নাঈমুর রহমান নাহিদ
সীমা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে আমার কাছেই চেকআপ করাচ্ছে। সাড়ে আট মাস হতে চলল অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে সে। সব রিপোর্ট এতদিন নরমালই ছিল। হঠাৎ প্রচন্ড ব্যাথা উঠায় আমার কাছে ফোন দেয় সীমার স্বামী আসাদ। একেবারেই সাদাসিধে একটা ছেলে। ভীষণ চঞ্চল। সীমার বেশ খেয়াল রাখে দেখলাম। আমি ফোন রিসিভ করতেই আসাদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল,
– ম্যাডাম, সীমার ভীষণ ব্যাথা উঠেছে। প্রচন্ড চেঁচামেচি করছে। কি করব এখন?
আমি আসাদকে প্রথমে শান্ত হতে বললাম। তারপর বোঝাতে লাগলাম,
– ভয়ের কিছু নেই। সাড়ে আটমাস হয়ে গেছে। হয়ত ওর ডেলিভারির সময় হয়ে গিয়েছে। তুমি যত দ্রুত সম্ভব সীমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসো। আর সীমার সামনে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর। ওকে অভয় দাও। তোমাকে এভাবে ঘাবড়ে যেতে দেখলে ও নিজেও ভয় পেয়ে যাবে। এতে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।
– আচ্ছা ম্যাডাম। আমি ওকে নিয়ে আসছি। দ্রুত কথাটা বলে ফোন কেটে দিল আসাদ।
আমি মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখতেই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করল রাশেদ। জেরিনের হাজবেন্ড। আমার আরেক পেশেন্ট জেরিন। ওরো ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে এসেছে। হঠাৎ এভাবে রাশেদের আগমনে কিছুটা চমকে গেলাম আমি।
– ম্যাডাম জলদি চলুন। বাসায় পানিভর্তি বালতি উঠাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে জেরিন। প্রচন্ড ব্যাথা উঠেছে। কিছুতেই ওকে সামলানো যাচ্ছেনা।
রাশেদের কথায় কিছুটা অবাক আর কিছুটা রাগ হলাম।
– ওকে এই অবস্থায় পানিভর্তি বালতি উঠাতে দিয়েছ কেন ? এতটা কেয়ারলেস কি করে হতে পার তুমি!
– ম্যাডাম ওকে কেউ বালতি উঠাতে বলেনি। ও নিজেই বালতি উঠাতে গিয়েছিল। এত করে নিষেধ করলাম ভারি কাজ না করতে কিন্তু ও শুনলে তো। ম্যাডাম আপনি তাড়াতাড়ি চলুন।
– কোথায় আছে ও?
– ৩নম্বর কেবিনে ম্যাডাম।
– আচ্ছা চলো।
তিন নম্বর কেবিনের সামনে আসতেই জেরিনের কাতরানোর আওয়াজ কানে আসে আমার। ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠছে সে। আমি জেরিনের কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরে ওকে অভয় দেই। আশ্বাস দেই কিছু হবেনা ওর। জেরিনকে ভালো করে দেখে নেই। অবস্থা ক্রিটিকাল। এখনি অপারেশন করা লাগবে। রাশেদকে কথাটা বলতেই রাশেদ বলল,
– অপারেশন করা লাগলে করুন ম্যাডাম। আমি টাকার ব্যবস্থা করে রেখেছি।
– আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করছি। কথাটা বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি।
আমার কেবিনে আসতেই হঠাৎ মনে পড়ল আসাদ সীমাকে নিয়ে হাসপাতালে আসছে। সীমারও ডেলিভারি করতে হতে পারে। এর আগে সীমাকে চেকআপ করতে হবে। যদি ডেলিভারি করতে হয় তাহলে তো বিপাকে পরে যাব। একসাথে দুইজনের ডেলিভারি কিভাবে করব! আমি দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে সহকর্মী শায়লাকে ফোন দিলাম। জরুরী দরকার আছে বলে তলব করলাম তাকে।
অল্প সময়ের মধ্যেই হাসপাতালে এসে হাজির হলো শায়লা। আসাদও সীমাকে নিয়ে এর মধ্যে এসে গেছে। শায়লাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমি জেরিনের অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।
প্রায় আধঘণ্টা অপারেশনের পর অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি। বাইরে রাশেদ, তার মা, ভাই এবং জেরিনের মা অপেক্ষা করছে। বের হয়ে আসতেই রাশেদ প্রায় দৌড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
– কি অবস্থা ম্যাডাম? রাশেদের চোখে মুখে আতঙ্ক।
– জেরিন ঠিক আছে। নিচু গলায় বললাম আমি। কিন্তু তোমার সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি। পড়ে যাওয়ার কারণে মাথায় আঘাত লেগেছিল বাচ্চার। যার কারণে পেটের মধ্যেই মারা গেছে সে।
আমার কথা শুনে রাশেদ বরফের মত জমে গেল। জেরিনের মা আঁচল দিয়ে মুখ চেপে রাশেদের মাকে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁপে উঠল। আমি রাশেদের কাঁধে হাত রেখে বললাম,
– শক্ত হও। এখন জেরিনকে তোমাকেই সামলাতে হবে। তুমি এভাবে ভেঙ্গে গেলে জেরিনও আপসেট হয়ে যাবে। একটু পরেই জেরিনকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। যতটা সম্ভব নরমাল থাকার চেষ্টা কর ওর সামনে।
কথা শেষ করে নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিলাম আমি হঠাৎ কোথেকে আসাদ দৌড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। হাতে মিষ্টির বক্স। চোখে মুখে উত্তেজনা।
– ম্যাডাম আপনাকেই খুঁজছিলাম এতক্ষণ ধরে। আমার মেয়ে হয়েছে ম্যাডাম।
কথাটা শুনেই একটা হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে।
– কংগ্রেচুলেশন আসাদ। সীমার কি অবস্থা?
– মা-মেয়ে দু’জনই সুস্থ আছে ম্যাডাম। নিন ম্যাডাম মিষ্টি খান। আমার দিকে মিষ্টির বক্সটা এগিয়ে দিল আসাদ।
আমি মুচকি হেসে একটা মিষ্টি নিয়ে আসাদকে অভিনন্দন জানালাম। আসাদ দ্রুত পায়ে হেঁটে তাদের কেবিনের দিকে চলে গেল।
আমি মিষ্টি হাতে পিছে তাকিয়ে দেখলাম রাশেদ এখনো নীরবে কাঁদছে। রাশেদের মা আর শ্বাশুরি মলিন মুখে চেয়ারে বসে আছে। হয়ত প্রথম সন্তান নিয়ে অনেক প্ল্যান ছিল তাদের। কিছুই হলো না। একই ছাদের নিচে একদিকে যখন আসাদ তার পরিবারের নতুন সদস্যের আগমনে মিষ্টি বিতরণ করছে ঠিক তখন আরেকদিকে রাশেদ তার প্রথম সন্তানের জন্মের আগেই মৃত্যুতে নীরবে অশ্রু ফেলছে। একদিকে মলিন মুখে আমি তাদের সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ দিচ্ছি। আরেকদিকে আসাদের সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার খুশিতে মিষ্টি খাচ্ছি। প্রতিদিনই এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয় এই হাসপাতালে। এমন পরিস্থিতির জন্ম দেয়া লোকগুলো ভিন্ন হলেও ভোক্তা হিসেবে আমরা ডাক্তাররা অভিন্নই রয়ে যাই। সত্যিই আজব এক জায়গা এই হাসপাতাল।
.
.
ইসলাম নগর, মাতুয়াইল, ঢাকা।