ড. গৌতম সরকার
তখন আমার নবম শ্রেণী,
ক্লাসে সিপাহী বিদ্রোহ চলছে,
পরিমলবাবুর স্বরের উৎক্ষেপণ, অবক্ষেপণে
নানাসাহেব, তাঁতিয়া টোপি, ঝাঁসির রানীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রণক্ষেত্র………..
ইংরেজ সেনাদের বন্দুক, কামানের গর্জনে রক্ত চিৎকার মিশে যাচ্ছে ঘাসের বিছানায়;
“দেশমাতা কি জয়!” ধ্বনি দিতে দিতে হাঁসি মুখে মায়ের কোল খালি করে
চলে যাচ্ছে বীর সন্তানেরা,
ঠিক সেই সময় সবাইকে চমকে দিয়ে শেষ বেঞ্চের ছেলে
সুবীর প্রশ্ন করে বসে, “স্যার, ‘স্বাধীনতা’ মানে কী?”
মুহূর্তের মধ্যে ক্লাস জুড়ে চরম স্তব্ধতা নেমে আসে।
কিছুক্ষণের জন্য সবাই যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পেয়ে যায়৷
পরিমলবাবু নিষ্পলক সুবীরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমরা সবাই আতঙ্কগ্রস্ত…….
পড়ার মাঝে কথা বলা স্যার একদম পছন্দ করেন না।
আরও কিছুক্ষণ উদ্বেগে রেখে হঠাৎ দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে স্যার বলে উঠলেন,
“স্বাধীনতা মানে আদিগন্তহীন খোলা একটা আকাশ…..সেই আকাশে উড়ে যাওয়া
শঙ্খচিলের নীল ডানায় এসে পড়ে ভোরবেলার সোনালী আলো,
পায়ের নিচে তিরতিরে বয়ে চলা নদীর কুলকুল গান,
যেখানে পাহাড়, নদী, জঙ্গল, জনপদ একে-অপরে মিলেমিশে থাকে,
সুখ-দুঃখ, হাঁসি-আনন্দের শরিক হয়ে…..যেখানে আকাশের রং ঘন নীল,
ভালোবাসার রং ফিকে গোলাপি, আর কান্নার রং সাদা।
এতগুলো কথা বলে স্যার চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন।
দুহাত দিয়ে কপালের রগ চেপে ধরে মুখ নিচু করে বসে রইলেন৷
একদম চুপ।
আস্তে আস্তে ছেলের দল নড়াচড়া শুরু করল।
স্যারের কি হল বুঝতে পারলো না। ক্রমে অস্থির হয়ে উঠল।
তারপর একজন একজন করে উঠে দাঁড়াল, তাদের কিশোর কণ্ঠ
বেরিয়ে আসতে লাগল একের পর এক জিজ্ঞাসা………!
স্যার, স্বাধীনতার সকালে কি সূর্য অনেক বেশি উজ্জ্বল ছিল!
আকাশ কি আরও গাঢ় নীল বর্ণ হয়ে উঠেছিল!
সবাই কি স্বাধীনতার আনন্দে অকাল হোলি খেলেছিল!
ওইদিন বাড়িতে সবাই মাংস-ভাত খেয়েছিল!
স্যার, গরিব মানুষেরা পেটভরে খেতে পেয়েছিল?
নতুন কাপড়, রাতের আশ্রয়!…..পেয়েছিল?
প্রশ্নের ঝাঁঝ এবং দাপটে মানুষটা চোখের সামনে কুঁকড়ে যেতে যেতে
টেবিলের সাথে মিশে যাচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর স্যার আবার উঠে দাঁড়ালেন
উল্টোদিকের সাদা দেওয়ালের দিকে দৃষ্টি রেখে মুখ খুললেন—
“স্বাধীনতা মানে শাঁখের আওয়াজ, লাল পাড় সাদা খোলের শাড়ি,
রজনীগন্ধা, বেল, গন্ধরাজ, বকুল নিংড়ানো সুবাস……
স্বাধীনতা মানে সাজানো মঞ্চ, মাইক, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি,
গাঁদা ফুলের মালা, সংবর্ধনা, প্রশস্তি পাঠ আর রবীন্দ্র সংগীত……
স্বাধীনতা মানে ইতিহাস বই, অবসরভাতা, চাকরি, নতুন জীবন,
নতুন সূর্যোদয়,
দূষণহীন পৃথিবী….আরও অনেক কিছু।”
তারপর আবার বিরতি, আবার উসখুস, আবার অস্থিরতা, গুঞ্জন…….
স্যার আবার শুরু করলেন, তবে এবার স্বরবিক্ষেপ ঘটে গেল….
“স্বাধীনতা মানে আখের, শোষণ, হঠকারিতা,
স্বাধীনতা মানে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, দেশভাগ, জাত্যাভিমান,
স্বাধীনতা মানে সংবাদপত্রে দারিদ্রলাঞ্ছিত নবতিপর এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর ছবি,
স্বাধীনতা মানে সবলের অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নেওয়া, সাথে বেকারত্ম,
দুর্ভিক্ষ, অভাব, অনুযোগ,
স্বাধীনতা মানে ধর্ষণ, খুন, উচ্ছেদ, অপমান,
স্বাধীনতা মানে শহীদের বিধবার রেশনের লাইনে দীর্ঘ অপেক্ষা।
স্বাধীনতা মানে ক্ষমতার জাদুতে সাজানো সম্পদের পাহাড়
স্বাধীনতা মানে লন্ডনে ফ্ল্যাট আর সুইস ব্যাংকে বউয়ের নামে অ্যাকাউন্ট..
স্বাধীনতা মানে সবটা ধুলো অন্যের গায়ে মাখিয়ে
সুউচ্চ অট্টালিকায় শীততাপ ঘরে নিজেকে অমলিন রাখা।
ক্লাস শেষের ঘন্টা বেজে ওঠে।
এক ভেঙে পড়া বটবৃক্ষের ন্যুব্জ ছায়া
ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে যায়।