লেখা – আশিক মাহমুদ রিয়াদ
বাংলাদেশী সিনেমার পালে এক টুকরো হাওয়া দিয়েছে যে সিনেমাটি তার নাম ‘হাওয়া’। সিনেমাটির সাদা সাদা কালাকালা গানটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই দর্শক লোলুপ ক্ষুধায় গানটিকে গ্রাস করে নিয়েছিলো নিজেদের মধ্যে। এই স্রোতের বিপরীত নই আমিও!
(স্পয়লার থাকতে পারে)
ভেসে থাকা একটা বোট যে বোটকে বরিশালের মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় বলে, “সাগইর্যা ট্রলার” গহীন নীল জলরাশির বিস্তীর্ণ সমুদ্র..যেখানে মানুষের জীবনটার সাথে মিশে থাকে অপ্রত্যাশা, আশা-নিরাশের এক অপার্থিব মেলবন্ধন সেখানে যদি মেলে রক্তটকটকে গোধূলী, সমুদ্রের নেমে আসা গভীর রাত কিংবা ভোর সকালের অপার্থিব সৌন্দর্যে ! ঠিক সেখানেই জন্মে ক্ষুধা কিংবা কামনার নিঙরানো লোলুপ লোভ। ঠিক সেখানেই হাসে প্রথম দিন রাঙানো সূর্যের মতো তপ্ত প্রতিশোধের আগুন!
হাওয়া সিনেমার ট্রেলার
মেজবাউর রহমান সুমনের পরিচালনায় হাওয়ার দুর্দান্ত মেকিং, সিনেমাটোগ্রাফির বিস্তীর্ণ জলরাশির সাথে মিশেছে মিথোলজির এক অনন্য অভাবনীয় গল্প! মেজবাউর রহমান সুমন বাইরের কোন গল্প বলতে চাননি। ছোটবেলা থেকে শুনে আসা কল্পকথার গল্পকে বলেছেন নতুন আঙ্গিকে, নতুন চরিত্রে। বাংলাদেশ নদী-সাগর উপকূলীয় কেন্দ্রীক দেশ হলেও নদী নিয়ে এর আগে বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মাণ হলেও ‘বঙ্গোপসাগরে নির্মিত এই সিনেমা দেশে প্রথম!
[হাওয়া সিনেমা হল লিস্ট]
হাওয়া সিনেমায় আমি দ্বন্দ কিংবা গৎবাঁধা ধারাবাধা গল্পকে পাইনি! সবথেকে পজেটিভ দিক.. এই সিনেমায় একটি মাত্র গান। যে গানটি উড়িয়ে দিয়েছে পাল….সেই পালে ধরা দিয়েছে কলবাতাসের অভূতপূর্ব পরিবর্তন। সিনেমা দেখার আগে আম্মাকে বলেছিলাম, মা.. ছোটবেলায় বাংলা সিনেমা দেখতে দিতে চাইতে না.. কিন্তু আমি এই সিনেমা দেখতে যাবোই। মা অবশ্য আমার কথার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, আগের মত সিনেমা এখন আর আছে নাকি ব্যাটা?’
হাওয়ার সিনেমাটোগ্রাফি বিজিএম এক্সট্রিম লেভেলের। এর আগে এতটা এসবের উপর এতটা এফোর্ট দেওয়া হয়েছে কি না.. বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রিতে সত্যিই তা বিরল!
[বাংলাদেশী সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রিকে বদলে দিতে আসছে যেসব সিনেমা দেখুন নিচের ভিডিওতে]
হাওয়ার অভিনেতা নিয়ে আলাদা করে বিশ্লেষন করার ক্ষমতা বা বিচক্ষণতা আমার নেই। তাও গহীন সমুদ্রে অভিনেতাদের এফোর্ট..তপ্ত রোদে নিজেদের শানিয়ে নেয়া সোজা সাপ্টা কথায় সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার সাথে নিজেদের বেঁধে রেখে অভিনয় করাটাও নেহাত কম সাহসের কিংবা পরিশ্রমের নয়। ব্যক্তিগতভাবে নাজিফা তুষির সাথে নাসির উদ্দিন খানের অভিনয়ের এতটা ভালো লেগেছে বলার মতো না। নাসির উদ্দিন খান জীবন সংগ্রামকে তুচ্ছ করে অভিনয় শিল্পকে ভালোবাসার মানুষ। হাওয়া সিনেমায় ওনার আলাদা একটা জোশ আছে! নাগু চরিত্রে অভিনয় করা নাসির উদ্দিন খানের অনবদ্য অভিনয় স্ক্রিনে হলে দর্শকদের মাঝে এনে দিয়েছে প্রাঞ্জল চাঞ্চল্যতা। চঞ্চল চৌধুরী একের পর এক ফাঁটিয়ে দিচ্ছেন। শরিফুল রাজকে ন..ডরাই থেকেই ভীষণ উদ্যমী মনে হয়েছিলো। উনি নিজের সময় কে কাজে লাগাচ্ছেন এটাই আসল কথা। সোহেল মন্ডল সহ সিনেমায় অভিনয় করা উর্কিস পার্কিসের সাথে মরা চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতাকে ভীষণ সম্ভাবনাময়ী মনে হয়েছে। সুমন আনোয়ার ভালো পরিচালক জানতাম। এর আগে উনার বেশ কিছু কাজ দেখা হয়েছিলো অবশ্য। হাওয়ায় উনি অভিনয় করেছেন সবার সাথে পাল্লা দিয়ে। সব মিলিয়ে ‘হাওয়া’ একটা নবউদ্যমী অভিনেতাদের জাগরণের এক কম্বাইন ফিউশন!
পরিচালক যে এফোর্ট দিয়েছেন, যে পরিশ্রম করেছেন সেটা হাওয়া সিনেমার প্রত্যেকটা স্ক্রিণে ভেসে উঠেছে। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সুমন সাহেবকে বেশ আলাদা মানুষ মনে হয়..উনার আর্ট ডিরেকশন এতটা এক্সট্রিম লেভেলের তা ভাবা যায় না। হাওয়ায় চেষ্টা করেছেন নিজের সর্বোচ্চাটা দিয়ে। সেই সাথে আলাদা লেভেলের ডিরেকশন, সিনেমার কাজ শুরু করার আগে গহীন সমুদ্রে গিয়ে জেলেদের সাথে বসবাস এসবে এতদিন তার ইন্টারভিউ তে শুনলেও সিনেমা হলে গিয়ে হাওয়া দেখে উপলব্ধি করেছি । সমুদ্রের সাথে সংগ্রাম চলে না, তাও সমুদ্রেই সংগ্রামে নামতে হয় কিছু মানুষকে। জীবনের টানে, ভালো দিনের আহ্বানে, ভালো থাকার তাগিদে !
কটা মানুষের কতদিনের কষ্ট তাকে মানুষ চিনবে গানের মাধ্যমে.. কত আশা থাকা..আসলে সত্যি কথা বলতে এটাই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের স্বপ্ন..সেই স্বপ্নকেই যথার্থ স্থানে পৌছে দিয়েছেন মেজবাউর রহমান সুমন। গানের পাখি হাশিম মাহমুদকে পৌছে দিয়েছেন শ্রোতাদের মাঝে..সাদা সাদা কালা কালা… কি অনবদ্য সৃষ্টি! হাশিম মাহমুদ পেয়েছেন যথার্থ স্থান! হাওয়ার সুঘ্রাণ পৌছেছে তারুণ্যের অন্তরে, রিক্সাওয়ালা থেকে ছাত্র তরুণ, সবার গলায় এই গান। এই তো ছিলো এক সময় বাংলা সিনেমার শুভ দিন ! এখনই সময় হলগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর!
সিনেমাটির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে আলাদা করে বলা অথবা লেখার অবকাশ নেই। বরিশালে যে সিনেমা হলটিতে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে সেই সিনেমা হলটির সাউন্ড সিস্টেম ভীষণ নাজুক। অবশ্য অল্প টাকায় হাওয়া দেখে পরাণে যে হাওয়া দিতে পেরেছি এর থেকে আর কি ! ঐ যে বললাম এরকম একটার পর একটা ব্লকবাস্টার সিনেমা আসলে সিনেমা হলগুলোর চেহারা পালটে যাবে !
হাওয়া সিনেমা বাংলাদেশের সব সিনেমাপ্রেমীদের জন্য অবশ্যই না! যারা হুজুগে ভাইরালের ঘ্রাণে নাক না দিয়ে আর্টকে গল্পের যথার্থতাকে মূলয়ন করেন এবং ভালোবাসেন তাদের জন্য হাওয়া এক অনবদ্য সিনেমা নিঃসন্দেহে! বাংলা সিনেমায় সত্যিই নতুন দিনের হাওয়া এসেছে।