্টিজিম ‘ — একটি বড় মাইলস্টোন । অপর্ণাকে বিয়ে করতে আসা বর মানসিক ভারসাম্যহীন । তাই বিয়েটা ভেঙ্গে যায় । সেই মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে একরাশ দুশিন্তা । বন্ধু প্লুর অনুরোধে অপু রাজি হয়ে যায় । সেই থেকে শুরু হয় তাদের ছোট সংসার । ভালোবাসার প্রতীক । জীবনকে যাপন করা একটা আর্ট । সেটাই অপুর সংসার – যাপনের জীবন ।
‘ কে তুমি নন্দিনী ‘দের দৃষ্টি স্থির করে দিয়েছেন তিনি । তাঁর ভুরু কোঁচকানো চোখের চাহনি , ছিপছিপে লম্বা চেহারা মুখের সারল্য হাসি – একটি আইকন । এই রকম মনজয় করা সিনেমার ‘ নায়ক ‘ তিনি ।‘ ফেলুদা ‘ আর একটি বড় মাইলস্টোন । ছোটদের মনের ছোট ছোট প্রশ্ন , রহস্যময় জগত , অজানা পৃথিবীকে কে জানার আকাঙ্খা কল্পনার জগতের ছবি । সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ সম্পর্কে , সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে , ছোটদের জন্য তিনি সত্যিই কিছু করতে পেরেছেন । এই ফেলুদা চরিত্রে তিনি একদমই এখনকার ফুটবলের মেসির মতো । তাঁর চোখে মুখে বুদ্ধিচর্চার প্রতিফলন । অনন্য , অনবদ্য । সত্যজিৎ রায় নিজে স্বীকার করেছেন যে তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ ( সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ ) করতে পারতেন না । শুধু সিনেমার পর্দায় নয় । সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজ বইয়ের প্রচ্ছদেও সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় ।
স্বৈরাচারী রাজার দেশে যখন সময়টা বদলাতে থাকে দ্রুত দুঃসময়ের দিকে । দেশে একনায়কতন্ত্রের শাসন । দুঃখ , অস্থিরতা , বেঁচে থাকার আকুতি , চাতক পাখির মতো করুন কান্নার আবেদন যেন চারপাশে , সবদিকে । এবং একই সংগে ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে বিদ্বেষ হিংস্রার প্রবৃত্তি । মানবজীবনের বিভিন্ন পরিসরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে । সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তার লাভ করছে ব্যাক্তি জীবন থেকে পাড়া সমাজে , এমন কি দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে । যেন ঘন ‘ সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে , সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া ‘ । তখন হীরক রাজার দেশে মানুষের ভাবনাচিন্তা বদলের জন্য খুব জরুরী — পড়াশোনার বিকাশ ও উদয়ন পণ্ডিত । সৌমিত্র সেই রাজার অরাজকতার দেশে আলোর বার্তাবাহক । ভাবনা ও বক্তব্য জনমানসে পোঁছে দেওয়ার নিরিখে সৌমিত্র অসাধারন ও অনন্য ।
তখন তিনি বয়সে প্রবীণ । মে – ২০১৫ । ‘ বেলাশেষে ‘ চলচ্চিত্রের মুক্তি । নগর কলকাতায় , পত্র পত্রিকাতে সিনেমাটির প্রচার বা প্রমোশানের কেন্দ্রবিন্দুতে একজনই । সিনেমার কাহিনীতেও সেই একজন । সিনেমায় অভিনয় শৈলীর মুগ্ধতার কারন তিনিই । কোনি ‘ সিনেমার ‘ ফাইট কোনি ফাইট ‘ বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনে একটি বড় মটিভেশান । বিশেষ জনপ্রিয় । তিনি নিজেও তাঁর বার্ধক্যজনিত অবসাদ কাটিয়ে উঠতে ও অনেক প্রতিকুল অবস্থায় এই বিশেষ কথাটি উচ্চারন করতেন ।
মননশীলতার চর্চার আর একটি একটি বড় মাধ্যম – নাটক । সেখানেও তিনি অসাধারন । নাটকে হাতে খড়ি শিশির ভাদুড়ীর কাছে । তাঁর অভিনীত ও নির্দেশিত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম কিং লিয়ার , ফেরা , নীলকণ্ঠ , ঘটক বিদায় ইত্যাদি । তিনি নিজে নাট্যকারও । সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের নাটক সমগ্র – ১ ( ২০১৫ ) এবং নাটক সমগ্র – ২ ( ২০১৭ ) । মানবজীবনে কবিতার একটা ভিন্ন আবেদন আছে । কবিতার লাইন আবেদন করে । কাউকে কাউকে নয় । সবাই কে । তাই তিনি কবিতা লিখেছেন । সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা ( ১৯৯৩ ) , কবিতা সমগ্র ( ২০১৪ ) । সিনেমার ভিড়ে কবি সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় চাপা বা ডাকা পড়েছেন ।
“ …… আততায়ী অত্যাচারী কিনা
এইসব পড়ন্ত ছায়ার মধ্যে সন্ধান করেছিলাম
ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে যে সামনে এসে দাঁড়াল
সে আমার এতগুলো বছরের নিঃসঙ্গতা
হাস্যকর ভাঁড়ের পোষাকে । “
( পড়ন্ত ছায়ার মধ্যে — সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় )
‘ আবৃত্তি ‘ আমাদের মনকে কাঁদিয়ে দেয় , আবেগে বেদনায় । তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘ হঠাৎ দেখা ‘ শুনে চোখের কোনে জল আসে নি , এমন কম লোকই আছেন । তাঁর ‘ আবৃত্তি ‘তে আট থেকে আশি – সবাই মুগ্ধ । মহানগর কলকাতার রাস্তায় খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে ( ১৯৬৬ ) , শিরদাঁড়া হিম করা স্বৈরচারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর জোরালো প্রতিবাদ – আমাদের মনের জোর । আমাদের প্রতিরোধ শক্তি । দেশের রাজার অমানবিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারনে তাঁর নামে FIR তো সাম্প্রতিক ঘটনা ।
‘ সৃজনশীলতা ‘র অবদান ও মৌলিক উপাদানের নিরিখে সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় বহুমাত্রিক । ভালো- মন্দ , সুখ – দুঃখ , পতন – উত্থান ইত্যাদি নানান বিপরীতমুখী বিষয়ের মধ্যে লড়াই – সংঘাত নিয়ে আমাদের জীবন যাপনের দিনলিপি । প্রতিদিনের ঘটনা । এই নিত্যনৈমিত্তিক সংঘাতে মানব জীবনের ‘ সার ‘ টুকু লুকিয়ে আছে । এই পরিবর্তনশীল ( Dynamic ) চিন্তাধারা সাহিত্যে সিনেমা নাটকে ধরা পড়ে । তাঁর এই বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার এই চর্চা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের মনের অনেক ‘ বন্ধ চোখের আগল ‘ ঠেলে রঙের ঝিলিক ঝলমলে দেখিয়ে দেয় । তা অবশ্যই আমাদের মননের বিকাশে মৌলিক উপাদান ।
লেখক মিরাজুল হক
হাওড়া,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত ।