স্পর্শটি খুব গভীরে 

স্পর্শটি খুব গভীরে 

গোবিন্দলাল হালদার

বোকা। শব্দটি বুকের ভেতর জমা হয়ে গেলো। পিকনিক স্পটে যতক্ষণ সরোজ ছিলো ততক্ষণ শব্দটি তার হৃৎপিÐের স্পন্দনের সাথে সমান তালে আঘাত দিয়ে যায়। বুকের বাম পাশে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছাড়ে পড়ে। সরোজ গান গাইতে পারে না। ভালো গল্প বলতে পারে না। এটাই ছিলো কুহেলীর বান্ধবীদের ঈর্শার কারন। এই মর্ম পীড়ায় কখন যে সময় পার হয়ে গেছে সরোজ তা বুঝতে পারেনি। কুহেলীর বান্ধবী তনু এসে জানায়,সবাই গাড়িতে সিট নিচ্ছে,সরোজকেও সিট নিয়ে বসতে হবে। সরোজ চুপচাপ সিটে গিয়ে বসে। মুখে কোনো কথা নেই। কুহেলী বারবার সরোজকে ফলো করছে। বুঝতে পেরে ব্যাগ থেকে ডেল কার্ণেগীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ বইটি বের করে পড়তে থাকে। বেশ কিছু সুঁইচোরা কথা সরোজের কানে এলো। না শোনার ভাণ করে পড়েই যাচ্ছিলো। গাড়ি এ্যালেঙ্গা এসে আধা ঘন্টা স্টপেজ দেয়। অনেকেই প্রকৃতির ডাকে বাইরে যায়। ঘুমের ভাণে দৃষ্টি চাপা চোখে সরোজ দেখে কুহেলী চোখে মুখে তিরষ্কারের ঢেউ ছুঁড়ে দিলো। তার বান্ধবীরা অস্পষ্ট কথায় হাসি দিয়ে সবাই নেমে গেলো।


ড্রাইভার তিনবার হর্ণ বাজালো। সরোজ বুঝতে পারলো গাড়ি মূল গন্তব্যের দিকে রওয়ানা দিবে। সবাই একে একে গাড়িতে উঠছে। কুহেলী ও তার বান্ধবীদের একজন করে ওঠে আর বলে,লাগে বাদাম। ঝালমুড়ি হবে, ঝালমুড়ি। পেপসি,ফান্টা, চুয়িংগাম। আমার পাঁচটি চুয়িংগাম চাই। সরোজ বলল। তনু কাছে গিয়ে বলল, দাম দিন। সরোজ তিরষ্কার বাক্য ছুড়ে দিয়ে বলল, বিকাশ করে পাঠিয়ে দিবো। তারপর কুহেলীর পাঁচ বান্ধবী চুয়িংগাম নিয়ে রস আর বিরসে পথ নাটক করে সারা পথ মজা করে যাচ্ছিলো। পদার্থের স্যার রওশোনুজ্জামান ধমক দিয়ে নাটকের যবনিকা ঘটান। গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে গেলে যার যার মতো সবাই চলে যায়।

পরদিন কলেজ। টিফিন পিরিয়ডে কলেজ লাইব্রেরিতে বসে সরোজ সাহিত্যের বই পড়াশোনা করে। সময় মতো ক্লাস করে। অবশ্য পিছনের সিটে বসে। ছুটির ঘন্টা বাজে। পিছন থেকে কৌশলে আগেই বেরিয়ে পড়ে। সোজা কলেজ লাইব্রেরিতে । লাইব্রেরিয়ানের নিকট বইয়ের তালিকা লিখে স্বাক্ষর করে বই নিয়ে ম্যাচে ফেরে। পূর্বের সেই শব্দটি বুকের ভেতর নড়ে ওঠে। হঠাৎ ফোন আসে। নিহারের ফোন। রিসিভ করে। ও জানালো বেশ কয়দিন হলো সরোজকে খুঁজে পাচ্ছে না। সরোজের অসুখ করেছে কিনা জানতে চাইলো। অসুখ তো একটা ধরেছে ঠিকই। তবে আক্রান্তের মাত্রা এখনও টারসিয়ারি পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তার আগেই সরোজ বোকা শব্দটির সুচিকিৎসার প্রয়োজন মনে করে। এখন সে খুব ব্যস্ত। পরে কথা হবে বলেই সংযোগ কেটে দেয়।

কলেজ বার্ষিকী বেরুচ্ছে। সরোজ ভাবছে কাঁচা হাতের একটা লেখা দিবে। নামে নয় ছদ্মনামে। সম্পাদক রওশোনুজ্জামান স্যার। অবশ্য ছদ্মনামে প্রকাশ করতে তিনি রাজি হয়েছেন। গল্পটি তার স্যারের খুব পছন্দ হয়েছে। সরোজও খুশি। ভাবছে স্যারের সাথে গোপনে দেখা করবে। হঠাৎ রিংটন বেজে উঠলো। অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করবে কি করবে না সরোজ দোটানায় আছে। রাত তখন বারোটা বাজে। এত রাতে কুহেলী কিংবা তার কোনো বান্ধবী ফোন করতে সাহস পাবে না। সরোজ রিসিভ করে। প্রত্যুত্তরের আগেই স্যারের নাম বলে দিলেন। সরোজের সন্দেহ দূর হলো। স্যার জানালেন গল্পটি জাতীয় দৈনিকে পাঠাবেন। সাহিত্য সম্পাদক তার স্যারের ক্লোজ ফ্রেন্ড। সরোজ রাজি হলো। স্বনামে না ছদ্মনামে হবে স্যার জানতে চাইলে সরোজ অনুকার রহমান ছদ্মনামটি প্রস্তাব করে। কলেজ ম্যাগাজিন বের হওয়ার আগেই দৈনিক বর্তমানে লেখাটি প্রকাশ হয়। সারা কলেজে গল্পটি নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠে। তনু সরোজকে ফোনে জানায় বর্তমান পত্রিকায় একটি গল্প পড়েছে। অসাধারণ। লেখককে পেলে তনু প্রেমের প্রস্তাব দিতো। কুহেলীও যদি প্রস্তাব দেয় তো দুই বান্ধবীর মধ্যে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ লেগে যাবে। মাঝপথে লেখক অনুকার রহমান এ্যাটম বোমায় মারা যেতেও পারে। শেষে দোটানায় হৃৎপিÐ দ্বিখÐিত হতে পারে। সরোজ মনে মনে বলে, একটু অপেক্ষা করো তনু। চুয়িংগাম সমাচার নামে আর একটি গল্প লেখা হচ্ছে। পরে সরোজ লাইন কেটে দিয়ে সুইজ স্টপ করে রাখে।


দৈনিক বর্তমান আর কলেজ ম্যাগাজিনের গল্প লেখক একই জন। কুহেলী এই নিয়ে সমস্যায় ভুগছে। কে এই লেখক। কলেজ ম্যাগাজিনে লেখলো। নিশ্চয়ই সে এ কলেজেরই একজন ছাত্র অথবা শিক্ষক। বান্ধবীসহ কুহেলী রওশোনুজ্জামান স্যারের ক্ষণকাল ভবনে গিয়ে হাজির। সে জানতে চায় স্পর্শটি খুব গভীরে গল্পটির মূল লেখকের নাম কী। প্রফেসার রওশোনুজ্জামান রকি কুহেলীর এই জানার আগ্রহটি যে প্রেমঘটিত রোগ তা বুঝে গেছেন। তিনি কুহেলীকে বুঝালেন ছদ্মনামের লেখকদের প্রকৃত নাম জানতে হয় তার লেখার প্রকৃতি দেখে। রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম যে ভাণু সিংহ তা কিন্তু পাঠকই আবিষ্কার করেছেন। তুমি চেষ্টা করো, পেয়ে যাবে। নিকটেই নৈকট্য লাভ। কুহেলী তার স্যারের জ্ঞান গভীর কথা ভাবতে ভাবতে বান্ধবীদের সাথে নিরব পথযাত্রা করে।

রওশোনুজ্জামান স্যার আর সরোজ রহমানের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় কুহেলীর মনে সন্দেহ বাসা বাধে। স্যারই তো ম্যাগাজিনের সম্পাদক । বেশ কিছুদিন সে বিষয়টি নিয়ে মনে মনে যোগ অঙ্ক করে। তাদের আলাপচারিতায় তেমন কোনো সূত্র খুঁজে পায় না। খোঁজ রাখে টিফিন পিরিয়ডে সরোজ কোথায় যায়। বান্ধবী ঋতুকে দিয়ে বিষয়টি ড্রিল করায়। ঋতু একদিন জানায় টিফিন পিরিয়ডে সরোজ সাহিত্য বিভাগের লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করে। কুহেলী জহুরুল হকের একমাত্র বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছে। সরোজ যে ম্যাচে থাকে সেখানে গিয়ে রাঁধুনী ময়নার সাথে সমাঝোতা করে রহস্য উদঘাটনে নেমে পড়ে। এক সপ্তাহ পর রাঁধনী ময়নার সাথে আলাপ করে কিছু ক্লু পায়। ময়না জানায়,সুন্দর একটি খাতায় সরোজ স্যার কী যেন সব লেখে। বিকেলে চা দিতে গেলে বলে এখন লিখছি। তুমি যাও তো বিটি। ডিস্টার্ব করো না। কুহেলীর গোয়েন্দাগিরি ঠিক পথেই এগুচ্ছে বলে তার ধারনা। রাঁধুনী কিছুটা লেখাপড়া জানে। বুদ্ধিমতিও বটে। একদিন সরোজকে বলে , স্যার আপনার গল্পটি পড়েছি। এই দেখুন। এই কাগজেই আছে। দেখুন। কাগজ হাতে নিয়ে ময়নাকে ধন্যবাদ জানায়। ময়না বাটন ফোন ব্যবহার করতে জানে। কুহেলীকে ফোন দেয়। কাঠপট্রি ব্রীজে দেখা করতে। কুহেলী সঠিক তথ্য পেয়ে ময়নাকে এক হাজার টাকা বকশিস দেয়। কথাটি দুইকানে না যাওয়ার জন্য নিষেধ করে। ময়না বলবে না বলে স্বীকারোক্তি করে। এদিকে সরোজ ম্যাচ পাল্টিয়ে রজনীগন্ধা ম্যাচে উঠেছে। ময়না তা জানে না। কুহেলীও কোনো তথ্য নিতে পারছে না। পূর্বের ম্যাচের কাউকে জিজ্ঞেস করাটাও উচিত নয় বলে কুহেলী মনে করে। পিকনিকে সরোজকে অপমান করাটা এখন প্রেমের দিকে গড়াচ্ছে। কলেজ ক্যাম্পাসে তো বোকা শব্দটি বলার জন্য ক্ষমা চাওয়া যায় না। চাই একান্ত মুহূর্ত। একটি মহেন্দ্রক্ষণের আশায় কুহেলী অপেক্ষা করছে। একদিন নিউমার্কেট থেকে কিছু কেনাকাটা করে চিপা গলি দিয়ে বের হতেই সরোজের মুখোমুখি হয়। পথ আগলে দাঁড়ায়। সরোজ মুখে কিছু না বলে তড়িৎ গতিতে স্থান ত্যাগ করে।


সরোজ তার আগের সিমটি বদলিয়ে ফেলে। নম্বরটি জানে তার প্রিয় স্যার রওশোনুজ্জামান। কাউকে নম্বরটি না জানানোর জন্য সরোজ তার স্যারকে রিকোয়েস্ট করে। এদিকে ঢাকা পত্রিকা অফিস হতে সরোজকে ডেকে পাঠানো হয়। তার প্রিয় স্যারের অনুমতিক্রমে সরোজ ঢাকা যায়। অন্যদিকে কুহেলীর অনুসন্ধান কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। সরোজকে সে চিরুনি তল্লাসি করেও না পেয়ে বান্ধবীদের লাগিয়ে দেয়। সরোজ লেখক সম্মানি আনতে ঢাকা গেছে। কলেজের বার্ষিকী অনুষ্ঠানের আগের দিন ফিরবে। কুহেলী জানে না। কলেজ বার্ষিকী অনুষ্ঠানে কুহেলী সিদ্ধান্ত নিয়েছে গল্প লেখকে মালা দিয়ে সম্মানিত করবে। অনুষ্ঠানে পুরুষ্কার বিতরনী ঘোষণা করা হয়। শ্রেষ্ঠ লেখক হিসাবে সরোজের নাম ঘোষণা করা হয়। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অনুমতিক্রমে কুহেলী শ্রেষ্ঠ লেখককে মালা দিয়ে বরণ করবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের দৃষ্টি কুহেলীর মালা প্রদান পর্বের দিকে। কুহেলী মালা পরিয়ে দিতে অগ্রসর হলে সরোজ সরে গিয়ে দূরে দাঁড়ায়।

 

পাবনা,বাংলাদেশ।

 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
নাজনিন নিহার জীবনী; Naznin Niha Lifestyle | বয়স | উচ্চতা |  Biography

নাজনিন নিহার জীবনী; Naznin Niha Lifestyle | বয়স | উচ্চতা | Biography

সিনেমানামা ডেস্ক বর্তমান সময়ে বাংলা নাটকের অনতম জনপ্রিয় মুখ নাজনিন নিহা। নাজনিন নিহাকে খুব বেশি একটা কাজের মধ্যে দেখা না গেলেও তিনি বেশ আলো কেড়ে ...
জোড়া কবিতা- লুনা রাহনুমা

জোড়া কবিতা- লুনা রাহনুমা

লুনা রাহনুমা   হৃদয় ঢেকে রেখেছিলাম কুসুমে কোমলে বাজার থেকে কিনে আনা দামি সুগন্ধে, গোলাপে আতরে জরির ওড়নায় লোকচক্ষুর অন্তরালে – আমার মগজের পচে যাওয়া ...
এই তো জীবন | গোলাম কবির  

এই তো জীবন | গোলাম কবির  

| গোলাম কবির     যেমন কখনো নীল সাদা আবার কখনো ঘনকৃষ্ণ কিংবা ছাইরঙের মেঘে ঢেকে থাকে বাহারি আকাশ, জীবনও তেমনি কখনো আনন্দে, বেদনায়, কখনো গভীর ...
কবিতা- বৌ | আতিদ তূর্য

কবিতা- বৌ | আতিদ তূর্য

আতিদ তূর্য   বউ, তুমি যহন স্নান সাইরে ঘাট থেইকে কলসি ভইরা ফেরো, তহন তুমারে কী যে সোন্দর দেহায়, একেবারে মা প্রতিমার লাহান! তুমার শাড়ি ...
বনলতা সেনের কাছে- আসমা চৌধুরী 

বনলতা সেনের কাছে- আসমা চৌধুরী 

আসমা চৌধুরী  কত প্রশ্ন নিয়ে মাঝরাতে তারাদের খেলা আকাশে নিরব অন্ধকার ডাক দেয় আরো দূরে অনেকেই কারো মুখ এঁকে যায় বনলতা সেন ভেবে। এক আঁজলা অন্ধকারে পান করে ...